জ্বলদর্চি

লাল পোশাকের বুড়ো সান্টাক্লজ/ মুক্তি দাশ

লাল পোশাকের বুড়ো সান্টাক্লজ

মুক্তি দাশ


পঁচিশে ডিসেম্বর অর্থাৎ বড়দিনে ঈশ্বরপুত্র মহান পরিত্রাতা যিশুর আবির্ভাব দিবসের এক পরমলগ্নে শিশুদের আশা-আনন্দে ভরা উচ্ছল চোখের নাগালে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে যায় লালটুপি ও পোশাক পরিহিত শ্বেতশ্মশ্রুতে ঢাকা মুখাবয়বের সেই বৃদ্ধ – সান্টাক্লজ। মজাদার সব উপহার বিতরণ করে অবলীলায় শিশুহৃদয় জয় করে নেয় এক লহমায়। যদিও পঁচিশে ডিসেম্বর তারিখটি যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবেই নির্দিষ্ট তবু এই পুণ্যদিনে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের সংগে সংগে উপহার বিনিময়ের যে প্রথা বা রেওয়াজ বহুকাল যাবৎ চলে আসছে তা এই সান্টাক্লজের কাহিনীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই। অথচ যিশুখ্রিস্টের সংগে সান্টাক্লজের কাহিনী সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন। 

সান্টাক্লজের আকৃতি ও বেশভূষা কল্পনারঞ্জিত হলেও স্বয়ং সান্টাক্লজ কিন্তু আদপেই কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়। তৃতীয় শতাব্দীর শেষার্ধে প্রাচীন এশিয়া মাইনরের ‘লিডিয়া’ নামক শহরে সান্টাক্লজের জন্ম। আসল নাম : সেন্ট নিকোলাস। সান্টাক্লজ সেন্ট নিকোলাসেরই বিবর্তিত নাম।

নিকোলাসের বাবা যথে্ষ্ট সঙ্গতিপন্ন মানুষ। অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক। অভাবনীয় ঐশ্বর্য ও বিলাসিতার মধ্যে দিন কাটে তাঁর। অথচ এমন রাজকীয় চালচলনে অভ্যস্ত মানুষের সন্তান হয়েও নিকোলাস সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির। ধন-সম্পত্তিতে ঘোর অনীহা। অতি সাধারণ আটপৌরে তাঁর জীবনাচরণ। এবং ভীষণভাবে ধর্মাসক্ত। গরীবদুঃখীদের জন্যে সদাব্যথিত প্রাণ। ধনীপুত্র নিকোলাস ইচ্ছে করলেই বাড়িতে চর্বচোষ্য খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারেন। কিন্তু দীন-দরিদ্রের সমব্যথী নিকোলাস তাঁর জন্যে বরাদ্দ যাবতীয় লোভনীয় আহার্য নির্লিপ্তভাবে সরিয়ে রেখে একবেলা স্বল্পাহারেই সন্তুষ্ট থেকেছেন।

নিকোলাস একদিন শুনতে পেলেন, তাঁরই এক প্রতিবেশি নিতান্তই অভাবের তাড়নায় নিজের তিন তিনটি বিবাহযোগ্যা কন্যাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে দিতে উদ্যত। বাপ হয়ে তিনটি মেয়েকে পাত্রস্থ করা দূরে থাক, দুবেলা দু’মুঠো আহার যোগাতেও যে অসমর্থ তার আর কী-ই বা করার আছে! 

নিকোলাস সব শুনে চুপটি করে রইলেন। কিন্তু যেদিন মেয়ে তিনটিকে হাটে বিক্রির জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে, সেইদিন প্রত্যুষে বাপ উঠে দেখল, কেউ যেন গভীর রাতে সবার অগোচরে খোলা জানলা গলিয়ে একটি মুখবন্ধ থলে ফেলে গেছে। থলের মুখ খুলে দেখা গেল, সোনার মোহরে ভর্তি। বাপ এবং তিন মেয়ে তো আনন্দে একেবারে দিশেহারা! তারপর মহাধূমধামে সেই হঠাৎ পাওয়া স্বর্ণমুদ্রাকে ভগবানের অশেষ করুণার দান বলে ধরে নিয়ে বাপ বেশ ভাল ঘরে-বরে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল।

পরে অবশ্য আসল রহস্যটা আর কারো জানতে বাকি রইল না। সবাই বুঝতে পারল, কে এই ‘ভগবান’। এ তো মহাপ্রাণ নিকোলাসেরই মহিমোজ্জ্বল কীর্তি! 

তদবধি কোনো অভাবগ্রস্ত কুমারী মেয়ে বিয়ের বয়েস হলে তখনকার মানুষ ঈশ্বরের বদলে সেন্ট নিকোলাসের কাছেই মনে মনে প্রার্থনা জানাতো একটি সুন্দর বর ও সুখী সংসারের জন্যে।

পিতার মৃত্যুর পর অগাধ সম্পত্তির মালিক হলেন নিকোলাস। এবং যাবতীয় অর্থ-সম্পদ তিনি দারিদ্র্য-পীড়িত মানুষের মধ্যে দ্বিধাহীনভাবে যথেচ্ছ বিলিয়ে অচিরেই নিঃস্ব হয়ে গেলেন। অবশ্য এই নিঃস্বতা কেবল আর্থিক বিচারে। মানসিক ঐশ্বর্যে তাঁর হৃদয় তখন একেবারে পরিপূর্ণ, টইটম্বুর।

খুব দ্রুত নিকোলাসের এই দেবোচিত কাহিনী দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। ইউরোপীয় দেশগুলিতেও নিকোলাস দেবতার মতো পূজিত হতে থাকলেন। নরওয়ের অধিবাসীরা তো এমনই তদ্গতভাবে প্রভাবিত হয়েছিল যে, পরবর্তীকালে তারা তাদের আরাধ্য দেবতার সঙ্গে নিকোলাসের আকৃতি মিশিয়ে ফেলেছিল। বরফের ওপর দিয়ে বল্গা হরিণ টেনে নিয়ে চলেছে একটি স্লেজগাড়ি এবং তার মধ্যে বরাভয় মূর্তিতে বসে আছেন সেন্ট নিকোলাস – নরওয়েবাসীরা এরকমই একটি দেবোপম মূর্তিকে কল্পনায় স্থান দিয়েছিল।

ক্রমে ওলন্দাজরাও ভয়ানক ভক্ত হয়ে পড়ল নিকোলাসের। শুধু কি তাই? সারা আমেরিকায় ধর্মপ্রাণ নিকোলাসের মহান কীর্তি ও মহানুভবতার কথা প্রচারিত হতে থাকল। ওলন্দাজরাই সর্বপ্রথম নিকোলাসের সাদা ঘোড়ায় চড়া কাল্পনিক মূর্তির উদ্ভাবক। ওলন্দাজরা আবার ‘সেন্ট নিকোলাস, (Saint Nicholas) শব্দটি উচ্চারণে পারঙ্গম ছিল না। কারণ, এই শব্দটি তাদের জিহ্বানুকূল নয়। সুতরাং তারা তাদের মতো করে উচ্চারণ করতো ‘সিন্টার ক্লস’ (Sinter Klaus)। এবং কালক্রমে আমেরিকানদের কাছে এসে এই ‘সিন্টার ক্লস’ই হয়ে গেল ‘সান্টা ক্লজ’(Santa Claus)।

যাইহোক, সান্টাক্লজ বা সেন্ট নিকোলাস মারা যান ৩৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর। সেইথেকে ৬ ডিসেম্বরই তাঁর মৃত্যুদিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। নিকোলাসের স্মরণে এই দিনটিতে ছোটবড় সবাই পরস্পরের মধ্যে নানা ধরণের উপহার বিনিময় করতো। পরে কিকরে এবং কবে থেকে যেন এই বিশেষ দিনটি বড়দিনের উৎসবের সংগে মিলেমিশে একাকার!

আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলুম। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete