জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক-১২/ অসীম ভুঁইয়া

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক  পর্ব ১২
অসীম ভুঁইয়া
বাংলা ধাতুর বিচিত্র রূপ

আজ ধাতু সম্পর্কে
আলোচনাটা সেরে নিতে চাই। প্রথমেই কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে দিই:
১. আলো "পড়ল" সন্ধ্যা রঙের। 
২. রাগে "ফুঁসছে"।
৩. কাউকে দিয়ে সম্ভবত কথাটি "বলাবে"।
 
    চিহ্নিত পদগুলি ক্রিয়াপদ, কারণ এই পদগুলি "কাজ করা" ভাব প্রকাশ করছে।
 এই ক্রিয়াগুলিকে বিশ্লেষণ করলে অর্থপূর্ণ একটি মূল অংশ পাওয়া যায়। যেমন- "পড়ল" ক্রিয়াটিকে ভাঙলে প্রাথমিক ভাবে দুটি অংশ পাওয়া যাচ্ছে। "পড়্" এবং "ল"। "ল" বিভক্তি। এই বিভক্তি অংশটি বাদ দিলে পড়ে থাকছে "পড়্" অংশটি। একে আবার বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় "প" ও "ড়", যারা ধ্বনি মাত্র। সেভাবে সুস্পষ্ট কোনো অর্থই নেই। অর্থাৎ অর্থপূর্ণ শেষ অংশ "পড়্"।এই "পড়্" এখানে ধাতু।

   একইভাবে,
ক্রিয়াপদ =  ধাতু + বিভক্তি।
ফুঁসছে  =  ফুঁস্ + ছে।  বলাবে   =   বলা + বে।
 
    ধাতু এক বা একাধিক দল নিয়ে নির্মিত। যেমন- ফুঁস্, পড়্, এগুলো একটি দল আর "বলা" দুটি দল নিয়ে গঠিত। 

   অর্থাৎ আমরা বলতেই পারি, ক্রিয়াপদের অন্তর্নিহিত ভাব বা অর্থ প্রকাশক যে মূল অংশ এক বা একাধিক দল নিয়ে গঠিত, তাকে ধাতু বলে। 

   ক্রিয়াপদের মূল অংশই ধাতু। তবে আপাতভাবে মনে হতে পারে বিশেষ্য, বিশেষণ প্রভৃতি পদকে বিশ্লেষণ করলেও তো ধাতু পাওয়া যায়, তাহলে কেন ক্রিয়াপদের মূল অংশকেই শুধু ধাতু বলা হয়? যেমন-  বৃৎ + শানচ্ = বর্তমান। বৃৎ ধাতু কিন্তু বর্তমান ক্রিয়াপদ নয়। 
দৃশ্ + অক = দর্শক। দৃশ্ ধাতু কিন্তু দর্শক ক্রিয়া নয়। বিশেষ্য।
  আসলে বৃৎ , দৃশ্, এরা একসময় ক্রিয়ার মূল অংশই ছিল। কিন্তু সংস্কৃত থেকে পরিবর্তনের ধারায় বাংলায় এসে এরা পরিবর্তিত হয়েছে। তাই ধাতুগুলি ক্রিয়ার মূল অংশ হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য শব্দ তৈরি করতে সক্ষম। এটি মূলত নতুন শব্দ গঠনের ফলেই  সম্ভব হয়েছে। তাই বর্তমান বা দর্শক শব্দটির মূল অংশ বৃৎ বা দৃশ্ না বলে বরং বলা উচিত বৃৎ বা দৃশ্ ধাতু দুটি বর্তমান ও দর্শক শব্দ দুটিকে নির্মাণ করেছে।

   ধাতু  প্রত্যয় যুক্ত হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আর ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হলে তবেই তা ক্রিয়াপদে পরিণত হয়। যেমন - বল্ একটি প্রত্যয়হীন ধাতু। বলা( বল্ + আ)  একটি প্রত্যয় যুক্ত ধাতু। 
এখানে "আ" প্রত্যয়।
আর বল্+আ+ ইয়েছে = বলিয়েছে। বলাইয়াছে >  বলিয়েছে। সাধু থেকে চলিত রীতিতে আসার সময় ধ্বনিলোপ ও স্বরসঙ্গতি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়েছে।

   অর্থাৎ প্রত্যয়যুক্ত ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়ে  ক্রিয়াপদ গঠিত হয়, আবার প্রত্যয়হীন ধাতুর সঙ্গেও বিভক্তি জুড়ে ক্রিয়াপদ গঠিত হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, ধাতুর পর বিভক্তি জুড়ে গেলে তারপর আর প্রত্যয় যুক্ত করা যায় না। কিন্তু ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বিভক্তি যুক্ত হতে পারে।

   ধাতুর শ্রেণিভাগ:
গঠন ও উৎস অনুসারে ধাতুকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- 
 ১. একদল বা মৌলিক ধাতু, ২. বহুদল বা সাধিত ধাতু ও ৩. বহুপদ বা সংযোগমূলক ধাতু ।

১. একদল বা মৌলিক ধাতু:  i. তিতলি বইটি "পড়েছে"।
ii. মেয়েটির দিকে তাকালেই সে "হাসে"। 
এখানে "পড়ছে" ক্রিয়ার পড়্ ধাতুকে এবং "হাসে" ক্রিয়ার হাস্ ধাতুকে অর্থপূর্ণভাবে আর ভাঙা যায় না। এরাই মৌলিক ধাতু। অন্যদিকে এরা একটি মাত্র দল নিয়ে গঠিত।
 
   অর্থাৎ একটি মাত্র দল নিয়ে গঠিত যে ধাতুকে অর্থপূর্ণভাবে আর বিশ্লেষণ করা যায় না, তাকে মৌলিক বা একদল ধাতু বলে।
 একদল বা মৌলিক ধাতুর কয়েকটি ধরন: 
 সংস্কৃত- ভজ্ চল্ লভ্ লিখ্ কৃ মুচ্ প্রভৃতি
 তদ্ভব-  হস্> হাস্, খাদ্ > খা প্রভৃতি।
বাংলা -  বল্ ঠেল্ ডাক্ কাট্ বাঁধ্ প্রভৃতি।

 বহুদল বা সাধিত ধাতু:
i. "গুনগুনিয়ে" গান শুনিয়ে.. ii.আকাশে মেঘ "ঘনিয়েছে"।
গুনগুন + আ=  গুনগুনা + ইয়ে = গুনগুনিয়ে
ঘনা + আ = ঘনা + ইয়েছে= ঘনিয়েছে। 
 উপরের উদাহরণ গুলিতে দেখা যাচ্ছে, মৌলিক ধাতুর সঙ্গে আ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সাধিত ধাতু  গঠন করেছে। এবং এই সাধিত ধাতুগুলি আবার একাধিক দল নিয়ে গঠিত।
 
  অর্থাৎ একাধিক দল বিশিষ্ট যে ধাতু বিশ্লেষণযোগ্য  অথবা মৌলিক ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে ধাতু  গঠিত হয়, তাকে বহুদল বা সাধিত ধাতু বলে। 

বহুদল বা সাধিত ধাতুর শ্রেণিভাগ:
 সাধিত ধাতুকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
i.  প্রযোজক ধাতু
ii. নামধাতু ও iii. ধ্বন্যাত্মক ধাতু।

i. প্রযোজক ধাতু:
সাইনি আজ সবাইকে খুব "হাসিয়েছে"।
 সিন্ধু, মুন্নিকে দিয়ে কাজটি "করিয়েছে।"
 বিশ্লেষণ করা যাক:
ক্রিয়াপদ - হাসিয়েছে। হাসা সাধিত ধাতু, ইয়েছে বিভক্তি।
  করিয়েছে = করা সাধিত ধাতু + ইয়েছে বিভক্তি।   

   প্রতিটি উদাহরণে একজনের প্রেরণায় বা প্রযোজনায় অন্যজন ক্রিয়া  সম্পাদনা করেছে। তাই এই ক্রিয়াজাত সাধিত ধাতুকে প্রযোজক বা নিজন্ত ধাতু  বলে।
 প্রযোজনা করছে বলেই প্রযোজক নামটি দেওয়া হয়েছে। আর সংস্কৃত নিচ্ প্রত্যয়যোগে এই ধরনের ধাতু  সংস্কৃতে গঠিত হত,তাই নিজন্ত ধাতু। বাংলায় নিচ্ প্রত্যয়ের স্থানে আ হয়েছে।  তাই প্রথাগত নামটি বর্জন করাই উচিত।
 
    অর্থাৎ আমরা বলতেই পারি, প্রযোজনা অর্থে,  মৌলিক ধাতুর সঙ্গে আ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে সাধিত ধাতু গঠিত হয়, তাকে প্রযোজক ধাতু  বলে।
 নাম ধাতু:
 কী ঘুম "ঘুমিয়েছি"।
 হৃদয়ের রঙে "রাঙিয়েছি" তোমায়।
 বিশ্লেষণ করা যাক:
 ঘুমিয়েছি ক্রিয়াপদ। ঘুম্  বিশেষ্য + আ = ঘুমা + ইয়েছি = ঘুমিয়েছি। একইভাবে রাঙিয়েছি।
বিশেষ্য, বিশেষণ প্রভৃতি নামপদ। আর এই নাম পদগুলির সঙ্গে আ প্রত্যয়  যুক্ত হয়ে নামধাতু গঠন করেছে। ক্রিয়াপদ গঠনের পর ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মে আ ধ্বনি যেমন লুপ্ত হয়, তেমনি আবার স্বরসঙ্গতিও ঘটে।
  মূলত সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষাতে পরিবর্তিত হওয়ার সময়ই এই ধরনের পরিবর্তন হয়।
 
   অর্থাৎ নামপদের( বিশেষ্য, বিশেষণ) সঙ্গে আ প্রত্যয়  যুক্ত হয়ে যে সাধিত ধাতু গঠিত হয়, তাকে নামধাতু বলে।

   ধ্বন্যাত্মক ধাতু:
 ঘরেতে ভ্রমর এল "গুনগুনিয়ে।"
 লোকটা গাড়ি "হাঁকাচ্ছে"।

 বিশ্লেষণ করা যাক: 
গুনগুন ও হাঁকা ধ্বন্যাত্মক শব্দ। এদের সঙ্গে আ যুক্ত হয়ে ধ্বন্যাত্মক ধাতু গঠন করেছে। 
 অর্থাৎ ধ্বন্যাত্মক শব্দের সঙ্গে আ প্রত্যয়  যুক্ত হয়ে যে সাধিত ধাতু গঠিত হয়, তাকে ধ্বন্যাত্মক  ধাতু বলে।
 
  বহুপদ বা সংযোগমূলক ধাতু:

ছেলেটি "বসে পড়ল।"
 লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে "ফেলে দিল।"
 বিশ্লেষণ করা যাক: 
দেখা গেল প্রতিটি মৌলিক ধাতুর আগে নামপদ বা অসমাপিকা ক্রিয়া যুক্ত হয়েছে। এভাবে দুটো ক্রিয়া বা একটি ক্রিয়া ও একটি নাম পদ নিয়ে গঠিত ক্রিয়াকেই  বহুপদ  বা সংযোগমূলক ক্রিয়া বলে। আর বিভক্তি বাদ দিলেই তা ধাতু।
 
    
অনেকগুলো পদ নিয়ে গঠিত তাই বহুপদ বলা হয়। একাধিক পদের সংযোগে  গঠিত হওয়ায় সংযোগমূলক বলা হয়।
 
   অর্থাৎ নামপদ (বিশেষ্য বিশেষণ, ধ্বন্যাত্মক শব্দ) ও অসমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে মৌলিক ধাতু যুক্ত হয়ে যে ধাতু গঠিত হয়, তাকে বলে বহুপদ  বা সংযোগমূলক ধাতু।

শ্রেণি ভাগ:
 বহুপদ বা সংযোগমূলক ধাতুকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। 
i. যৌগিক ধাতু ও ii.যুক্তধাতু
 
   অসমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে মৌলিক ধাতু যুক্ত হলে যৌগিক ধাতু হয়,আর নামপদের সঙ্গে মৌলিক ধাতু  যুক্ত হলে যুক্ত ধাতু হয়।
  
    কয়েকটি কথা বলে নেওয়া ভালো: 
১. ধাতু থেকে ক্রিয়াপদ গঠনের সময় ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মে ধ্বনি লোপ, স্বরসঙ্গতি প্রভৃতি ঘটে থাকে। আসলে সাধুরীতি থেকে চলিত রীতিতে পরিণত হওয়ার সময়ই এ ধরনের পরিবর্তন হয়।
  ২.  "গুনগুন"- মৌলিক ধাতু হাওয়া সত্বেও দুটি দল। আবার একে অসমাপিকা ক্রিয়া হিসেবেও প্রয়োগ করা যায়। যেমন- গুনগুনিয়ে যা।
 
৩. সাধিত ধাতুর অংশ  হিসেবে ধ্বন্যাত্মক ধাতু গৃহীত। কিন্তু একে আবার যৌগিক বা  যুক্তধাতু হিসেবেও প্রয়োগ করা যায়। যেমন-  গুনগুন কর : যুক্ত ধাতু। অর্থাৎ প্রয়োগ বৈচিত্র্যের জন্য একে নির্দিষ্ট কোনো একটি  ভাগে ফেলা যাচ্ছে না।

৪. যাওয়া,খাওয়া প্রভৃতি  প্রযোজক ধাতুগুলি ক্রিয়া বিশেষ্যের মতো দেখতে হলেও এরা প্রকৃতপক্ষে ধাতু। এদের ক্রিয়াবিশেষ্য রূপ  খাওয়ানো, যাওয়ানো। অর্থাৎ প্রয়োগ অনুযায়ী এদের চেহারাটি ক্রিয়া বিশেষ্যও হতে পারে আবার প্রযোজক ধাতুও হতে পারে।
 [সূত্র: পবিত্র সরকার প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৪]

   ক্রিয়াপদ পর্বে  এদের আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
 আজ এটুকুই।

পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments