জ্বলদর্চি

মাদাগাস্কারের লোকগল্প(বনের মুরগি ঘরে এলো) /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প
মাদাগাস্কারের লোকগল্প

চিন্ময় দাশ  

বনের মুরগি ঘরে এলো 

(বনমুরগি আদিতে ছিল বনের পাখি। আজ বিশ্ব জুড়ে যে মোরগ-মুরগি দেখা যায়, বনমুরগির কয়েকটি প্রজাতি থেকেই তাদের উদ্ভব। প্রাণিবিজ্ঞানীরা তেমনটাই মনে করেন। বনের মুরগি কী করে মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে, নানান দেশে নানান কাহিনী আছে তা নিয়ে। ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ মাদাগাস্কার। আফ্রিকার প্রতিবেশী দেশ। আমাদের আজকের গল্পটি সেখান থেকেই তুলে আনা।
বনমুরগি আর কাঠময়ূর-- দুটি চরিত্র এই গল্পের। বনমুরগি হল Phasianidae গোত্রের  অন্তর্ভুক্ত একটি পাখি। আর, মাদাগাস্কার-এর একটি বিখ্যাত পাখি হল-- Pheasant, যার বাংলায় নাম-- মথুরা। এদের ২টি প্রজাতি-- কালোময়ূর, আর, ২. কাঠময়ূর (Polyplectron bicalcaratum. 
বন মুরগি আর কাঠ ময়ূর-- অনেক মিল দুজনের মধ্যে। আদ্র, ঘণ আর চিরসবুজ অরণ্য দুজনেরই প্রধান বিচরণ ভূমি। দুজনেরই প্রধান খাদ্য হোল-- শস্যদানা, গুটিজাতীয় ফল, পোকামাকড়, ছোট আকারের ব্যাঙ, গিরগিটি ইত্যাদি। দুজনেরই ডানা বড়, কিন্তু তেমন ওড়াউড়ি করতে পারে না। পা ফেলে ফেলে চলাই বেশি পছন্দ তাদের। লেজের বাহারও বেশ দুজনের। এবার গল্পটা শুনে নেওয়া যাক। )

  বনের ভিতর একটা শুঁড়ি রাস্তা। সেই পথে যেতে যেতে, একদিন হঠাৎ দেখা দুই বন্ধুর-- বনমুরগি আর কাঠ ময়ূর। কত দিন বাদে দেখা। ভালো লাগলো দু'জনেরই। 
  ছোট বেলায় ভারী ভাব ছিল দুজনের। এখন সব কথা মনে পড়ছে। একসাথে বেরিয়ে পড়া। ঘুরে বেড়ানো। ঝোপে-ঝাড়ে খুঁটে খুঁটে বটের ফল, একটা-দুটো পোকামাকড় খাওয়া। দুজনের খুনসুটি। তাই নিয়ে আবার দু'জনের বাবা-মায়ের কিচির-মিচির, বকাঝকা। কী যে সুন্দর কেটেছে দু'জনের সেসব দিনগুলো। এখন বড় হয়ে, দেখতে ভারী সুন্দর হয়েছে দু'জনেই। চেয়ে চেয়ে দেখছে দু'জেনে দু'জনকে। পুরাণো দিনের কথা মনে পড়ছে। দু'জনের মুখেই আনন্দের হাসি।
মুরগি বলল-- আচ্ছা বন্ধু, তোমার মনে আছে, সেই চাষীর খামারবাড়ির বেড়া গলে, ঢুকে পড়ার কথা? দেখতে পেয়ে গিয়েছিল চাষী। যেভাবে গুলতি ছুঁড়ছিল, আমাদের তো অক্কা পেয়ে যাবার হাল!
সাথে সাথে ময়ূর বলল-- মনে থাকবে না আবার? সত্যি, ভারী বিপদেই পড়েছিলাম সেদিন। বড়জোর বেঁচে গেছি। নইলে, কী যে হোত সেদিন।
মুরগিরও সব মনে আছে। সেসব রোমাঞ্চকর দিনের কথা কি ভোলা যায়? সে বলল-- ভাগ্যিস তুমি দেখতে পেয়ে গিয়েছিলে! তুমি না চেঁচিয়ে উঠলে, আমি তো আর একটু হলেই, ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম। মরেই যেতাম সেদিন।
--লোভের জন্যই কোনদিন মারা পড়বে তুমি। চোখ-কান খোলা না রাখলে, বিপদ আসতে দেরি লাগে না। আমি বাপু এইটা বুঝি। যাক সে কথা। ময়ূর বলল-- সেই কোন সাতসকালে বেরিয়েছি। দানাটিও পড়েনি পেটে। চলো, খাবারের চেষ্টা দেখি।
মুরগিও সায় দিয়ে বলল-- ঠিক বলেছ। আমার পেটও চোঁ-চোঁ করছে।
-- তাহলে চলো, সেই চাষীর খামারেই যাওয়া যাক।
গুটি গুটি পায়ে খামারবাড়িতে এসে হাজির হোল দুজনে। বেড়ার কাছে এসে, ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল ফাঁক দিয়ে। উঁকি-ঝুঁকি মেরে যাচাই করে নিল ভালো করে। না, কেউ নাই কাছেপিঠে। সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেল ভিতরে। 
দুজনের পেটেই খিদে। তাড়াতাড়ি তৈরি-খাবার কিছু পেলে, ভালো হয়। সোজা চাষীর ঘরেই ঢুকে পড়ল দুজনে। না, তৈরি খাবার কপালে নেই। খাবার টেবিল, রান্নাঘর, এমনকি মেঝেতেও কিচ্ছুটি পড়ে নেই। কিছুই পাওয়া গেল না খাটের তলায় উঁকি মেরেও। কী করা যায়, কী করা যায়? মুরগি বলল-- চলো তো, লোকটার গুদামঘরটায় যাওয়া যাক একবার।
ময়ূর বলল-- ঠিক বলেছ। কিছু না কিছু মিলবেই ওখানে। 
  তড়িঘড়ি করে গুদামঘর গিয়ে ঢুকে পড়ল দুজনে। তাকিয়েই চোখ কপালে উঠে গেল তাদের। নানান খাবার সাজানো আছে সেখানে। মুরগির চোখ আটকে গেল ঘরের কোণার দিকে। মিষ্টি আলু ডাঁই করে রাখা আছে  সেখানে। মুরগি তো আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল-- দেখতে পেয়েছ? 
  ময়ূরও দেখেছে। সে কেবল একটা হুঁ ছাড়া আর কিছু বলল না। তার মাথায় একটাই ভাবনা, যদি কাছেপিঠে কোথাও থাকে মালিক? যদি এসে পড়ে? বিপদের শেষ থাকবে না তখন। এই বদ্ধ ঘরে, পালাবার পথ পাওয়া যাবে না।
  মুরগি পড়ে গেছে অন্য ভাবনায়। মিষ্টি আলু খেতে বেশ সুস্বাদু। কিন্তু আলুগুলো বেশ বড় বড়। এখানে বসে তারিয়ে তারিয়ে তো আর খাওয়া যাবে না। যতটা পারে যায়, নিয়ে কেটে পড়তে হবে। মুরগি ভাবল, বড় জোর দুটো আলুই নিয়ে যেতে পারবে সে। তার বেশি নয়। তাহলে, আলু যখন মাত্র দুটো, অতএব বড় দেখে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
  সে তখন আলুগুলোকে লাইন করে সাজাতে বসল। বেছে বেছে পর পর বড়, মাঝারি, ছোট, একেবারে ছোট-- এইভাবে সাজাতে শুরু  করল মুরগি। একটাই উদ্দেশ্য, সবচেয়ে বড় আলু দুটোকে খুঁজে বের করা। সেই দুটো নিয়েই চলে যেতে হবে এখান থেকে। 
মুরগির কান্ড-কারখানা ময়ূরের মাথায় কিছু ঢুকল না। সে বলেই ফেলল-- আরে বন্ধু, এত কী করছো তুমি? 
মুরগি কাজ করতে করতে বলল-- সবচেয়ে বড় দুটো আলু নিয়ে, তবেই বাড়ি যাব। আজ আলু খেয়ে মোটা হয়ে যাব, একেবারে চাষীর শুকরছানাগুলোর মত মোটা। বড় আলু বাছাই করছি এখন।
  ময়ূর তা শুনে বলল-- আমি বাপু ওর মধ্যে নাই। কখন লোকটা এসে পড়ে, তার নাই ঠিক। বিপদে পড়ে যাব তাহলে। একেবারে ছোট কয়েকটা নিয়ে সরে পড়ছি আমি। যেমন কথা তেমন কাজ। মুরগির বাছাই করা আলু থেকে, সবচেয়ে কয়েকটা ছোট আলু তুলে নিয়ে, চটপট বেরিয়ে গেল ময়ূরটা। বেড়া পার হয়ে, বনের মুখটায় পৌঁছে গেল সে। একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে বন্ধুর ফিরে আসবার অপেক্ষা করতে লাগল।
  মুরগি তো বাছাইয়ের কাজে মশগুল। চাষী ফিরে এলো খেত থেকে। সবজি বাগানে খুব খাটাখাটুনি গিয়েছে। ভারী শরীর নিয়ে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকছে লোকটা। কোদাল, নিড়ানি রাখতে গিয়ে, শত্রূর হদিশ পেয়ে গেল সে। বালিতে পায়ের ছাপ ফুটে আছে অনেকগুলো। সাথে সাথে গুদামের দিকে দৌড় লাগল লোকটা।
  ময়ূর চাষীকে দেখতে পেয়েছে ঝোপের আড়াল থেকে। সে চেঁচিয়ে উঠল-- পালাও বন্ধু, বিপদ তোমার সামনে। 
  সাবধান বাণী কানে গিয়েছে মুরগির। পালাতে হবে এখনই। কিন্তু কষ্ট করে বাছাই করা আলু দুটো না নিয়ে, যায় কি করে? বড় মাপের দুটো আলু নিয়ে, বেরিয়ে পড়ল গুদাম থেকে। চৌকাঠ পেরুতে যাবে, 'আরে শয়তান, তুই ঢুকেছিস?' বলে, খপ করে মুরগির ঘাড়টা ধরে ফেলল চাষী।
  মুরগি চিঁ-চিঁ করে করে উঠল-- বন্ধু, বাঁচাও।
সেই মিহি গলার শব্দ কারও কানে গেল না। ময়ূর ততক্ষণে বনের গভীরে নিরাপদ জায়গায় সরে গিয়েছে। 
চাষী বলল-- কে বাঁচাবে তোকে। কেটে কুচি কুচি করে খাব আজ। একটা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে আগড় আটকে দিল মুরগিকে। 
এতক্ষণে হুঁশ ফিরল মুরগির। বেশি লোভ করা ঠিক কাজ হয়নি। পেট নিয়ে বেশি ভাবতে গিয়ে, জীবনটাই যাবে এখন। কী করা যায়, কী করা যায়-- ভাবতে লাগল সে।
খানিক জিরিয়ে নিয়ে, চকচকে একখানা ছুরি নিয়ে ফিরে এল চাষী। কোপ বসাতে যাবে, মুরগি বলল-- আমার গলায় কোপ বসালে, কী এমন পাবে তুমি? সামান্য খানিকটা মাংস বই তো নয়? তাও আবার একদিন মাত্র।

চাষী বলল-- তাই তো পাবো। তাছাড়া আবার কী?
মুরগি জবাব দিল-- না মেরে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে, অনেক বেশি লাভ তোমার। নিয়মিত ডিম পাবে। চাইলে অনেক বাচ্চাও জন্মাবে সেসব ডিম থেকে। তারাও ডিম দেবে তোমাকে। মাংস তো পাবেই। ডিম মাংসে জায়গা কুলোতে পারবে না গুদামঘরে। ভেবে দেখো, কী করবে? 
  কথাটা বেশ মনে ধরল চাষীর। সত্যি তো, অনেক লাভ। না কেটে, মুরগীটাকে রেখেই দিল ঘরে।
ময়ূরের প্রায়ই মনে পড়ে বন্ধুর কথা। কোথায় হারিয়ে গেল তাদের সেইসব সুখের দিন। অনেক দিন বাদে, ময়ূরের মনে হোল, একবার চাষীর ঘরে যাই। বেড়ার কাছে এসেই সে অবাক। মুরগিটা, তার বন্ধু, বেঁচে আছে। কেমন বুড়োসুড়ো চেহারা হয়েছে। পিছনে ঘুরঘুর করছে কতকগুলো ছানাপোনা। সবাই দানা খাচ্ছে খুঁটে খুঁটে।
মুরগি ডাক ছেড়ে বলল-- কেমন আছো, বন্ধু? ভালো তো? মুরগি একবার গলা তুলে তাকাল শুধু। কোন জবাব দিল না। আবার দানা খেতে লাগল খুঁটে খুঁটে।
-------------------
মি. রব রবার্টস-- মৌমাছি-পালক, পরিবেশ-বিজ্ঞানের শিক্ষক, এবং সেন্ট অগাস্টিন, মাদাগাস্কারে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড-এর টেকনিশিয়ান-এর সৌজন্যে।

পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments