জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বৈষ্ণব কবি (১ম পর্ব)/ ড. বিভাস মণ্ডল

মেদিনীপুরের বৈষ্ণব কবি
১ম পর্ব 

ড. বিভাস মণ্ডল

শ্রীকৃষ্ণপ্রেম প্রদানের মধ্য দিয়ে জগতবাসীকে কৃষ্ণ ভাবনায় ভাবিত করেছিলেন শ্রীমন্মহাপ্রভু। তাঁর ভাবধারায় মেদিনীপুরবাসী দারুণভাবে অভিসিঞ্চিত হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে বহু অনুরাগী ভক্তবৃন্দ তাঁর রূপমাধুর্য- গুণমাধুর্য- প্রেমমাধুর্য সর্বোপরি নামমাধু্র্যে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন। কাটোয়ায় শ্রী কেশবভারতীর নিকট ১৫১০ সালে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে তিনদিন রাঢ়দেশে, চৌদ্দদিন শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের গৃহে, একদিন আটিসারাতে শ্রীল অনন্ত পণ্ডিতের গৃহে, পরদিন ছত্রভোগ থেকে রাত্রি তৃতীয় প্রহরে তমলুকের উদ্দেশে নৌকাযোগে যাত্রা করেছিলেন। ৯১৬ বঙ্গাব্দের ২০ ফাল্গুন তথা ১৫১০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ভোরে তমলুকের প্রয়াগঘাটে পদার্পণ করেন। ১৫১৫ সালের এপ্রিল মাসে পুরীধাম যাত্রা কালে মহাপ্রভু দ্বিতীয়বার তমলুকে আসেন। তাঁর পবিত্র চরণ স্পর্শ দু' বার মেদিনীপুরবাসী লাভ করেছিলেন। প্রথমবারে তাঁর সঙ্গী ছিলেন নিত্যানন্দ, জগদানন্দ পণ্ডিত, দামোদর পণ্ডিত এবং মুকুন্দ দও।----
   "নিত্যানন্দ গোসাঞি, পণ্ডিত জগদানন্দ।
দামোদর পণ্ডিত আর দও মুকুন্দ।।-- চৈ. চ. মধ তৃতীয়
মেদিনীপুরের আদিকবি শ্রীল বাসুদেব ঘোষ ঠাকুর-- 
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচলে অবস্থানকালে তাঁর পার্ষদদের গৌড়মণ্ডলে ভক্তিধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন। সেই সকল পার্ষদদের মধ্যে নিত্যানন্দপ্রভু, বাসুদেব ঘোষ, গোবিন্দ ঘোষ, মাধব ঘোষ, রামদাস, গদাধর দাস, রঘুনাথ, কৃষ্ণদাস পণ্ডিত, পরমেশ্বর দাস, পুরন্দর পণ্ডিত ছিলেন অন্যতম। শ্রীনিত্যানন্দপ্রভুর গৌড়ে ধর্ম প্রচারকালে বাসুদেব ঘোষ ঠাকুর তমলুকে আগমন করেন। মহাপ্রভু প্রথম ও দ্বিতীয়বার তমলুকের যে স্থানে এসে বিশ্রাম করেছিলেন, সেই স্থানে( বর্তমানে শ্রী শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু মন্দির) এসে তিনি নিবাস তথা ' শ্রীপাট' স্থাপন করে ভজন করতে থাকেন। বাসুঘোষের তিন ভাই মহাপ্রভু কে গীত বাদ্যে আনন্দ দিতেন। বাসুদেব ও মাধব অত্যন্ত সুকন্ঠের অধিকারী ছিলেন। বাসুদেব জন্মসূত্রে মেদিনীপুরের অধিবাসী নন। এঁরা তিন ভাই, গোবিন্দ- মাধব ও বাসুদেব। এঁদের পূর্বপুরুষ কুমারহট্টবাসী ছিলেন। তবে বাসুদেব ঘোষ শ্রীহট্টের বুড়ন গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তমলুকে অবস্থান করে তিনি বিভিন্ন স্থানে মহাপ্রভুর শুদ্ধ ভক্তি ধর্ম প্রচারের কাজে ব্যাপৃত থাকেন। সেই সময় থেকে তিনি সস্ত্রীক গৌরাঙ্গভজনে জীবন উৎসর্গ করেন। তমলুকে থাকাকালে বাসুদেব বাংলা ও ব্রজবুলি ভাষায় ২২৬ টির মতো পদ রচনা করে মেদিনীপুরের আদি কবিরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। 

   মহাপ্রভুর ভাববিহ্বলতার অবস্থানুসারে তাঁর পদগুলি রচিত। বাসুদেবের পদের মধ্যে শ্রীনিত্যানন্দমহিমা বিষয়ক পদ, শ্রীগৌরাঙ্গ মহিমা বিষয়ক, গৌরের আবির্ভাব, বাল্য, কৈশোর, যৌবনবিষয়ক লীলা, শ্রীবাসগৃহে অভিষেকাদি নবদ্বীপলীলা বিষয়ক, শয়নলীলা বিষয়ক, ব্রজভাবে ভাবিত শ্রীগৌরাঙ্গের লীলাবিষয়ক, গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস ও শান্তিপুর আগমন বিষয়ক, বিষ্ণুপ্রিয়ার দ্বাদশ মাসিক বিরহ বিষয়ক, শ্রীক্ষেত্রলীলা বিষয়ক ও অন্যান্যবিষয়ে বাসুদেব ঘোষের পদ রয়েছে। 

   তবে এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, 'গৌরচন্দ্রিকা' বিষয়ক পদের আদি স্রষ্ট্রা পদকর্তা শ্রীবাসুদেব ঘোষ ঠাকুর। 

   নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ পার্ষদ বাসুদেব স্বচক্ষে মহাপ্রভুকে দীর্ঘকাল দেখেছেন। তাই তাঁর পদের মধ্যে মহাপ্রভু জীবন্তরূপে উদ্ভাসিত। সেদিক থেকে পদগুলোর কাব্যমূল্য ও ঐতিহাসিক মূল্য অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে " গৌরাঙ্গ সম্বন্ধীয় পদাবলী রচয়িতাগণের মধ্যে বাসুদেব শীর্ষস্থানে।" বাসুদেব ঘোষের পদগুলো বিভিন্ন বৈষ্ণব পদসংকলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- গৌরপদতরঙ্গিনী, ক্ষণদাগীতচিন্তামণি, রসমঞ্জরী, পদকল্পতরু, পদরত্নমালা, পদামৃতসমুদ্র, পদরত্নাকর, গীতরত্নাবলী, পদমেরু, সংকীর্ত্তনামৃত প্রভৃতি। বৈষ্ণব পদাবলী ছাড়াও তিনি অত্যন্ত সুললিত ও মর্মস্পর্শী ভাষায় রচনা করেন 'গৌরাঙ্গচরিত' ও 'নিমাইসন্ন্যাস' নামে দু'খানি গ্রন্থ।

শ্রীল মাধব ঘোষ

শ্রীল মাধব ঘোষ গৌরপার্ষদ শ্রীল বাসুদেব ঘোষের মধ্যম ভ্রাতা। ইনি মহাপ্রভুর আদেশে কাটোয়ার নিকটস্থ দাঁইহাটে বসবাস করেছিলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা শ্রীবাসুদেব ঘোষ ঠাকুর ও মাতৃতুল্যা শ্রীমতী ঘোষ ঠাকুরাণীর তিরোধানের কথা শ্রবণ করে মাধব ঘোষ দাঁইহাট থেকে তমলুকে দ্রুত আগমন করে শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সেবার ভার গ্রহণ করেন। তখন থেকেই মহাপ্রভুর সেবা করতে থাকেন। পরম বিষ্ণু ভক্ত তমলুকের রাজা রাম ভুঞ্যা রায় তৎকালীন সময়ে নব নির্মিত শ্রী শ্রী হরিবিষ্ণু মন্দির ও শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের একমাত্র আচার্য সেবাইৎ রূপে শ্রীমাধব ঘোষ ঠাকুরকে সেবা ভার অর্পণ করেন। তখন থেকে মাধব ঘোষ ঠাকুর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু জীউ, হরিবিষ্ণু জীউ এবং শ্রী শ্রী জগন্নাথ জীউর সেবাকার্য অত্যন্ত সুচারু রূপে সম্পন্ন করতে থাকেন।

  "তমোলোকে মাধব ঘোষের দেবালয়।
হরিবিষ্ণু জগন্নাথ গৌরাঙ্গ আশ্রয়।।" ----- শ্রীপাট নির্ণয়
মাধব ঘোষ ঠাকুর তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাসুদেব ঘোষ ঠাকুরের ন্যায় বিদ্বান ও সুকন্ঠী ছিলেন। মহাপ্রভুর কৃপাশীর্বাদ স্বরুপ তিনি দিব্য অভঙ্গ স্বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই তমলুকে অবস্থান কালেই তিনি ১৪ টি পদ রচনা করেন। গৌর বিষয়ক পাঁচটি ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক নয়টি পদ। তাঁর পদগুলো পদকল্পতরু, গীত রত্নাবলি, রসমঞ্জরী, পদরত্নমালা , পদামৃত সমুদ্র ও পদরত্নাকর প্রভৃতি গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মাধব ঘোষ বাংলা ও ব্রজবুলি দুই ভাষাতেই পদ রচনা করেছেন।
পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments