জ্বলদর্চি

আমেরিকান লেখক কেট চপিনের গল্প/শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

আমেরিকান লেখক কেট চপিনের গল্প: ঘন্টা খানেক

ভাষান্তর: শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার
অলংকরণ: সুমন মজুমদার

মিসেস ম্যালার্ডের হার্টের অবস্থা বিশেষ ভালো নয় বলে তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ তাঁকে জানানো হল অতি সন্তর্পণে। বোন জোসেফিন কিছু অবিন্যস্ত টুকরো টুকরো কথায়, অস্পষ্ট ইঙ্গিতে কোনরকমে খানিকটা আড়াল করেই যেন বলল সবটুকু। মিসেস ম্যালার্ডের স্বামীর বন্ধু রিচার্ড তখন তাঁর কাছেই ছিলেন। ট্রেন দুর্ঘটনার খবরটা যখন সংবাদপত্রের দপ্তরে এসে পৌঁছায় রিচার্ড সেখানে উপস্থিত। মৃতদের তালিকার প্রথমেই ছিল ব্রেন্টলি ম্যালার্ডের নাম। দ্বিতীয় টেলিগ্রামে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তিনি তড়িঘড়ি ছুটে আসেন পাছে কোনো অসংবেদনশীল, অর্বাচীন বন্ধু দুঃসংবাদটি বয়ে আনে। 

  এই খবর শুনে আকস্মিক আঘাতে আর পাঁচজনের মতো মিসেস ম্যালার্ডের হাত পা অবশ হয়ে গেল না। তিনি কেঁদে উঠলেন।  নিজেকে পুরোপুরি যেন ছেড়ে দিলেন জোসেফিনের দুই হাতের আশ্রয়ে। শোকের প্রাবল্য একটু স্তিমিত হতেই তিনি এগোলেন তাঁর ঘরের দিকে। সঙ্গে নিলেন না কাউকে। তাঁর ঘরে খোলা জানলার মুখোমুখি একটা আরামদায়ক হেলানো চেয়ার ছিল। সেটার মধ্যে ডুব দিলেন পুরোপুরি। অতিরিক্ত শারীরিক ধকলে শুধু শরীর নয়, আহত হয়েছে মনও।

  বাড়ির সামনের চৌকোনা খোলা অংশ ছাড়িয়ে তাঁর দৃষ্টি ছুঁয়ে দিল তরুরাজির উন্নত শির যারা মুহুর্মুহু কেঁপে উঠছে জীবনের স্পন্দনে। বৃষ্টির সুবাসে ম ম করছে বাতাস। নীচের রাস্তায় শোনা যায় ফেরিওয়ালার নিত্যকারের হাঁকডাক। কোনো অজানা গায়কের মৃদুগানের সুর ভেসে আসছে বহুদূর থেকে। কার্নিশে অগুনতি চড়ুইয়ের কিচিরমিচির।
 পশ্চিমের জানলায় মেঘের পরে মেঘ জমেছে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো নীল আকাশের উঁকিঝুঁকি। কুশনের উপর মাথাটা হেলিয়ে বসে আছেন মিসেস ম্যালার্ড। স্তব্ধ। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়া শিশুরা যেমন স্বপ্নের মধ্যেও ফোঁপায় তেমনই মাঝে মাঝে গলার কাছে উঠে আসছে ভাঙা কান্না আর কেঁপে উঠছেন তিনি থেকে থেকেই। মিসেস ম্যালার্ড যুবতী। ভারি সুন্দর মুখখানিতে অবদমন আর আত্মশক্তি মিলে মিশে থাকে। কিন্তু এখন তাঁর ঘোলাটে দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে দূর নীলিমায়। এ কোনো ভাবুকের দৃষ্টি নয়, বরং বোঝা যায় থমকে গেছে সব সচেতন চিন্তাসূত্র।

  কিছু যেন আসছে তাঁর কাছে। গভীর আশঙ্কায় তিনি যেন প্রতীক্ষায়। সেটা যে কি তা তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। যা বড়ই সূক্ষ্ম আর অধরা। কিন্তু তিনি অনুভব করতে পারছেন। বাতাস ছেয়ে থাকা শব্দ গন্ধ আর রঙের প্রলেপ মেখে তাঁরই কাছে যে তা নেমে আসছে আকাশ ‌‌‌বেয়ে।

  বুকের মধ্যে ধীরে ধীরে আলোড়ন ওঠে। তাঁকে ঘিরে আসা অনুভূতিদের ক্রমশ চিনতে পারছেন মিসেস ম্যালার্ড। ভেতরের শক্তি দিয়ে তিনি ফেরত পাঠাতে চাইছেন তাদের। কিন্তু এখন  মনের জোর তাঁর দুর্বল শ্বেত শুভ্র বাহুর মতোই নড়বড়ে। যখনই তিনি ছেড়ে দিলেন নিজেকে ফিসফিসিয়ে কিছু কথা বেরিয়ে গেল দ্বিধাবিভক্ত দুই ঠোঁটের ফাঁক গলে। 
-"মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি!"

  একবার নয়, বারবার শ্বাসের আড়ালে ধ্বনিত হল তারা। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর শূন্য ভয়ার্ত দৃষ্টি উধাও হয়ে চোখদুটো হয়ে উঠল তীব্র ও উজ্জ্বল। দ্রুত স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ল শিরায় শিরায়। রক্ত সঞ্চালনে যুগপৎ উদ্দীপিত ও প্রশমিত হল প্রতিটি দেহ কোষ। 
কোন আশ্চর্য আনন্দ আজ তাঁকে ভরিয়ে রেখেছে সেই খোঁজ নিষ্প্রয়োজন। এক স্বচ্ছ সুগভীর উপলব্ধির আলোয় তুচ্ছ হয়ে গেল বাকি সবটুকু। তিনি জানেন সেই নিষ্প্রাণ কোমল হাতগুলো তাঁর চোখের সামনে এলে আবারও তিনি কাঁদবেন। সেই চেনা মুখ যেখানে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই খোঁজেননি তিনি তা এখন চির স্থির ধূসর মৃত। কিন্তু এই বিষাদ মুহূর্তগুলোকে ছাপিয়ে সামনে ভেসে উঠছে অনাগত দীর্ঘ দিনের সারি যা এখন থেকে একেবারেই তাঁর নিজস্ব। উন্মুক্ত দুই বাহুকে প্রসারিত করলেন দূরাগত আগামীকে অভ্যর্থনা জানাতে। 

  এখন থেকে একমাত্র নিজের জন্য বাঁচবেন তিনি। নিজের মতো করে। তাঁকে আর অন্য কারো ইচ্ছে অনিচ্ছের কাছে মাথা নোয়াতে হবে না। সেই এক প্রবল উপস্থিতি যার দাপটে নুয়ে থাকে অপর সঙ্গীটি। লক্ষ্য ভালো মন্দ যাই হোক না কেন নারী পুরুষ নির্বিশেষে পাশের মানুষটির উপর এমন অধিকার কায়েম করাকে এই ক্ষণকালের আলোকময়তায় নিতান্তই অপরাধ বলে মনে হল মিসেস ম্যালার্ডের।
যদিও তিনি কখনও কখনও তাঁর স্বামীকে ভালোবাসতেন। অনেক সময় হয়ত ভালোবাসতেনও না। তাতেই বা কি আসে যায়! ভালোবাসা নামক চির রহস্যময় অনুভূতির এখন তেমন কিছুই আর করার নেই বিশেষতঃ মিসেস ম্যালার্ড যখন তাঁর আত্মচেতনাকেই হঠাৎ নিজের সর্বাধিক শক্তিশালী প্রবৃত্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। "মুক্ত! শরীর মন সব সব! " তিনি ফিসফিসিয়ে উঠলেন।

  এদিকে বন্ধ দরজার বাইরে জোসেফিন বসেছে হাঁটুগেড়ে। চাবির গর্তের কাছে মুখ নামিয়ে অনুনয় বিনয়ে দিদির ঘরে ঢোকার অনুমতি চাইছে। 
-"লুইস, দরজা খোলো! আমার অনুরোধ প্লিজ দরজা খোলো। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। কি করছ লুইস? ঈশ্বরের দিব্যি দরজা খোলো।"
-"চলে যাও। আমি অসুস্থ হব না।
সত্যিই তাই। খোলা জানলা দিয়ে আসা নতুন জীবনের আস্বাদ পেয়েছেন তিনি। আগামী দিনগুলোর ভাবনায় আলোড়িত হয়ে উঠেছে মন। গোটা বসন্ত আর গ্রীষ্মের দিনগুলো এবং আরো আরো রংবেরং এর দিন এখন থেকে সব তার নিজের। অতি দ্রুত তিনি প্রার্থনা জানান দীর্ঘ জীবনের। এই তো গতকালও দীর্ঘায়ু হওয়ার ভাবনায় কেঁপে উঠেছিলেন তিনি।
চেয়ার থেকে ঋজুদেহে উঠে বোনের অনুরোধে দরজা খুলে দিলেন। তাঁর চোখে মুখে বিজয়ীর উষ্ণতা ফুটে উঠছিল। নিজের অজ্ঞাতসারেই হয়ে উঠেছিলেন জয়ের দেবী। বোনের কোমড় জড়িয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকলেন তিনি সিঁড়ি দিয়ে। নীচের তলায় রিচার্ড অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের জন্য। 

  কেউ একজন হুড়কো ঘুরিয়ে সামনের দরজাটা খুলছিল। সামান্য ভ্রমণক্লান্ত ব্রেন্টলি ম্যালার্ড তাঁর ব্যাগ আর ছাতা হাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন। দুর্ঘটনাস্থল থেকে তিনি বহুদূরে ছিলেন। এমনকি দুর্ঘটনার কোনো খবরও তিনি জানেন না। জোসেফিনের তীব্র চিৎকারে এবং তাঁর স্ত্রীর দৃষ্টি থেকে তাঁকে আড়াল করার জন্য রিচার্ডের অতিদ্রুত সরণের দিকে তাকিয়ে হতচকিত হয়ে গেলেন তিনি।
ডাক্তাররা এসে জানালেন, হার্টের অসুখেই মৃত্যু হয়েছে মিসেস ম্যালার্ডের। আনন্দই তাঁর মৃত্যু ডেকে আনল।

লেখক পরিচিতি: কেট চপিন ১৮৫০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি আমেরিকার লুসিয়ানা প্রদেশের মিসৌরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। স্বামীর অকাল মৃত্যু, আর্থিক বিপর্যয় এবং অল্পকাল পরেই মাতৃবিয়োগে ছয় সন্তানের জননী কেট যখন ডুবে আছেন গভীর অবসাদে তখন পারিবারিক এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে লিখতে শুরু করেন মনের শুশ্রূষা ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে আর হয়ে ওঠেনি নারী জীবনের ভাষ্যকার।

অনেকের মতে তিনিই আমেরিকার প্রথম নারীবাদী লেখিকা। তাঁর ছোটগল্পগুলো এই মতামতের স্বপক্ষে দাঁড়ায়। ছোটগল্পে দক্ষতার পরিচয় দিলেও তিনি মূলত বিখ্যাত হন তাঁর উপন্যাস "দ্য অ্যাওকেনিং"(১৮৯৯) এর সৌজন্যে। তাঁর আরো একটি উপন্যাস "অ্যাট ফল্ট" প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালে। দুটি ছোটগল্পের সংকলন "বেইউ ফোক" ও "আ  নাইট ইন অ্যাকাডি" প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৯৪ ও ১৮৯৭ সালে। কেট চপিনের বিখ্যাত কয়েকটি ছোটগল্পের অন্যতম "দ্য স্টোরি অফ অ্যান আওয়ার"। এই গল্পটিই অনুবাদ করা হয়েছে। ছোটদের জন্যও বেশ কিছু গল্প লিখেছেন তিনি।
 ১৯০৪ সালের ২২শে অগাস্ট মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে একশ বছরেরও বেশি সময়। আজও সংবেদনশীল পাঠক হৃদয়ে তাঁর স্থান অক্ষয়।

পেজ- এ লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments