বিপ্লবী অচল সিং সংগ্রামী চেতনার এক জ্বলন্ত ইতিহাস
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
ভারতের স্বাধীনতা মুক্তি যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন এমন কিছু বীর বিপ্লবী সৈনিক বা নেতা আছেন যাঁদের কথা আমরা বিশেষ করে মনে রাখিনি বা ইতিহাসের পাতায় তেমন স্থান পাননি; চিরদিন যাঁরা রয়ে গেছেন আমাদের নেপথ্যে – মানবেতিহাসের অন্তরালে। অথচ এই সব মুক্তি যোদ্ধারা দেশের মুক্তির জন্যে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, ব্রিটিশ শাসনের অকথ্য-বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, অসম সাহস বুকে নিয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে দৃঢ় পদক্ষেপে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ভারত মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য ফাঁসিকাঠে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন। এরকমই একজন মুক্তিকামী বীর যোদ্ধা হলেন অচল সিং। তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক ‘নায়েক বিদ্রোহে’র বা ‘লায়কলি বিদ্রোহে’র মূল নেতা এবং বগড়ী রাজ্যের তত্কাহলীন রাজা ছত্রসিংহের প্রধান সেনাপতি।
ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের গোড়ার দিকের কথা। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের সাথে সাথে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছে। ইংরেজদের হাতে বাঁধা পড়েছে গোটা ভারত সাম্রাজ্য। এর বেশ কয়েক বছর পর এবং ইতিহাস বিখ্যাত ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ ও ‘নীল বিদ্রোহ’ ঘটনার কিছু সময় আগেকার কথা। হ্যাঁ, ১৮০০-১৮২০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়টা হবে। ব্রিটিশ শাসকরা যখন তাদের শক্ত শিকড় প্রোথিত করতে চাইছে ভারতের শহর-নগর ও গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে ঠিক সেই সময়ের কথা।
এই সময়েই স্বাধীনতা যুদ্ধের পীঠভূমি মেদিনীপুর জেলার উত্তরাঞ্চলের গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, রামজীবনপুর প্রভৃতি স্থান জুড়ে এখানকার রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে চাষি, তাঁতি, জেলে, নায়েক, মাজি ইত্যাদি তথাকথিত নিম্নশ্রেণির লোকেরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
বগড়ী পরগণার গড়বেতা ও তত্সংণলগ্ন এলাকার অধিবাসীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার, নারীদের উপর দানবিক নির্যাতন, তাদের চাষের জমিতে জোর করে তুঁত ও নীল চাষ করানো, ঘাটোয়াল, পাইক জঙ্গল ভূস্বামীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, জমির খাজনা বৃদ্ধি, তন্তুবায় সম্প্রদায়ের জাতীয় বৃত্তিতে হস্তক্ষেপ এবং তাদের আঙুল কেটে নেওয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদই ছিল এই ‘নায়েক বিদ্রোহ’। আর এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন রাজা ছত্রসিংহের নির্ভীক এবং যোগ্যতম সেনাপতি অচল সিং। স্বার্থ সুখের পাঁচিল টপকে তিনি তথাকথিত নিচু ও অনুন্নত শ্রেণির মানুষগুলোকে নিয়ে জোট বাঁধেন এবং গড়ে তোলেন সংগঠন। সেই সংগঠন নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে এবং ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর কাজে। দোর্দন্ডপ্রতাপশীল নায়েক ভ্রাতৃদ্বয় যুগল,কিশোর সহ হাবল, ফাগু, রাজেন্দ্র প্রমুখ অসংখ্য নায়েক বীর তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। এইসব বীর নেতারা ইংরেজদের চোখে বিদ্রোহী ও ডাকাত নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এঁদের নেতৃত্বে ‘নায়েক বিদ্রোহ’ ইংরেজদের অবাধ চলাফেরার পথে প্রচণ্ডরকম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা অবাক হয়ে যায় এই বীরদের অসীম সাহস ও বীরত্ব দেখে।
অচল সিংহের নেতৃত্বে নায়েক বিদ্রোহের জ্বলন্ত আগুন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে দুর্বার আকার ধারণ করে মেদিনীপুরের উত্তরাঞ্চলে। শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ সরকারের স্বপ্নকে ভেঙে তছনছ করে দেবার জন্য গোপনে নায়েক বীররা গনগনির খুলা, বনকাটা, গড়বেড়িয়া, মালবান্দি, পাথরাসিনি এবং চন্দ্রকোণা থানার এখানে ওখানে গড়ে তোলে অসংখ্য দুর্গ এবং লায়কালিগড়। সেই সঙ্গে নির্মিত হয় বগড়ীর জঙ্গলে ও গড়বেতার গণগনি ডাঙাতে বিখ্যাত নায়েক শিবির। এইসব গোপন শিবির বা গুপ্ত ঘাঁটিতেই নায়েক বীরদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য যা কিছু মজুত থাকতো এবং নিজেরা লুকোতো। এই লায়কালি গড় থেকেই বের হয়ে ইংরেজদের উপর আঘাত হানত তারা।
নায়েক বীরদের বিদ্রোহে ইংরেজ সরকার প্রমাদ গুনল। তারাও থেমে থাকল না। তাদের আক্রমণে ও বোমার আঘাতে ধ্বংস হল বেশ কিছু লায়কালিগড়। আরও অসংখ্য ইংরেজ গোরা সৈন্য বিদ্রোহ দমনের জন্য ছুটে এল মেদিনীপুরের এই উত্তরাঞ্চলে। বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার জন্য চন্দ্রকোণার উত্তরদিকে বসনছোড়ার অন্তর্গত ৬৮ নং মৌজা
২
ফাঁসিডাঙাতে বিশাল বটগাছের তলায় ইংরেজরা সৃষ্টি করল এই সুউচ্চ ফাঁসির মঞ্চ। বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রথমদিকে যাঁরা ধরা পড়েন ইংরেজদের হাতে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার আর অমানুষিক নির্যাতনের জ্বালায় বলতে বাধ্য হলেন নায়েক বিদ্রোহীদের প্রথম সারির নেতাদের নাম। এঁদের কাছ থেকেই ইংরেজরা জানতে পারে অচল সিং, যুগল, কিশোর, সুবল, ফাগু, হাবল, রাজেন্দ্র প্রমুখ বিদ্রোহীদের নাম। ইংরেজ সরকার কড়া নজর রাখতে শুরু করে এইসব নেতাদর উপর।
নায়েক বিদ্রোহীদেরই কয়েকজনের বিশ্বাসঘাতকতায় ও চন্দ্রকোণার তত্কাজলীন দারোগা কুচক্রী নিত্যানন্দ সিংহের সহায়তায় একটি লায়কালি গড় থেকে ধরে আনা হয় আঠারো কাহন অর্থাত্ ২৩০৪০ জন ডাকাতদলের সর্দার নায়েক বিদ্রোহীদের অন্যতম নেতাগণ যুগল, কিশোর, সুবল, ফাগু সহ অসংখ্য বীর নায়েককে। নিয়ে আসা হয় ফাঁসিডাঙার ফাঁসি মঞ্চে। বীর নায়েকদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়, কাউকে বুলেটের গুলিতে শেষ করা হয়, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কাউকে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হয়, কয়েকজনকে বটগাছের ডালে ডালে গলায় দড়ি দিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। যুগল-কিশোর সহ কয়েকজন প্রধান নেতার দেওয়া হয় ফাঁসি।
নায়েক বিদ্রোহের এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে যুক্ত সন্দেহে এবং সেনাপতি অচল সিংকে ধরিয়ে দিতে অস্বীকার করার অপরাধে সুচতুর ইংরেজ সরকার বগড়ীর শেষ স্বাধীন রাজা ছত্র সিংহকে জোর করে রাজ্যচ্যুত করে এবং হুগলী জেলে প্রেরণ করে। এইভাবে বগড়ী রাজ্য চলে আসে ইংরেজদের অধিকারে। এরপরই একের পর এক তারা ধ্বংস করে চলে বিদ্রোহীদর যত গুপ্তঘাঁটি ও নায়েক শিবির। বোমার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় গড়বেতার গণগনি ডাঙার বিখ্যাত নায়েক শিবিরও। অগণিত বীর নায়েকের বুকের রক্ত দিয়েও ইংরেজদের আক্রমণ রোধ করতে পারলেন না। একরাশ শূন্যতা ও হাহাকার বুকে নিয়ে শোকাহত অচল সিং এখানে ওখানে লুকিয়ে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু ইংরেজদের চোখকে এড়িয়ে বেশিদিন থাকতে পারলেন না। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়-ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন ও বিধ্বস্ত অবস্থায় একদিন ধরা পড়লেন।
১৮১৬ খ্রিস্টাব্দ। অচল সিংকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুর। সেখানে পুরাতন জেলখানা সংলগ্ন মাঠ অর্থাত্ মারাঠা দুর্গে ইরেজরা তাঁর ফাঁসি দেয়। এইভাবেই এক মর্মস্পর্শী ঘটনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সৈনিক এবং নায়েক বীরের মহান জীবন। দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যাঁর অসাধারণ আত্মত্যাগ, দুরন্ত দেশপ্রেম এবং সংগ্রামী চেতনা গড়বেতার বুকে আজ এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে সম্প্রতি গড়বেতায় তৈরি হয়েছে ‘অচল সিং সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গন’। গড়বেতা মেলা থেকে শুরু করে যাবতীয় খেলাধূলা ও সাস্কৃতিক চর্চা বর্তমানে এই স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
পেজ-এ লাইক দিন👇
0 Comments