জ্বলদর্চি

পটুয়া সমাজের বিচিত্র বৃত্তি/আবেদ চিত্রকর


পটুয়া সমাজের বিচিত্র বৃত্তি                   

আবেদ চিত্রকর     


সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রবাহিত বাংলার পটচিত্র শিল্পের দীঘল পট বা জড়ানো পটগুলি সাধারণত গ্রাম্য পটুয়া শিল্পীদের দ্বারাই অঙ্কিত। এই দীঘলপট বা জড়ানো পটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার গীত। ওই গীতগুলির কাব্যিক ভাব, লালিত্য ময় তুলির টানে চিত্র ও মূল কাহিনী উপদেশ সব মিলিয়ে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট মানের শিল্প রস সৃষ্টি করে বলেই গুরুসদয় দত্ত মহাশয় তাঁর পটুয়া সংগীত গ্রন্থে পট শিল্পকে 'উচ্চাঙ্গের রস শিল্প'বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি-নীতির প্রভূত পরিবর্তন ঘটেছে, ন্যায় নীতি বোধহীন ভোগবাদী পশ্চিমী সংস্কৃতিতে শিক্ষিত হয়ে ভারতবর্ষের মানুষ সেই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অনুকরণে মানুষ মেতে উঠেছে। ফলে বাংলার অন্যান্য লোকশিল্প গুলির মত পট শিল্পও এখন প্রায় অবলুপ্তির পথে। কিন্তু আমাদের মনে হয় এই বিলুপ্তপ্রায় অবস্থাতেও বাংলার জাতীয় জীবনে এখনো পট শিল্প শ্রেষ্ঠতম, গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প সম্পদ। বর্তমানে শহুরে শিক্ষার প্রভাব বিস্তারে এবং আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে পড়ে পেশিত ও নিঃশেষিত হয়ে পট শিল্পের চাহিদা এবং গুনগ্রাহিতা এই বাংলার গ্রাম্য জীবন থেকে প্রায় উৎপাটিত। চাহিদার অভাবে পড়ে গ্রাম্য পটুয়া শিল্পীদের সুনিপুণ শিল্পকলার দ্বারা অন্ন সংস্থানও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তাই বাধ্য হয়ে পটুয়া দের একটা বৃহত্তর অংশ বংশানুক্রমিক এই শিক্ষা ও শিল্পকে ছেড়ে দিয়ে জন-মজুরের বৃত্তি গ্রহণ করেছেন। সুপ্রাচীনকাল থেকে দীঘলপট চিত্র অংকন করে ও তৎসংশ্লিষ্ট গীত সহযোগে জন সমক্ষে পটচিত্র প্রদর্শন করে অর্থ উপার্জন করাই ছিল পটুয়াদের মূল বৃত্তি। তাছাড়াও আর্থিক সঙ্গতি তে সচ্ছলতা আনার জন্য পটুয়ারা হিন্দুদের পূজার জন্য দেব-দেবীর ছবি আঁকা, মাটির প্রতিমা নির্মাণ,  মাটির দেবী মুখোশ তৈরি, ঘট চিত্রাঙ্কন ও ছোট ছোট মাটির পুতুল তৈরির মাধ্যমেও অর্থ উপার্জন করতেন। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমিও প্রত্যক্ষ করেছি আমার দাদু নগেন চিত্রকর এই এলাকার সুবিখ্যাত মৃৎশিল্পী ছিলেন। দাদুর সঙ্গে বাবা,জ্যাঠা, কাকা ও প্রতিবেশীরা অনেকেই মাটির প্রতিমা তৈরীর সাথে সাথে পটচিত্র প্রদর্শন করতেও গ্রামে গ্রামে যেতেন। আমি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি এত বৃত্তি ধারণ করলেও অর্থ সংকট কোনদিনও পটুয়াদের পিছু ছাড়েনি। হিন্দু দেবদেবীর ছবি আঁকা ও প্রতিমা গড়ার কাজে ব্যাপৃত থেকেও বাংলার ইতিহাসের আবর্তনে হিন্দু সমাজের গন্ডী হতে পটুয়ারা বিতাড়িত হয়ে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে ঘৃন্য জাতি বলে বিবেচিত।

         সামাজিক এই হৃদয় বিদারক নিপিড়ন সত্ত্বেও পটুয়ারা পুরুষানুক্রমে অতি সযত্নে এই চিত্রশিল্পের চর্চা বহন করে চলেছেন। অর্থাভাবে, অনশনে ও অর্ধানশনে অতি দুর্ভাগ্য দিনহীন জীবন যাপন করেও বাংলার পটুয়ারা এই চিত্রকলা সম্পদকে বিশ্বের চিত্রশিল্পের আসরে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে সমর্থক হয়েছে। এই বাংলা ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যগুলির পটচিত্রশিল্প চর্চার ইতিহাস টা একটু আলাদা। সেই সুপ্রাচীন প্রাগ বৌদ্ধ যুগিয় চিত্রশিল্পের আদিম পদ্ধতির ধারাবাহিকতা নাই বললেই চলে। কিন্তু বাংলার পটুয়ারা সেই আদিম পদ্ধতির ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে অসাধ্য সাধনে সক্ষম হয়েছেন। এই বাংলার দীন-দরিদ্র পটুয়াদের অদম্য প্রয়াস ও নিরন্তর সংগ্রামে পটচিত্র শিল্পকলা আজও জীবন্ত হয়ে আছে। আর্থিক অনটনে জর্জরিত বাংলার পটুয়া গন সামাজিক দুর্গতির মধ্যে পড়ে প্রয়োজনে কখনো নানান বৃত্তি গ্রহণ করেছেন আবার কখনো বর্জন করেছেন কেবলমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

        বাংলার বিভিন্ন জেলায় আমাদের পূর্বপুরুষ এই যাযাবর পটুয়া গন তাঁদের নিজেদের প্রয়োজনে সুবিধা মতো নানান বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে নানাভাবে বৃত্তি গ্রহণ করে নিজেরাই বিভক্ত হয়েছিলেন বিভিন্ন শ্রেণীতে। তবে প্রত্যেকের একটাই পরিচয় ছিল, তা হল চিত্রকর বা পটিদার বা পটুয়া। বর্তমানে পটুয়া দের বৃত্তির অন্ত নাই। বিচিত্র বৃত্তি গ্রহণ করেও অর্থনৈতিক দুর্দশা সেই প্রাচীনকাল থেকে পটুয়াদের নিত্য সঙ্গী। সুপ্রাচীন পটচিত্র শিল্পের ললিতক্রোড়ে বংশ-পরম্পরায় বেড়ে ওঠা লোকশিল্পী পটুয়াগণ জীবনের সমূহ নৈরাশ্যকে উপেক্ষা করে নানান বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই, এই লোক মাধ্যমটিকে বংশপরম্পরায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আজ সমাজের এই অস্থির সময়ে পটচিত্র শিল্পের ধারক ও বাহক হিসাবে যে সমস্ত নেতৃস্থানীয় পটুয়া শিল্পীগণ আছেন তাদের কাছে আমার আকুল আবেদন হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে আন্তরিক তাগিদে ভাবি প্রজন্মের হাতে ধরিয়ে দিন পটচিত্র শিল্পের প্রজ্জ্বলিত মশাল। যে মশাল পটচিত্র শিল্পের ভাবধারাকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা অনুমান করি মিশ্র বৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পটুয়া জীবনকে মুক্তিপ্রদান করার লক্ষ্যে সবাইকে আরো সচেষ্ট হওয়া দরকার। এই বাংলার পটুয়াগণ যে মূলত পট শিল্পী হয়েও অন্যান্য বৃদ্ধি গ্রহণ করেছিলেন সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। পটুয়া দের বিভিন্ন বৃত্তির পরিচয় নিম্নে বর্ণনা করা হলো---

     ১) পটচিত্র লিখনঃ  সুপ্রাচীনকালের  পার্বত্য গাত্রের গুহাচিত্র অঙ্কন করা ছেড়ে আদিম মানুষ যখন সমতল ভূমিতে অবতরণ করেছিলেন তখন তাঁদের জীবন জীবিকার একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায় ছিল পটচিত্র লিখন করে তৎ সংশ্লিষ্ট পটচিত্রগীতি জনসমক্ষে প্রদর্শন করা। জনসমক্ষে পট চিত্রগীতি প্রদর্শনের জন্য পটুয়া শিল্পীগণ প্রথমে পটচিত্রের কাহিনী হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন বুদ্ধদেবের জাতক কাহিনী গুলিকে। সেই কাহিনীগুলিকে পট চিত্রের পরিপূরক হিসেবে পটুয়া গন ছন্দাকারে রূপ দিতেন, যাকে বলা হত 'পটচিত্রগীতি'। আর সেই কাহিনী নির্ভর পটচিত্র গুলিকেই বলা হত দীঘল পট  বা জড়ানো পট। তারও পরে অর্থাৎ যখন মহাভারত রচিত হলো তখন পটুয়াগন তাদের পটচিত্রগীতির কাহিনী রূপে, মহাভারতের কাহিনী গুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আরো অনেক পরে অর্থাৎ মধ্যযুগে যখন রামায়ণ রচিত হলো তখন যুগোপযোগী করে তুলতে তৎকালীন পটুয়াগন রামায়ণের খন্ড খন্ড কাহিনীগুলি কে পট চিত্রগীতির বিষয়বস্তু রূপে বেছে নিয়েছিলেন। আমাদের ভারতবর্ষে 'রামায়ণ' ও 'মহাভারত' এমনই ধর্মীয় ভাবসঞ্জাত মহাকাব্য যে, এই রামায়ণ মহাভারতের শান্তি-সুধা রস গ্রহণ করার জন্য মানুষ  উন্মুখ হয়ে থাকেন। বাঙালির জনজীবনে এই কাহিনীগুলি যে চিরশাশ্বত তা এই অশিক্ষিত পটুয়াগন বুঝেছিলেন। সে কারণে আমাদের মনে হয় বংশপরম্পরাগতভাবে বর্তমান পটুয়া সমাজের উপর এই মহাকাব্য গুলির কাহিনী নির্ভর পটচিত্র গীতি ঐতিহ্যশালী রূপে প্রবাহিত হলেও ভগবান বুদ্ধের জাতক কাহিনী গুলি বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ ঘটনাবলী, ইতিহাস নির্ভর, সমাজ সচেতনতামূলক, আত্ম সচেতনতামূলক ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাহিনী গুলি পটুয়া দের ফটো চিত্রে খান দখল করলেও ধর্মীয় ভাব নির্ভর সেই মহাকাব্য গুলির কাহিনীগুলি ও সমমর্যাদা পায়। প্রাচীনকাল থেকে দীর্ঘ কাহিনীবহুল দীঘল পট বা জড়ানো (scroll) পটচিত্র গুলির প্রস্থে মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ ছিল, কিন্তু বিষয়বস্তু ও কাহিনী অনুযায়ী দৈর্ঘ্যে কোন নির্দিষ্ট পরিমাপ ছিল না। পূর্বের পটচিত্র গুলির চওড়া হতো ২০-২২ ইঞ্চি, বর্তমানে পটের শ্রেণীবিভাগ করলে বোঝা যায় এগুলি 'বড় আড়াপট'। দৈর্ঘ্যে কাহিনী অনুসারে দিঘল পটচিত্র গুলি সাধারণত ১৫-২০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে, আবার বৃহৎ কাহিনী অনুযায়ী কোন কোন ক্ষেত্রে পটচিত্রের দৈর্ঘ্য আরো বেশিও হতে পারে। 

🍂
ad

          এই দীঘল পটচিত্র গুলি পটুয়া শিল্পীরা গ্রামেগঞ্জে গীত সহযোগে পালা আকারে উপস্থাপন করতেন । গ্রাম্য পল্লীসমাজের বেশিরভাগ মানুষ গভীর মনোযোগ সহকারে (With attention) চিত্র অবলোকন করার সাথে সাথে শ্রবণ করতেন পটুয়াদের দ্বারা পরিবেশিত গীত, যা প্রত্যেকটি চিত্রের অনুকরণে রচিত হতো। পটুয়াদের 'পটচিত্রগীতি'র কথাগুলির মধ্যে প্রভূত পরিমাণ কবিত্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা স্বভাবজাত কবির মতো হাস্য, মধুর, করুন প্রভৃতি রসের সঞ্চার ঘটিয়ে সুরের সঙ্গে গীতের কথাগুলি প্রয়োগ করে সাবলীল ভাবে গাইতে থাকেন পটচিত্রগীতি। আর তাতেই মানুষের অন্তরে রসঘন ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়ে মন প্রাণ উদ্বেলিত হত। তাই গ্রাম গঞ্জের মানুষ, পটুয়া শিল্পীদের মনমুগ্ধকর(Mind charming) শিল্প সৃষ্টিতে খুশি হয়ে আনন্দাপ্লুত অন্তরে তাঁদের দান করতেন চাল, টাকা, পয়সা ও পরিধেয় পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি ইত্যাদি। এইভাবে নিপুন দক্ষতায় পটচিত্র লিখন করে গীত সহযোগে পটচিত্রগীতি লোক সমাজে প্রদর্শন করে অর্থ উপার্জন করা পটুয়া সমাজের মূল বৃত্তি হলেও এর দ্বারা পটুয়াদের অর্থ সংকুলান সম্ভব হত না। ফলে তাঁরা শিল্পী হয়েও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে হরেক বৃত্তি গ্রহণ করে সেই আদিকাল থেকে এ যাবৎ কোনরকমে দিনাতিপাত  করছেন।

         ২)ঘট চিত্র অংকন (Pot pictur painting)ঃ- হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পার্বণ পিঠোপিঠি লেগেই থাকে, আর পূজা পার্বণের জন্য এই বাংলার জনজীবনে ঘটের প্রয়োজনীয়তা সর্বজনবিদিত। ঘটের উপরও চিত্র অঙ্কন করে সুসজ্জিত করার রীতি আদিকাল থেকেই পরিলক্ষিত হয়। ঘট শব্দের সাধারণ অর্থে মানুষ যা বোঝেন, তা হল মাটির তৈরি ছোট কলস। কুমোর জাতির মানুষ কাঁচা মাটি দিয়ে তাদের হাতের কৌশলে চাকের দ্বারা ছোট বড় বিভিন্ন গড়নের কলস তৈরি করে, পরে সেগুলো পুড়িয়ে নেয়। সেই কলসের উপর রঙ-তুলি দ্বারা সুশোভিত চিত্রে চিত্রিত করে তোলার কাজ টি পটুয়ারাই করেন। যেমন- দ্বার ঘট, লক্ষ্মী ঘট, মঙ্গল ঘট, মনসার ঘট প্রভৃতি এই জাতীয় পূজা পার্বণের ঘট গুলি পটুয়ারাই অংকন করেন। এই ঘটচিত্র অংকন আবার তিন ধরনের হত। প্রথমত ঃ ধর্মীয় ভাবের উপর নির্ভর করে এক ধরনের ঘটচিত্র অংকন করা হতো, এই ধরনের ঘট গুলি সাধারণত আকারে- প্রকারে কলসির মতো নয়, কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির এক ধরনের মাটির পাত্র মাত্র। আমাদের দেশে 'মনসার ঘট' একটি বহুল প্রচলিত নাম। মা মনসা প্রতিমার পরিবর্তে মনসা দেবীর প্রতীক রূপে এই ঘটকেই মানুষ পূজা করেন। পটুয়ারা এই ঘটে রঙের বৈচিত্র এনে ঘট চিত্রটিকে আকর্ষণীয় করে তোলেন, এটিকে বলা যায় দেব ঘট বা দেবী ঘট। দ্বিতীয়তঃ আর এক ধরনের ঘট আছে যাকে এক কথায় বলা যায় জীবন রসাত্মক ঘটচিত্র। যেমন-শ্রীরাধার মানভঞ্জন, নৌকা বিলাস, কলঙ্কিনী রাধা প্রভৃতি এই ধরনের জীবন কাহিনী মূলক ভাবের চিত্রগুলি পটুয়াদের দ্বারা এই ঘটচিত্রে ফুটে উঠত। তৃতীয়ত ঃ-আমরা বলতে পারি দ্বার ঘট বা মঙ্গলঘট, এই ধরনের ঘটচিত্র গুলি সাধারণত পূজা মন্ডপ সাজাতে কিংবা বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজাতে প্রয়োজন হয়। এই দ্বারঘটচিত্রে পটুয়ারা ফল, ফুল, পাতা ও গাছপালার বিভিন্ন চিত্রগুলি তাদের লালিতময় তুলির টানে ফুটিয়ে তোলেন। তাছাড়াও কিছু লোকো শিল্প অনুরাগী ও লোকসংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ ঘর সাজানোর জন্যও পটুয়াদের এই ঘটচিত্রগুলিকে ব্যবহার করেন।

          উপরে উল্লেখিত পূর্বের এই দুই প্রকারের ঘটচিত্র অর্থাৎ দেবঘট ও জীবন রসাত্মক ঘট চিত্র আজ আর দেখা যায় না বললেই চলে। তবে, বর্তমানের পটুয়ারা যে ঘটচিত্র অংকন করেন সেগুলি কেবলই লোকসংস্কৃতি প্রেমী মানুষজনই ব্যবহার করেন, তা ঘর সাজাতে হোক বা অনুষ্ঠান মঞ্চ সাজাতেই হোক। এই দ্বার ঘট বা মঙ্গল ঘটে বর্তমানের পটুয়ারা কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। পূর্বের মত তেল সিঁদুর দ্বারা আলপনা দেওয়া বা স্বস্তিকা দি আলপনা করা বর্তমানের পটুয়ারা করেন না। বর্তমানের দ্বার ঘট বা মঙ্গল ঘটে স্থান পেয়েছে পটুয়াদের নিপুন শিল্প শৈলী, গাছপালা, লতা পাতা, ফল ফুল, আদিবাসী নৃত্য ও মাছের বিয়ে ইত্যাদি। এইভাবে ঘটচিত্র অংকন করেও পটুয়ারা সারা বছর কাজ পাচ্ছেন না, ফলে পটুয়া দের অর্থনৈতিক সংকটও দূরীভূত হয় না।

        ৩) চালচিত্র অংকনঃ- (Back ground painting) আদিকাল থেকেই পটুয়াদের একটি শ্রেণি হিন্দু সমাজের পূজার জন্য দেব দেবীর প্রতিমা গড়তেন। তাঁরাই আবার চালচিত্রও অংকন করতেন। সাধারণত দেবী প্রতিমার মাথার উপর এক ধরনের চাল বা আচ্ছাদন বা পাটাতন প্রস্তুত করা হয়, এবং তারই উপর অঙ্কিত চিত্রকে চালচিত্র বলা হয়। শারদীয়া উৎসবে দুর্গা প্রতিমার মাথার উপর নির্মিত ছাদ বা চালকে বলা হয় 'দেবীচাল'। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে পটুয়ারা এই দেবীচাল অংকন করেন। এই দেবী চাল কেই বলা হয় 'চালচিত্র'। বর্তমানে এই চালচিত্র শিল্পের প্রতি দর্শকেরও শ্রদ্ধা বা চাহিদা কমে গেছে বললে চলে, ফলে বর্তমানে চালচিত্র শিল্পের চাহিদা না থাকায় ক্রমে ক্রমে শিল্পটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। হাতে গোনা যে কয়েকজন শীল্পী চালচিত্র অঙ্কন করতেন তাঁরাও অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন।

       এছাড়াও মিশ্র বৃত্তি গুলোর মধ্যে ছিল কুলাচিত্র অংকন, দেয়াল চিত্র অংকন, পিঁড়ি চিত্র অংকন, সরাচিত্র অঙ্কন, সাপুড়ে বৃত্তি প্রভৃতি। এত বৃত্তি গ্রহণ করেও এই বাংলার পটুয়ারা অদ্যাবধি অর্থ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

Post a Comment

0 Comments