জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৩/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৩

শ্যামল জানা

কিউবইজম

কিউবিজম-এর অন্যতম স্রষ্টা পিকাসোর একটি কথা দিয়ে শুরু করি—
“Cubism is not a reality you can take in your hand. It’s more like a perfume, in front of you, behind you, to the sides, the scent is everywhere but you don’t quite know where it comes from.” 
কিউবিজম ব্যাপারটা কী? পিকাসোর এই অসাধারণ উক্তিটি এক কথায় বোঝার পক্ষে চমৎকার! আমরা যদি উক্তিটিকে আরও ছোট করে শুধুমাত্র প্রথম চারটে শব্দ নিই— “Cubism is not a reality’— এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা৷

১৯০৬ সালে এক্সপ্রেশনিজম-এর সূত্রপাত ঘটে৷ ঠিক এর পরে পরেই কিউবিজম-এর জন্ম হয় ১৯০৭ সালে৷ কিন্তু আমরা মাঝখানে ফিউচারিজম(১৯০৯) ও ভোর্টিসিজম(১৯১৪)-এর কথা বলে নিয়েছি৷ কারণ, এক্সপ্রেশনিজম ফিউচারিজম ও ভোর্টিসিজম, এই তিনটি ইজম সরাসরি যুক্ত ছিল যুদ্ধ ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে৷ তাই যুদ্ধ সংক্রান্ত ছবি ও বিষয়ের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য এই তিনটি ইজমকে পরপর রাখা হয়েছিল৷

বিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপীয় চিত্রকলায় বিধি-নিষেধ, নিয়ম, রীতি-নীতি-ব্যাকরণের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ মূলত প্রথম শুরু হয়েছিল ইম্প্রেশনিজম থেকে, তার প্রথম লক্ষণটাই ছিল এই কনভেনশনের বিরুদ্ধে। আর, যে কোনো বিদ্রোহই, সংঘঠিত হওয়া মানে, ওইখান থেকেই যে সেটি শুরু হল, তা একেবারেই নয়! ভিতরে ভিতরে মনের গহীনে প্রথমে অসন্তোষ জন্মায়৷ তারপর সেই অসন্তোষ ভিতরে ভিতরে বাড়তে থাকে৷ এক থেকে বহু হয়৷ এক সময় কন্ডিশন তৈরি হলে বিদ্রোহ আকারে ফেটে বেরোয়৷ অনেক সময় কন্ডিশনের অভাবে তা প্রলম্বিত হয়৷ কেউ একজন বা কোনো গোষ্ঠী প্রথম বিদ্রোহ ঘটিয়ে ফেললে, সংক্রামক রোগের মতো পরপর, একই ক্ষেত্রে, একটার পর একটা বিদ্রোহ ঘটতে থাকে৷ এক্ষেত্রে তাইই ঘটেছিল৷ ইম্প্রেশনিস্টরা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণার সাথে সাথে পরপর একটার পর একটা বিদ্রোহ ঘটতে থাকল৷ আমরা সেগুলি ধারাবাহিকভাবে জেনেছি৷ সে সব ছবিগুলি বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে নিজস্ব দর্শন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু আমূল পরিবর্তন ঘটেনি৷ এই প্রথম কিউবিজম-এ এসে তা ঘটল৷ 
লুডো খেলেনি বা দেখেনি, এরকম মানুষ নেইই বলা যায়৷ লুডোতে চাল দেওয়ার জন্য যে ছক্কাটি ব্যবহার হয়, ওটি আক্ষরিক অর্থে একটি ঘনক(Cube)৷ এই ইংরাজি কিউব থেকেই কিউবিজম কথাটি এসেছে৷ বাংলায় যাকে বলে ঘনকবাদ৷ আর, লুডোটি দ্বিমাত্রিক হলেও ছক্কাটি হয় ত্রিমাত্রিক৷ কিউবিস্ট শিল্পীরা কোনো বাস্তবের দৃশ্যকে ক্যানভাসের ওপর অজস্র ঘনকের মাধ্যমে আঁকার চেষ্টা করতেন(ছবি-১)৷ 
ইউরোপীয় চিত্রশিল্পের ইতিহাসে চোদ্দশো শতকে রেনেসাঁস-এর সূত্রপাতের সময় থেকেই ছবিতে জ্যামিতিক আকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়, বিশেষ করে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সময় থেকে৷ সেই সময় থেকেই শিল্পীদের ছবির কম্পোজিশনগুলো হত বিভিন্ন ধরনের কতগুলো জ্যামিতিক  আকৃতিকে কাঠামো করে৷ এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাই বিবর্তিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত(Finally) পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso) আর জর্জেস ব্রাকের (Georges Braque) কিউবিস্ট ছবিগুলিতে চূড়ান্ত রূপ পেল৷ সেই জ্যামিতিক প্যাটার্নই হয়ে উঠল মূল ছবি। এর জন্যে বস্তুর যে বাস্তব রূপ, তার শুধু বিমূর্ত আভাসটুকুই অনেক ছবিতে এসেছে৷ অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাকে বিকৃতও করতে হয়েছে৷ এমনকি সরাসরি অস্বীকারও করা হয়েছে কোনো কোনো ছবির ক্ষেত্রে। তাঁরা সম্পুর্ণভাবে শুধুমাত্র জ্যামিতিক আকার-আয়তনের সমাবেশ ঘটিয়ে কোনো বিশেষ বস্তুর ঘনত্ব, বা তার ভেতর ও বাইরের রূপ এবং ত্রি-মাত্রিকতার প্রয়োজনে তার প্রতিটি পার্শ্বরূপ, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই সঙ্গে একই ছবিতে প্রয়োগ করলেন৷ এ ভাবেই এই কিউবিজম শিল্পধারার সূচনা ঘটল। এভাবে আঁকার জন্য ছবিতে আর সমতল ক্ষেত্র থাকল না৷ বিভিন্ন তলে ভাগ হয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল। এই যে তাঁরা সকল বস্তুকে খন্ডিতভাবে দেখেছেন, কারণ তাঁরা বলতেন – Everything is ‘still life.৷ আর ওই খণ্ডগুলির মধ্যে তাঁরা যুক্ত করলেন বিভিন্ন মাত্রায় আলোছায়া এবং জ্যামিতির পৌনঃপৌনিক ব্যবহার৷ যার মধ্য দিয়ে এক নতুন আঙ্গিকের ছবি সৃষ্টি হল, যা চিত্রশিল্পের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি(ছবি-২)! 

কিউবিজম চিত্র-আন্দোলনকে এক কথায় বললে বলতে হয়— দ্বি-মাত্রিক পটভূমিতে, বিশেষ করে ক্যানভাসে, ত্রি-মাত্রিক জ্যামিতিক ফর্মের দৃঢ় আয়োজন৷ তাঁরা ঐতিহ্যবাহী নিখুঁত শিল্পকলা সৃষ্টিতে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না৷ তাঁরা কোনো বাস্তবধর্মী দৃশ্যকেও কিউবিজম-এর প্রশ্নে নানারকম জ্যামিতিক আকারে বদলে নিতেন। ফলে, বিষয়বস্তুর যে বাস্তব রূপ, তা যথাযথ প্রকাশই পেত না! তাই, এই ধারাতে শিল্পীর ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশের(Personal touch) সুযোগ প্রায় থাকতই না!
প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে যে নিজস্ব অন্তর্নিহিত কাঠামোগত কাঠিন্য আছে, তা কিউবিস্ট শিল্পীরা ছবিতে ধরার চেষ্টা করলেন। এটা কিউবিজম-এর অন্যতম প্রধান দিক। তাঁরা প্রত্যেক বস্তুকে জ্যামিতিক কাঠামোর মাধ্যমে ছবিতে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। ফলে, সার্থকভাবেই তাঁরা তাঁদের ছবিতে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁরা বিষয়বস্তুকে প্রথমে বিশ্লেষণ করতেন৷ তারপর তাকে ভেঙে ভেঙে ছবিতে উপস্থাপন করতেন। তবে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে গণিতের সাহায্য নিয়েই তাঁরা তাঁদের ছবিকে ভাঙচুর করতেন৷ এভাবে ভাঙতে গিয়ে দেখা গেছে তাঁদের ছবি থেকে রং প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। 

          
বিশেষ করে পিকাসো বা ব্রাক, এঁরা বিষয়বস্তুকে ছবিতে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যে তাঁদের যুক্তিটাই যেন প্রধান৷ ফলে, এঁদের দুজনের প্রথম দিকের কাজগুলোতে দেখা যায় তাঁরা প্রায় একই বিষয়বস্তু নিয়ে একইভাবে ভেঙেছেন এবং রঙের প্রাধান্যকে পুরোপুরিই বর্জন করেছেন(ছবি-৩)।
 (ক্রমশ)
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments