জ্বলদর্চি

সংক্ষিপ্ত মহাভারত পর্ব-২/ সুদর্শন নন্দী


সংক্ষিপ্ত মহাভারত
পর্ব-২

সুদর্শন নন্দী

 
কুরুরাজ্যের রাজধানী হস্তিনাপুরের রাজা জন্মেজয়ের  পূর্বপুরুষ মহারাজ শান্তনুর সময় থেকে মহাভারতের মূল কাহিনী শুরু হয়। জন্মেজয় মহাভারত মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র। তিনি রাজা পরীক্ষিত ও রাণী মদ্রবতীর বড়ছেলে, অভিমন্যুর পৌত্র এবং অর্জুনের প্রপৌত্র। পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর তিনি হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসেন।

 শান্তনু গঙ্গাদেবীকে বিয়ে করেন ও পরপর সাত সন্তানের মৃত্যুর পর তাদের অষ্টম সন্তান দেবব্রত জন্মালে গঙ্গা অন্তর্হিত হন। মহাভারতের কাহিনী বলতে গেলে এসে যাবে অনেক পূর্বাপর ঘটনা। যা ঘটছে বর্তমানে, তাঁর পিছনেও রয়েছে কাহিনীর অতীত সূত্র। শান্তনু গঙ্গাকে বিয়ে করেন সেও তাঁর পিতা প্রতীপের ইচ্ছায় এবং তা ভীষ্মের পূর্বজন্মের পাপে। 

আমরা পড়েছি আটে অষ্টবসু । এই অষ্টবসু আটজন দেবতা। যার মধ্যে দেবতা দ্যু অন্যতম। তারা একদিন বেড়াতে বেড়াতে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমের দিকে আসেন।দ্যু-এর স্ত্রী মুনির প্রিয় গাই নন্দিনীকে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এবং সে গাই চুরি করে অষ্টবসু। পরে বশিষ্ঠ মুনি তা জানতে পেরে তাদের দিয়ে মর্ত্যে জন্মানোর অভিশাপ দেন। অনেক কাকুতি মিনতির পর ঠিক হয় দ্যু ছাড়া একবছরে বাকি সাতজন বসু মুক্তি পাবেন। এরপর তাঁদের অনুরোধে গঙ্গা রাজী হন তাঁদের মা হতে এবং মর্ত্যে শান্তনুর সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের শর্ত ছিল গঙ্গাকে তাঁর কাজে বাঁধা দিলে তিনি চলে যাবেন। তাই সাতটি বসুর পৃথিবীতে জন্ম নেবার পর তাঁদের ভাসিয়ে দিলেও অষ্টম পুত্রে বাঁধ সাধেন শান্তনু। শর্ত অনুযায়ী অষ্টম পুত্রের  জন্মের পর শান্তনুর হাতে তুলে দিয়ে চলে যান গঙ্গা। আর এই পুত্রই হলেন দেবব্রত, পরবর্তীকালের ভীষ্ম। দেবব্রত বিদ্যা ও বলে নিপুণ ছিলেন, তাই শান্তনু এঁকে যুবরাজ পদে বসান। এবার শান্তনুর দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলি। একদিন, শান্তনু মৃগয়ায় বনে যান,  তখন নদীর ধারে সত্যবতী  মৎস্যগন্ধা নামে এক পরমা সুন্দরী ধীবর কন্যাকে দেখতে পেয়ে তার কাছে বিবাহের প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু সত্যবতীর বাবা জানালেন, রাজার সাথে সত্যবতীর বিয়ে হলে সত্যবতীর পুত্রেরাই রাজ্যপাট পাবে, দেবব্রত নয়। শান্তনুর বিয়ে যাতে বাধা না পায় তাই পুত্র দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি কখনো সিংহাসনে বসবেন না। সত্যবতী অন্য আশঙ্কা করলে অর্থাৎ তার পুত্র হলে তারা সিংহাসনে বসবে, এই আশঙ্কায় তিনি বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা নেন । দেবব্রতর এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তিনি ‘ভীষ্ম’ নামে খ্যাত হন এবং ইচ্ছামৃত্যুর বর পান।
যাইহোক, শান্তনুর সাথে প্রথম স্ত্রী গঙ্গার সন্তান ভীষ্ম।আর দ্বিতীয় স্ত্রী সত্যবতীর দুটি সন্তান জন্মায় – চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। সত্যবতীর সন্তানের কথা উল্লেখহেতু পাঠককে জানাই যে পরাশরমুনির ঔরসে সত্যবতীর আরেকটি সন্তান ছিল যিনি বেদব্যাস, যে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এক বিশাল চরিত্র। সত্যি বলতে কি বিস্তারিত আলোচনায় গেলে মহাভারতের ভেতর ছোট ছোট আরও অসংখ্য মহাভারতের জন্ম নেবে। শান্তনুর মৃত্যুর পর চিত্রাঙ্গদ রাজপদে বসলেও এক গন্ধর্বের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান তিনি। বালক বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসানো হল। কাজ দেখতে লাগলেন ভীষ্ম।  এই সময় কাশীরাজ তার তিন কন্যা – অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকার স্বয়ম্বরের আয়োজন করলে, বিচিত্রবীর্যের জন্য ভীষ্ম ঐ তিন কন্যাকে হরণ করেন এবং অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হয়।

কিন্তু, অম্বা বলল সে রাজা শাল্বকে বিবাহ করতে চায়। ভীষ্ম তাকে শাল্বের কাছে ফিরিয়ে দিতে গেলে শাল্ব এক অপহৃতা নারীকে বিবাহ করতে অস্বীকার করে। তখন অম্বা ভীষ্মের পাণিগ্রহণ করতে চাইলে ভীষ্ম জানান, তিনিও অপারগ। এ শুনে অম্বা রাগে, হতাশায় ও অপমানে ভীষ্মকে তার পরম শত্রু বলে গণ্য করে ও প্রতিজ্ঞা করে যে পরের জন্মে সে ভীষ্মের ওপর এই অপমানের প্রতিশোধ নেবে। পরজন্মে পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডী রূপে জন্ম নেয় অম্বা ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এদিকে বিচিত্রবীর্য  যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। তাঁর কোন সন্তান হয় নি। বংশ রক্ষার জন্য এবং রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তিত সত্যবতী ব্যাসদেবকে অনুরোধ করেন দুই বিধবা রানী অম্বিকা ও অম্বালিকাকে পুত্রলাভের বর দেওয়ার জন্য। ব্যাসদেব মায়ের কথা রাখতে একে একে দুই রানির সামনে উপস্থিত হলে ব্যাসের ভয়ংকর রূপ দেখে অম্বিকা নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে ও অম্বালিকার শরীর পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করে। তাই অম্বিকার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র  হন জন্মান্ধ এবং অম্বালিকার পুত্র পাণ্ডুর দেহ পাণ্ডুবর্ণের হয়। নবজাত সন্তানদের এই অবস্থা দেখে  সত্যবতী ব্যাসদেবকে আবার ডেকে পাঠান বরদানের জন্য । কিন্তু এবার রানীরা ভয়ে নিজেরা গেলেন না। পাঠালেন এক দাসীকে । আর সেই দাসীর যে পুত্র জন্ম গ্রহণ করল তিনি হলেন  বিদুর। তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন। কুরুরাজ্যের মহামন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন তিনি।
তিন পুত্র প্রাপ্তবয়স্ক হলে ভীষ্ম জ্যেষ্ঠ পুত্র ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা করতে চান, কিন্তু বিদুর উপদেশ দেন যে অন্ধ পুত্রকে রাজা বানানো ঠিক হবে না। তাই, পাণ্ডু রাজা হলেন। এরপর ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে হল  গান্ধারীর সাথে  আর পাণ্ডুর বিয়ে হল কুন্তী ও মাদ্রীর সঙ্গে। স্বামীর অন্ধত্বের জন্য গান্ধারী নিজের চোখ দুটি আমরণ ঢেকে রেখেছিলেন। কিন্তু গান্ধারীর এই দশা দেখে তার ভ্রাতা শকুনি ক্রুদ্ধ হন ও কুরুরাজবংশের ওপর প্রতিশোধ নেবার পণ করেন। রাজা হবার পর পাণ্ডু স্ত্রীদের সাথে অরণ্য ভ্রমণে যান ও দুটি হরিণ দেখে তাদের তীরবিদ্ধ করেন। দুর্ভাগ্যবশত, ঐ দুই হরিণ বাস্তবে ছিল এক ঋষি ও তার স্ত্রী। ক্রুদ্ধ ঋষি মৃত্যুর পূর্বে পাণ্ডুকে অভিশাপ দেন, কোনো স্ত্রীর প্রতি কাম আসক্ত হয়ে শারিরীক সম্পর্কে লিপ্ত হলে পাণ্ডুর মৃত্যু হবে। অনুতপ্ত পাণ্ডু রাজ্য ত্যাগ করে মাদ্রীর সাথে বনবাসী হন। ধৃতরাষ্ট্রকে রাজপদে অধিষ্ঠিত করা হয়।
কুন্তী বাল্যকালে ঋষি দুর্বাসার কাছ থেকে এক মন্ত্র লাভ করেন, যার মাধ্যমে যে কোনো ভগবানকে আহ্বান করা যায় ও বর চাওয়া যায়। কুন্তী বিবাহের আগে কৌতূহলবশত সূর্যদেবকে আহ্বান করেন, সূর্যদেব তাকে এক পুত্রের বর দেন। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে সবার অজান্তে কুন্তী ঐ শিশুপুত্রকে নদীতে ভাসিয়ে দেন, যে পরে অধিরথ সারথির কাছে পালিত হয় ও তার নাম হয় কর্ণ। বিয়ের পর ঐ মন্ত্রের দ্বারা কুন্তী ধর্মদেবের বরে যুধিষ্ঠির, পবনের বরে ভীম, ইন্দ্রের বরে অর্জুন নামে তিন গুণবান পুত্রের জন্ম দেন। মাদ্রী কুন্তির কাছে ঐ মন্ত্র চেয়ে নিয়ে মন্ত্রের পাঠ করে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের বরে নকুল ও সহদেব নামে দুই পুত্র লাভ করেন। এই পাঁচ পুত্র ‘পাণ্ডব’ নামে পরিচিত হন। একদিন পাণ্ডু মাদ্রীকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে মারা যান। দুঃখে মাদ্রী পাণ্ডুর চিতায় সহমরণ গ্রহণ করেন। শিশুপুত্রদের ভার পড়ে কুন্তীর ওপর।
 
এদিকে যুধিষ্ঠির ও ভীমের জন্মের পর একশোটি ঘৃতপূর্ণ কলশ থেকে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর ১০০ সন্তান জন্মায়। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হল দুর্যোধন ও এরপর দুঃশাসন, বিকর্ণ প্রভৃতি, এছাড়া ধৃতরাষ্ট্রর দুঃশলা নামে এক কন্যাও হয়। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা ‘কৌরব’ নামে পরিচিত হয়। বিকর্ণ ছাড়া  কৌরবরা ধার্মিক ছিল না। এছাড়া দাসীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের আরেক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। সেই পুত্রের নাম যুযুৎসু। এই পুত্রের জন্মগ্রহণের পিছনে রয়েছে আরেক কাহিনী। সে সবের বর্ণণা আলোচ্য মহাভারতের মূল কাহিনীকে আরও ভারি করে তুলবে। কৌতূহলী পাঠক চাইলে সে কাহিনী অন্যত্র পড়ে নিতে পারেন। 

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 
                  

Post a Comment

0 Comments