জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান -২০/ তুলসীদাস মাইতি

হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব-২০

তু ল সী দা স  মা ই তি


রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক বাংলাগান:
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেন

"বর্তমানে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল,
রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান এক একটা পৃথক শ্রেণিবদ্ধ গান হিসেবে পরিচিত। আধুনিক গান বলতে যা বোঝায় তা উত্তর তিরিশ থেকে লেখা বিভিন্ন গীতিকারদের গান। আর আজ গীতিকার ও সুরকার সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে গেছেন। উপরোক্তদের মতো একই লোক গীতিকার ও সুরকার এমন লোকে সংখ্যা  নগণ্য" প্রভাতকুমার গোস্বামীর লেখা এই কথাগুলি ধরেই আমরা রবীন্দ্র সম-সময়ের বাংলা গানের আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আমরা এ যাবৎ বিস্তর আলোচনা করছি। তাঁর সময়ে বাংলা গানের জগৎ যে একটা সুবর্ণময় যুগে উত্তীর্ণ হয়েছিলো তা বলাই বাহুল্য। সমকালে তিনি ছাড়া বাংলা গানের জগতে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণভাবে অবদান রেখে গেছেন তাঁদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও কাজী নজরুলের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলা গানের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও নজরুলের গানকে অনেকেই 'পঞ্চকবির গান' বলে অভিহিত করেছেন। পাঁচজনই যত বড়ো কবি ছিলেন ঠিক তত বড়োই সংগীত স্রষ্টা।  ইতিপূর্বে (আগের পর্বগুলিতে) রবীন্দ্রনাথের গান প্রসঙ্গে  আলোচনা হয়েছে তাই আমরা বাকিদের গানে আলোকপাত করতে চাই। 

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে বয়সে দুবছরের ছোটো দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি ও সংগীতের জগতে এক অনন্য যোজনা। বাংলা গানে আধুনিকতার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা যাদের গানে প্রথম ফুটেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। কবি, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক যাই বলিনা কেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মনের আনন্দেই সংগীত রচনা ও তাতে সুরসংযোজনা করেছেন। অন্তরের আবেগ দিয়ে গেয়েছেন শতশত গান। প্রাণের টানে বলেছেন-
              মিছে তুই ভাবিস মন-
              ও তুই গান গেয়ে যা গান গেয়ে যা 
              আজীবন। 
তিনি গানের জন্যও গান রচনা করেছেন আবার নাটকের জন্য গান সৃষ্টি করেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত নাটকের মধ্যে যে গান আছে সেই গান গুলির বেশির ভাগই স্বতন্ত্র গান হিসেবে গাওয়া হয়ে থাকে। ধ্রুপদাঙ্গের গানের সঙ্গে খেয়াল অঙ্গের গানের বিচিত্র রূপ আছে তাঁর গানে। অজস্র গানে তিনি দেশি সুরের সাথে বিলিতি সুর মিশিয়ে সংগীতে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছেন।  বাংলা লোকায়ত গান কীর্তন বাউল প্রভৃতি লোকগানের ধারায় বিদেশি গানের সুর যোগ করে সংগীতে এক ব্যতিক্রমী রূপ এনেছেন। রবীন্দ্রযুগে  সংগীত সৃষ্টি করেও তিনি স্বতন্ত্র হতে পেরেছেন। তাঁর সৃষ্ট স্বদেশীসংগীত ও হাসির গান বাংলা গানের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ।

প্রকাশক শরৎকুমার লাহিড়ীর উদ্যোগে ১৮৮২ সালে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম গ্রন্থ 'আর্য্যগাথা' প্রকাশিত হয়। এগুলি আসলে গান। এখানে প্রকৃতি ও স্বদেশ এই বিষয়গুলো গভীর ভাবে প্রকাশিত দেখি অল্পবয়সেই।  নিজেই উল্লেখ করেছেন-

"..... ১২ বৎসর বয়ক্রম হইতে আমি গান রচনা করিতাম। ১২ বৎসর হইতে ১৭ বৎসর পর্যন্ত আমার গীতগুলি ক্রমে 'আর্য্যগাথা' নামক গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়।" 

কাব্যধর্ম ও সংগীতধর্ম এখানে একাকার হয়ে গেছে। তিনি নিজেই বলেছেন-"আর্য্যগাথার সকল গীত কবিতার ছন্দোবন্ধেই প্রায় রচিত হয়েছে। কিন্তু ইহার প্রতি গীতই সম্পূর্ণ শাস্ত্রত সুরে গেয়। সংগীত স্বরে, কবিতা ভাষায়, একথা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু গাহিবার সময় প্রায়ই ভাষা ও স্বর মিলিত করি।"

'আর্য্যগাথা'-র প্রথম পর্বে প্রকৃতি বিষয়ক চুয়াল্লিশটি, ঈশ্বর বিষয়ক সাতটি, বেদনা-বিষাদ বিষয়ক কুড়িটি ও দেশপ্রেম বিষয়ক সাইত্রিশটি গান আছে। 'আর্য্যগাথা' দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল দশ বছর পর। এই গ্রন্থের দুটি অংশ 'কুহু' ও 'পিউ'। প্রথম অংশটি মৌলিক আবেগ মথিত বাংলা গান। দ্বিতীয় অংশটি স্কচ ও আইরিশ গানের অনুবাদ। 'কুহু'-র গানগুলিতে রাগরাগিনীর চলন রোমান্টিক রসে সিঞ্চিত। এ পর্যায়ে ১৫৮ টি গান আছে। 'পিউ'-তে আছে স্কচ গানের অনুবাদ ১৪ টি, ইংরেজি গানের অনুবাদ ১৫ টি, ও আইরিশ গানের অনুবাদ ৭ টি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই মিলে অনবদ্য। 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গান এর অনেকটাই প্রহসন ব্যবহৃত। তাঁর 'হাসির গান' সংকলনে সাতাত্তরটি গান আছে।  ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, সামাজিক, দার্শনিক প্রভৃতি নানাবিধ ভাবনার গান এখানে আছে। গানগুলিতে শ্লেষ আছে, কৌতুক আছে, অনুকম্পা ও সমবেদনাও আছে। কবিপুত্র দিলীপ রায় 'গান' শীর্ষক একটি দ্বিজেন্দ্রগীতি পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন। এবং দ্বিজেন্দ্রলালের অপ্রকাশিত গানগুলি যেমন ভারত আমার, সাধের বীণা, বঙ্গভাষা প্রভৃতি এই পুস্তকে যুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর স্বদেশপ্রেমের গানগুলি কালজয়ী হয়ে আছে। তাঁর এই পর্যায়ের গানগুলি অদ্ভুত ওজস্বী ও প্রসাদগুণ সম্পন্ন বলে এত মূল্যবান। তাঁর যে গানগুলি অত্যন্ত প্রিয়তা লাভ করেছে সেগুলির মধ্যে 'ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে', 'ধনধান্য পুস্পভরা', কিসের শোক করিস ভাই, 'বঙ্গ আমার জননী আমার', 'যেদিন সুনীল জলধি হইতে', 'আজি গো তোমার চরণে', 'জননী' প্রভৃতি গান গুলি উল্লেখযোগ্য।

বাংলা গানের ইতিহাসে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে রজনীকান্ত (১৮৬৫- ১৯১০) এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। পেশায় উকিল ছিলেন। তবে ছোট থেকেই তিনি সংগীত রচনা কাব্য রচনায় নিয়োজিত ছিলেন। রাজশাহীতে থাকাকালীন তিনি 'উৎসাহ' পত্রিকায় নিয়মিত গান লিখতেন। অক্ষয় কুমার মৈত্র তাঁকে উৎসাহ দিয়েছেন এই কাজে। ১৯০২ তে তাঁর 'বাণী' ও তিন বছর পরে  'কল্যাণী' গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হলে তিনি পাঠক মহলে সমাদৃত হন। বই দুটিতে ছিল ভক্তিগীতি, প্রেমগীতি, দেশাত্মবোধক ও হাস্য রসাত্মক নানাবিধ সংগীত। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই গান মানুষের মধ্যে প্রচারিত ছিল সর্বাধিক। ১৯০৯ সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। ওই সময় তিনি হাসপাতাল ও অসুস্থতাকে সঙ্গী করেই 'অমৃত', 'আনন্দময়ী', ও  'অভয়া' নামে তিনটি কাব্য  রচনা করেন। 'কান্তকবি 'নামে পরিচিত রজনীকান্ত দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। তা সত্ত্বেও তাঁর সংগীত স্বকীয় প্রভিভায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁর গানের কথা ও সুরের সাবলীল প্রকাশ পাঠক ও শ্রোতাকে স্নিগ্ধ, শান্ত করে। ছন্দের চমৎকারিত্বে, নির্মেদ অলংকারের বিন্যাসে তাঁর সংগীত মুগ্ধ করেছে। বাংলা কীর্তন-বাউল সহ লোকায়ত সুর সহজ ভাবে প্রকাশিত। 'তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে','কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাবো', 'কতভাবে বিরাজিত বিশ্বমাঝারে', 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই', প্রভৃতি গানগুলিতে তাল ও ছন্দের অপূর্ব ব্যবহারেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে

কান্তকবির গানগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা জয়ে থাকে। 

এক। ভক্তিগীতি:
এই প্রকার গানগুলি উৎকৃষ্টতায় মাত্রা পেয়েছে। বাংলা সাধন সংগীতের ধারার সাথে তার এই শ্রেণির গানগুলিকে যুক্ত করা যায়। বাঙালির একান্ত ভালোলাগার আগমনী ও বিজয়ার গানও তিনি সৃষ্টি করেছেন। 

দুই। স্বদেশী গান:
দেশের প্রতি অগাধ টান থেকেই তিনি এ জাতীয় সংগীত রচনা করেন। কিছু কিছু দেশপ্রেমের গান কালজয়ী হয়ে উঠেছে। তাঁর 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, 'নমো। নমো নমো জননি বঙ্গ!/ উত্তরে ঐ অভ্রভেদ্য, অতুল বিপুল গিরি অলঙ্ঘ।' প্রভৃতি গানগুলি এ পর্যায়ের অপূর্ব নিদর্শন।

তিন। হাসির গান:
দ্বিজেন্দ্রলালের মতোই রজনীকান্ত বহু হাসির গান রচনা করেন। যদিও আজকাল তাঁর এই ধরণের গান শোনা যায় না। সংগীতশিল্পী নলিনিকান্ত সরকার এই ধরণের গান গাইতেন। পরে বহু শিল্পী রজনীকান্তের সংগীত পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর 'যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে রত পানতোয়া শত শত', 'যেহেতু  আমরা হ্যাটে ঢাকি টিকি' প্রভৃতি গানগুলি এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। 

তাছাড়া প্রেম ও প্রকৃতির গানেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

অতুলপ্রসাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের লেখা। রবিঠাকুরের পাণ্ডুলিপি থেকে। 


অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৪২) রবীন্দ্রনাথের থেকে দশ বছরের ছোটো। রবীন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রলালের মতো বহু সংখ্যায় গান তিনি রচনা করেননি। কিন্তু বাংলাগানের জগতে তাঁর বিশেষ একটি স্থান আছে। ভাব ও সুরের ঐক্যের দিক থেকে রবীন্দ্রসংগীত ও অতুলপ্রসাদের গান কাছাকাছি। তবে পার্থক্যও অনেক। রবি ঠাকুরের গানে আছে প্রার্থনা অতুলপ্রসাদে আছে প্রণাম। পন্ডিতরা মনে করেন রবিঠাকুরের গান যদি হয় অভিজাত পরিবারের ঘরণী অতুলপ্রাসাদের গান তবে পল্লীবধূ। 

তিনি লখনৌতে ছিলেন। এখানে বিভিন্ন প্রকারের সংগীত রচনা করেছিলেন অতুলপ্রসাদ। তাঁর গানগুলি 'কাকলী', 'কয়েকটি গান', এবং 'গীতিগুচ্ছ' এই তিনটি বইতে পাওয়া যায়। যদিও আরো কিছু গান আছে মনে করা হয়ে থাকে। প্রেম গীতি, স্বদেশগীতি, রাগপ্রধান প্রভৃতি পর্যায়ের গান লেখেন তিনি। ধ্রুপদাঙ্গের গান ছাড়াও টপ্পাও ঠুমরি পর্যায়ের গান তিনি সৃষ্টি করেছেন। এই পর্যায়ের গানে তিনি জনপ্রিয় হন। 'তবু তোমারে ডাকি বারে বারে', 'কাঙাল বলিয়া করিও না হেলা', 'মুরলি কাঁদে রাধে রাধে'- এ সমস্ত গানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ বোঝা যায়। 

অতুল প্রসাদের স্বদেশী গানগুলির প্রসঙ্গ আনতেই হয়। 'বলো বলো বলো সবে', 'উঠো গো ভারতলক্ষ্মী', 'হও ধরমেতে ধীর' প্রভৃতি গানগুলি বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি বহু পল্লীসঙ্গীতও রচনা করেছেন। বাউল, কীর্তনসহ সব রকমের গানের অনুসরণে। তাঁর সব গানই 'সুর ও ভাবের উৎকর্ষে অতুলনীয়।

অতুলপ্রসাদের কাছের মানুষ পাহাড়ী সান্যাল তাঁর 'মানুষ অতুলপ্রসাদ' গ্রন্থে বলছেন, "সারাজীবনে মাত্র দুশো সাতটি গান লিখেছেন অতুলপ্রসাদ। তার প্রায় সবকটি ব্যক্তিজীবনের নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা থেকে জেগে ওঠা। … এসব গানের কথা একাকীত্বের জাতক, এবং সুর বাংলার কীর্তনের আসর আর উত্তর ভারতীয় মেহফিল থেকে চারিয়ে যাওয়া।"
(চলবে)

Post a Comment

0 Comments