জ্বলদর্চি

প্রসঙ্গ সত্যজিৎ রায় ও লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ/অচিন্ত মারিক

প্রসঙ্গ সত্যজিৎ রায় ও লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ

অচিন্ত মারিক

সত্যজিতের তিন প্রজন্ম ছবি আঁকার সাথে প্রচ্ছন্নভাবে যুক্ত ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন সেই বংশগতির ধারাবাহিকতার উজ্জ্বল প্রজন্ম। আমরা গর্ব করতে পারি যে, ছবি, নকশা ছাপার ফটোগ্রাফিক-যান্ত্রিক পদ্ধতির উদ্ভাবন প্রচেষ্টায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গবেষণা কর্ম সেকালে বহুলোকের আলোচনার বিষয় ছিল। রীতিমত চর্চা ছাড়াই তাঁকে ছবি আঁকতে হয়েছিল, তিনি এঁকেও ছিলেন, তবে প্রথাগত শিক্ষা থাকলে দুর্বলতাগুলি থাকত না। পরের প্রজন্ম সুকুমার রায়ের অধিকাংশ ছবিই ছিল ড্রইং বা স্কেচ। রেখা সাবলীল না হওয়ায় ড্রইং দুর্বল বলে মনে হত। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরের ড্রইং অনেক সাবলীল ছিল। তাই ইলাস্ট্রেশনও অনেক প্রাণবন্ত মনে হত।
 অপরদিকে গড়পারের বংশগতির তৃতীয় প্রজন্ম হলেন সত্যজিৎ। তাঁর ইলাস্ট্রেশন অনেক বলিষ্ঠ এবং আধুনিক – যে কোন এ্যাঙ্গেল থেকেই সপাটে ভারতীয়ত্ব ধরা পড়ে। সাধারণ বিচারে আজকাল 'ছবি' এবং 'ইলাস্টেশন'-এর মধ্যে যে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা বেশি দিনের অনুশাসন নয়। তফাত যেটা তা আগেও ছিল এখনও আছে, কিন্তু সেটা আসল ব্যাপার নয়, আসল ব্যাপার হল গুণগত মান। ছবি যেখানে একান্তভাবে লিখিত শব্দের উপর নির্ভরশীল তাকে ঠিক 'ইলাস্ট্রেশন' বলা যায় না-- কারণ লিখিত শব্দের সাহায্য ছাড়া ছবির মানে করা মুশকিল, সেখানে শুধু ঘটনার বিবরণ থাকে। সুকুমার রায়ের সেই ধরনের একটি ইলাস্ট্রেশন এখানে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ইলাস্ট্রেশন সেরকম নয়। আমরা ফেলুদা সিরিজের গল্পগুলোতে যে ইলাস্ট্রেশন দেখেছি তাতে ঘটনার বিবরণ লেখার প্রয়োজন হয় না। সেখানে অনুভব সঞ্চারিত হয়, ইঙ্গিত ও সংকেত কল্পনাকে উসকে দেয়। ভাবায়, চিন্তার খোরাক জোগায়। এই বর্ণনার ছবি লিখিত বা সংকেত চিহ্নের সাহায্য ছাড়াই কাহিনির বিবরণ দিতে পারে। সেই সঙ্গে পারে সম্ভ্রম আদায় করে নিতে। শিল্পের শর্তের জন্যই ছবির বর্ণনার মধ্যে ছবি হয়ে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়।
  আমেরিকান ও ব্রিটিশ সমালোচকরা দ্বিধান্বিত হয়ে প্রায়ই বলেন, 'The Illustrator Satyajit is always more rich as The Director Satyajit be.' সত্যজিৎ ১৯২১ সালে লেখক-কবি আলংকারিকের ঘরানায় জন্মগ্রহণ করেন। একটা সময় ছিল যখন কলকাতা ও বাঙালি লেখক-শিল্পীরা নবজাগরণের প্রভাবে বিদেশী বুদ্ধিমত্তাকে নিজেদের শিল্পকলায় প্রকাশ করতে উদ্‌গ্রীব ছিলেন, কিন্তু সেই সময় সত্যজিৎ ছিলেন ব্যতিক্রমী একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী। প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হবার পর তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর কলাভবনে অঙ্কন শিখতে এলেন। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মত শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আসার পর তাঁর শিল্পকে এই শিক্ষকেরা প্রথমেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন academic style of painting-এর তকমা চাপিয়ে। তাঁরা চাইলেন নিজস্ব সৃষ্টির প্রকটতা এবং অবশ্যই ভারতীয় ঘরানার শৈল্পিক হাত ধরে। সত্যজিৎ তারপরেই হয়ে উঠলেন visual culture-এর প্রকৃত ভারতীয় ছাত্র। দ্রুত ভারতীয় লোকশিল্প আয়ত্ত করে ফেললেন তিনি।

  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমা-বর্ষণ মাথায় নিয়ে ২২ বছর বয়সে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা D. J. Keymer (বর্তমান নাম Ogilvy & Mather)-এর কলকাতা শাখায় জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার পদে মাসে আশি টাকা বেতনের চাকরিতে ঢোকেন। অন্য শিল্পীরা যখন পাশ্চাত্য শিল্পের আদলে বিজ্ঞাপনের কাজ করছেন চুটিয়ে, তখন সত্যজিৎ সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপন শিল্পের জগতে ভারতীয় লোকশিল্পের মোটিফ (অলংকার) এবং ক্যালিগ্রাফি (হস্তলিপিবিদ্যা)-র সৌন্দর্য দিয়ে বাজিমাত করেছিলেন। প্রস্তুতকারক এবং গ্রাহক উভয় পক্ষই সাবান, বিস্কুট, কেশতেল বা সিগারেটের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন। বিজ্ঞাপনের মধ্যে ভারতীয়ত্ব খুঁজে পেয়ে সবাই আহ্লাদিত --পাশ্চাত্য গাম্ভীর্যের Hangover কেটে যাচ্ছিল ষোলোআনা বাঙালিদেরও।
  শান্তিনিকেতনে হস্তলিপিবিদ্যা শিক্ষাগ্রহণের পর থেকে সত্যজিৎ নিজেকে সর্বত্র মেলে ধরতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালে একটি আন্তর্জাতিক টাইপোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় তিনি দুটি রোমান স্ক্রিপ্ট Ray Bizarre এবং Ray Roman আবিষ্কার করে সেই প্রতিযোগিতা জিতে নিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি আরও দুটি স্ক্রিপ্ট Holiday এবং Daphnis আবিষ্কার করেছিলেন।

 সত্যজিতের টাইপোগ্রাফির প্রয়োগকৌশল চলচ্চিত্রের পোস্টার এবং পত্রিকা ও গ্রন্থের প্রচ্ছদ তৈরি করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। তিনি ইম্পিরিয়াল টোবাকো কোম্পানীর Wills Navy Cut সিগারেটের প্যাক তৈরি করে DJ. Keymer কোম্পানীকে অবাক করে দিয়েছিলেন, সেই সুবাদে কোম্পানী তাঁকে লন্ডন হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়েছিল। নিজের কাজের বাইরে প্রচুর সিনেমা দেখার পর সিনেমা তৈরিতে আগ্রহী হলেন এবং অচিরেই আমরা পেলাম দিগ্বিজয়ী সত্যজিৎ রায়কে।

  সেই সময় প্রি-ডিজিটাল যুগে সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্র প্রচারের জন্য যে পদ্ধতিতে বিশাল বিশাল পোস্টার তৈরি করতেন, সৌন্দর্য ও অভিনবত্বের কারণে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান, জার্মানী, পোল্যান্ড, পূর্বতন চেক ইত্যাদি দেশ সহ সারা বিশ্বে।

  যে মানুষটিকে তর্কের খাতিরে ভারতের প্রথম গ্রাফিক ডিজাইনার বলা হয়, সেই মানুষটি কখনও অলসভাবে বসে থাকেননি। তাঁর বহুমুখী বিচিত্র সব কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল শিশুদের একটি সচিত্র পত্রিকার পুনঃপ্রকাশ আয়োজন। তাঁর ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোর ১৯১৩ সালে শিশুদের জন্য 'সন্দেশ' নামের একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ডিসেম্বর ১৯১৫ উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর ১৯১৬ তে সত্যজিতের বাবা সুকুমার 'সন্দেশ' প্রকাশনায় হাত লাগান--- সুকুমার রায়ের অকাল প্রয়াণে 'সন্দেশ' প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেল। সত্যজিৎ রায় ১৯৬১ সালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে সন্দেশকে ‘রাজকুমার' করে সাজিয়ে তুললেন নতুন মোড়কে, নতুন পোশাকে, নতুন মলাটে বেঁধে। লিটল ম্যাগাজিনের জন্য সেই আন্তরিক কাজ তিনি আমৃত্যু নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিত করে গেছেন। শিশুদের এই পত্রিকায় কোনো প্রচ্ছদ রচনা থাকত না বলে, তিনি প্রচ্ছদে এমন স্টাইলের অলংকরণ করতেন যার মধ্যে পত্রিকার পুরো স্পিরিটটাই ফুটে উঠত। সেদিন থেকে সন্দেশকে শিশুদের সেরা মাসিক পত্রিকা বলতে আপত্তি করেননি কেউই। 'সন্দেশ'-এর প্রচ্ছদ গ্রাহক-মূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে বর্ণময় করে ছাপানো হত, কিন্তু তা বাণিজ্যিক পত্রিকার অর্থের সাথে পাল্লা দিতে পারত না --তবুও সেইসব কালজয়ী প্রচ্ছদ আজও সেরার স্বীকৃতি নিয়ে বিরাজমান। আমরা যে মিষ্টির কথা বলি সন্দেশ – তার একটি নাম তো ‘জলভরা’। তেমনি করে সবাই তো তখন চাইত সত্যজিৎ রায়ের 'রঙভরা' সন্দেশ। সেসময় দু-তিনটি কালার দিয়ে সিল্কস্ক্রীনে প্রচ্ছদ ছাপানো হত। সত্তরের দশকের সময় থেকে লিথোতে বহুরঙা চিত্র সাজিয়ে ‘সন্দেশ'-এর মলাট ছাপানো হত --আর অফসেট এসে যাওয়ার পর প্রচ্ছদের পরিকল্পনাও যেমন অত্যাধুনিক হত, তেমনি রঙে রূপে বাহারে 'সন্দেশ' বেরোত দেখনদারি আর দর্শনধারী হয়ে।

  সত্যজিৎ রায় এবং সৌমিত্র চ্যাটার্জী-র মধ্যে একটা অদৃশ্য এবং অটুট বন্ধন ছিল। চলচ্চিত্র শিল্পে একজন পরিচালনা এবং অন্যজন অভিনয়কে সঙ্গী করে একত্রে বহুদূর পাড়ি দিয়েছেন। সত্যজিতের সিনেমার বাইরে ছিল বহু শিল্প-সংস্কৃতির যোগ। সৌমিত্রেরও সাহিত্য সংস্কৃতি নাটক ক্রিকেট ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিচরণ ছিল, তবে সম্ভবত সেরাটি ছিল লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা। ১৯৬১ সালে সৌমিত্র একদিন সত্যজিৎকে তাঁর পত্রিকার নামকরণ করার অনুরোধ জানান। সত্যজিৎ নাম দেন 'এক্ষণ'। শুধু তাই নয় এক্ষণ-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদও এঁকে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ এবং তারপরেও বহুবার এক্ষণ-এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন সত্যজিৎ রায়। 'এক্ষণ'-এ সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যও ছাপা হয়েছে। এটাও একধরনের যুগলবন্দি পরিবেশনা। 'এক্ষণ'-এর মলাটে আমরা দেখেছি রঙের বনেদিয়ানা আর টাইপোগ্রাফির জিমনাস্টিকস্। 'এক্ষণ'- এই শব্দটির মধ্যেকার তিনটি অক্ষর নিয়ে সত্যজিতের যে কেরামতি তা অন্য কোথাও বড় একটা চোখে পড়ে না। দেশেও নয়, বিদেশেও নয়। তবে খালেদ চৌধুরীর আরবি অক্ষরের ছলনায় যে বাংলা লিপিশিল্পের মুনশিয়ানা দেখেছি – সেকথাও এখানে স্মরণ করা একান্ত জরুরি।
এই দুটি বিখ্যাত লিটল ম্যাগের দুশোরও বেশি প্রচ্ছদ এঁকেছেন সত্যজিৎ। প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিনি এবং বহু বিখ্যাত গ্রন্থের মলাট ও জ্যাকেট তৈরি করেছেন সত্যজিৎ।  জীবনানন্দ দাশ এবং বিষ্ণু দে-র কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ একটি উচ্চতায় আজকের দিনেও চিরস্থায়ী হয়ে বিরাজমান। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজ কাহিনি এবং জওহরলাল নেহরুর The Discovery of India-র প্রচ্ছদও এঁকেছেন সত্যজিৎ। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ এবং ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত সত্যজিৎ রায়-এর অন্যতম প্রধান কীর্তি হল সাহিত্য অকাদেমির লোগো নির্মাণ করা। সত্যজিৎ রায় লিটল ম্যাগাজিনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, তাই আমরা লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা যার পর নাই আনন্দ অনুভব করছি। আরও আনন্দে আপ্লুত হচ্ছি এই কারণে যে, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কর্ণধার সন্দীপ দত্ত সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে' (The Home and the World) ছায়াছবির গ্রন্থলিপি (bibliography) প্রস্তুত করেছেন জেনে সত্যজিৎ রায় সন্দীপ দত্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। 

  একশ পেরোলেন আমাদের প্রিয় সত্যজিৎ। এমন One-man Institution আর দেখাই যাচ্ছে না বাঙালির মধ্যে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এই আন্তর্জাতিক বাঙালির বড় অভাব বোধ হয় হে! 
 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments