জ্বলদর্চি

সংক্ষিপ্ত মহাভারত-পর্ব-৬/সুদর্শন নন্দী

সংক্ষিপ্ত মহাভারত-পর্ব-৬
সুদর্শন নন্দী

চিত্র- শর্মিষ্ঠা ঘোষ 
দ্রৌপদীকে লাভ করার পরে  নারদের প্রস্তাব মতো পঞ্চপান্ডবরা তাঁর সামনে ঠিক করলেন এক-একজনের ঘরে দ্রৌপদী  এক-এক বছর ধরে থাকবেন।  উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এক বছর থাকার ফলে দ্রৌপদীর গর্ভে  সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ সম্ভব হবে। তাঁরা নিজেরাই ঠিক করলেন যে, এই এক বছর কারো কাছে দ্রৌপদী থাকার সময়  অন্য কেউ যদি উপস্থিত হন তা হলে তাকে ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বছর বনে বাস করতে হবে।
  দ্রৌপদীর যে সন্তানের জন্ম হয় তা এরকম। যুধিষ্ঠিরের কন্যা সুতনু, অর্জুনের কন্যা প্রগতি।  এছাড়া আরও কন্যার জন্ম হয় যাদের নাম পাওয়া যায় নি।
  এছাড়া দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র জন্মগ্রহণ করে। এঁরা হল-যুধিষ্ঠিরের পুত্র প্রতিবিন্ধ্য, ভীমের পুত্র সুতসোম, অর্জুনের পুত্র শ্রুতকর্মা, নকুলের পুত্র শতনীক, সহদেবের পুত্র শ্রুতসেন।
  দ্রৌপদীকে বাদ দিয়ে যুধিষ্ঠিরের আর একটি মাত্র স্ত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যার নাম হল — দেবিকা এবং তার পুত্রের নাম হল যৌধ্যেয়। দেবিকার গর্ভে উৎপন্ন যুধিষ্ঠিরের আর কোন পুত্র বা পুত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় না।
  দ্রৌপদী ছাড়া ভীমের তিন স্ত্রীর উল্লেখ পাই। প্রথম স্ত্রী হল  বলন্ধরা । এদের পুত্রের নাম সর্বগ । দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হিড়িম্বা এদের পুত্র হল ঘটোৎকচ । দ্রৌপদীর সাথে বিয়ের আগেই এদের বিয়ে হয় তা আগেই উল্লেখ করেছি।
  দ্রৌপদী ছাড়া ভীমের তৃতীয় স্ত্রী নাগ রমনী । তবে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
দ্রৌপদীর সাথে একবছর থাকার সময় অন্য কেউ ঘরে প্রবেশ করলে বারো বছর বনবাসের কথা যে বললাম তা অর্জুনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হল। একদিন  যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী একসাথে থাকার সময়  অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ঘরে ঢোকেন। অতএব শর্তানুযায়ী অর্জুন বারো বছরের জন্য বনবাস গ্রহণ করেন। এই বনবাসের সময় অর্জুন তিনবার বিয়ে করেন ও পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এঁরা হলেন উলপী । এদের সন্তান ইরাবান। দ্বিতীয় জন চিত্রাঙ্গদা, এদের সন্তান বভ্রুবাহন এবং তৃতীয় জন হল সুভদ্রা, এদের পুত্র  অভিমন্যু।
অন্যদিকে নকুলের দ্রৌপদী ছাড়া আর একটি মাত্র স্ত্রীর উল্লেখ পাই। নাম করেনুমতি। এদের সন্তান নিরামিত্র। তেমনি সহদেবের আর একটি স্ত্রীর উল্লেখ পাই। নাম বিজয়া। এদের পুত্র সুহোত্র ।  
এবার পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে ফিরে এলে পাণ্ডবদের সাথে কলহ করা ঠিক হবে না ভেবে সবার পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র কুরুরাজ্যের এক অংশ তাদেরকে দিয়ে দেন। সেই অংশ হল ‘খাণ্ডবপ্রস্থ’ । সেখানে পাণ্ডবরা  নিজস্ব রাজ্য স্থাপন করেন। ময়দানব (দেবতাদের যেমন বিশ্বকর্মা, দানবদের তেমনি ছিলেন ময়দানব)  সেখানে ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ নামে এক অতি সুন্দর রাজধানী নগর তৈরী করে দেয়। যুধিষ্ঠির রাজপদে অধিষ্ঠিত হলেন।  
এবার নিজের রাজ্যের উন্নতিসাধন করতে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের উপদেশ চাইলেন। কৃষ্ণ রাজসূয় যজ্ঞ করে আর্যাবর্তের চক্রবর্তী সম্রাট পদে আরোহণ করার পরামর্শ দেন। যুধিষ্ঠিরের এই পদোন্নতিসাধনের জন্য চার ভাই মিলে দিগ্বিজয়ে পাড়ি দিলেন।
  রাজসূয় যজ্ঞকালে আমন্ত্রিত চেদীরাজ শিশুপাল ভয়ানকভাবে কৃষ্ণকে অপমান করেন ও কৃষ্ণ পাপী শিশুপালের মস্তকচ্ছেদ করেন। এদিকে ইন্দ্রপ্রস্থের অপরূপ শোভা দেখে দুর্যোধন ঈর্ষান্বিত হলেন। কখনো রাজপুরীর স্বচ্ছ স্ফটিককে তিনি জল ভেবে ভুল করেন আবার কখনো  সরোবরের জলকে স্ফটিক মনে করে তার ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে জলে ভিজে যান। অপমানে দুর্যোধনের একপ্রকার আহার নিদ্রাই চলে গেল। এর উপর কথাচ্ছলে দ্রৌপদীর উপহাস ও হাসিতে অত্যন্ত অপমানিত হয়ে ঠিক করলেন প্রতিশোধ তিনি  নেবেনই।
  পাণ্ডবদের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য দুর্যোধন শলা পরামর্শ করলেন মামা শকুনির সঙ্গে।  ভাগনের কথা শুনে শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কপট পাশা খেলার আয়োজন করলেন। কিন্তু শকুনির ছলনায় যুধিষ্ঠির তার রাজ্য, সম্পত্তি সমস্ত হারান। শেষে নিঃস্ব হয়ে ভাইদেরকে, এমনকি নিজেকেও বাজি রাখেন এবং সবাই দাসে পরিণত হলেন। নেশা যেন চেপে বসল যুধিষ্ঠিরকে। খেলার নেশায় ধর্মজ্ঞান হারিয়ে তিনি বাজি রাখেন স্ত্রী দ্রৌপদীকে। এবারও হেরে গিয়ে তিনিও দাসীতে পরিণত  হলেন। দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন অন্তঃপুর থেকে দ্রৌপদীকে চুল ধরে টেনে আনলেন সভায় । আশ্চর্যের হলেও সত্য,সভায় উপস্থিত ধার্মিক ভীষ্ম, দ্রোণ, অঙ্গরাজ কর্ণ, বিদুর,কোন প্রতিবাদ করলেন না। দুর্যোধনের এক ভাই বিকর্ণ এর প্রতিবাদ করলেও তা সিন্ধুতে বিন্দু মাত্র।। নির্যাতনের আরও চমক অপেক্ষা করছিল। দুঃশাসন দ্রৌপদীকে সভার মাঝে সবার সামনে বস্ত্রহীন করতে গেলেন।  অসহায় দ্রৌপদী ভগবান কৃষ্ণকে স্মরণ করলে  তিনি মায়াবলে দ্রৌপদীর গায়ে কাপড় জড়িয়ে তার সম্মানরক্ষা করেন।
তখন ধৃতরাষ্ট্র ভয়ভীত হয়ে পাণ্ডবদের সকল সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন। তাতে দুর্যোধন অসন্তুষ্ট হলেন। আবার পাশা খেলার আয়োজন হল। ঠিক হল, এবার পাণ্ডবরা হেরে গেলে তাদের জন্য ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাস নির্ধারিত হয়। স্থির হল, এই বনবাসকালে কৌরবরা পাণ্ডবদের সমস্ত সম্পত্তি ভোগ করবে। আর অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবদের নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে, ধরা পড়লে পাণ্ডবদের আবার ১২ বছর বনবাস ভোগ করতে হবে।
 
মনে রাখতে হবে যে অন্যায় পাশা খেলা ও দ্রৌপদীকে বিবস্ত্রা করতে চেষ্টা করছেন দুঃশাসন এটি মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা করুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরিণতি লাভ করে। এই পাশা খেলার ঘটনার পিছনে  প্রধান পরামর্শক  ছিলেন শকুনি ।লাঞ্ছনার সময় দ্রৌপদী তিনি কেঁদেছিলেন যে তিনি একবস্ত্রা ও রজস্বলা তাঁকে এই অবস্থায় যেন সভায় না নেওয়া হয়। কিন্তু দুঃশাসন তাঁর কথা শোনেন নি ।  শুধু তাই নয়, কর্ণও এই সভায় কৌরবদের হয়ে দ্রৌপদীকে অপমান করেন। কর্ণ বলেন স্ত্রীদের এক স্বামীই বেদবিহিত । যেহেতু দ্রৌপদীর অনেক স্বামী তাই তিনি বেশ্যা। দ্রৌপদী স্বয়ম্বর সভায় কর্ণকে সারথি বলে অংশই নিতে দেননি। সেই ক্রোধ কর্ণের বরাবরই ছিল। এ যেন তারই প্রতিফলন। দুর্যোধন তাঁর ঊরু দেখিয়ে দ্রৌপদীকে অপমান করলে ভীম তাঁর ঊরুভঙ্গ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন।

পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments