তুলসীদাস মাইতি
‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’ অবচেতনে সাজানো কীলকাক্ষরের এক সাংকেতিক ইশারা। কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর আত্মদর্শনের সরণি বেয়ে উঠে আসা কয়েকটি মনোলগ। কবিতাগুলির ভেতর জ্যামিতিতে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, এখানে কীলকের বাণমুখ আছে। আছে ‘সংহততন্ত্রী’ বীণার সুরও। ঐতিহ্যের আধুনিক প্রয়োগের সঙ্গে অনুপম আত্মচেতনাকে অবলীলায় প্রকাশের এমন শৈলি বাংলা কবিতায় কমই দেখি।
আপাত অসরল কবিতার শরীরে কবি ঋত্বিক নির্মাণ করেছেন যে সহজ বাক-প্রতিমা যা মনকে মুগ্ধ করে আর চোখকেও তৃপ্ত করে। নিজস্ব উপলব্ধির এই গভীর ভূমির স্তরে স্তরে তিনি সাজিয়েছেন ছোটো বড়ো ব্যক্তিগত বাগান। যা কখনো সরলরৈখিক কখনো বা বক্রাকার। আলো অন্ধকারের রহস্যের মতো কবির আত্মজ্ঞানে যে অদৃশ্য টানাপোড়েন তাকেই ভাষারূপ দিতে গিয়ে কবি বহুবার নিজেকে ভেঙেছেন নিজের ভেতরেই।
বলাবাহুল্য, প্রায় সব কবিতাই ওজস্বী বাক্যবন্ধনে পরিমার্জিত। যে আলোচনা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আকারে গ্রন্থ লেখা লেখা যায় তাই নিয়ে এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোকপাত রীতিমতো এক কঠিন কর্ম বলেই মনে হয়। এই কথা মনে রেখেও আমার এই অল্প-স্বল্প চেষ্টা।
জীবনের এক অদ্ভুত পরিণতি কবিকে কখনো প্রশান্ত করেছে। দুঃখ-যন্ত্রণা-ক্রোধ অতিক্রম করে কবি ঋত্বিক পৌঁছতে পেরেছেন একটি অমোঘ পৃথিবীতে। এই পৃথিবী কবিরও উপভোগের ভূমি। বিস্তৃত আলোর নীচে দাঁড়িয়ে কবি যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ খুঁজতে খুঁজতে বুঝে নেন পাটিগণিতের প্রতীক চিহ্নগুলি। সিঁড়িভাঙা হিসেবের মধ্যেই ‘আনন্দভৈরবী’র সুর কবিকে মাতিয়ে তোলে।
“পাই বা না পাই অন্তত সচেষ্ট হই। খুঁজি যোগ
খুজি বিয়োগ, গুণ, ভাগ ফের যোগ, গুণ ভাগ
চিহ্নের খুঁজে প্রতীক, প্রতীকের খোঁজে যেটুকু সমন্বয়
দেখি সিঁড়ি, ওপর থেকেও যা, নীচ থেকেও তাই
আশ্চর্য নততলের আনন্দ ভৈরবীতে মজে আছি
কোনও দুঃখই দুঃখ নয়, এখন আমার।”
(আশ্চর্য নততল)
এসব কবির ব্যক্তিগত খেয়াল নয়, এখানে নিহিত কবির জীবনবোধ ও রাষ্ট্রবোধের ব্যঞ্জনাও। অধিবৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে তিনি মহাকবির ব্যঞ্জনা প্রকাশ করেন।
“তিনি কবি যাঁর কবিতায় তিনি অন্তত একবার নিজেকে ছড়িয়ে নিজের দেশের সীমায় এড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীর নামে জয়ধ্বনি করেন। পৃথিবীর শুশ্রূষার জন্য ব্যাকুল হন। এই আওয়াজ তুললে কোনও না কোনও রাষ্ট্র ভুল বুঝতেই পারে। উন্মুখ হয়ে উঠতে পারে ফাঁসিকাঠ। সেই রাষ্ট্রকে যিনি পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেখেন না- তিনি
কবির কবি। আর সেই রাষ্ট্রকে যিনি ক্ষমা করেন ও আমাদের ছেড়ে যাবার আগে ফের কবিতা লেখার কথা বলে যান, তিনিই মহাকবি।”
( মহাকবির ব্যঞ্জনা)
আবার ‘সংজ্ঞার বিপরীতে’ কবিতাটিতে কটাক্ষ আছে। ছন্দময় পরিধিতে কবি একই সঙ্গে আত্মসচেতন ও সমষ্টি সচেতন। চেনা অচেনার দ্বন্দ্বের মধ্যেই কবি এখানে নিজেকে প্রকাশ করেছেন আবার দেশকে প্রকাশ করেছেন। এখানে সময়ের নির্মাণে রহস্যময় মূল্যবোধের অনিবার্য রূপ।
“দেওয়াল গড়ে নিই সহজেই নিজেদের চেনায় শত্রুরা
রহস্যে মোড়া ঢের কঠিন কাছের বন্ধুরা….”
কিছু পরেই কবি কত সহজ অনুভবে বলতে পারেন—
“চেয়েছি বলেই দেশ নইলে একটাই পৃথিবী হয় দুঃখ সুখের সমূহ ঐশ্বর্য একার কারও নয়।”
কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী নির্মিত বাক-প্রতিমাগুলি নিয়ন্ত্রিত ধ্রুবপদের মতো গম্ভীর। এক একটি অসরল ছবি শরীরী সীমাকে অতিক্রম করে যায়। ‘ভুবনকথামালা’ কবিতাটি এই পর্যায়ের অনন্য একটি অভিমুখকে নির্দেশ করে। কবিতার প্রথম পঙক্তি থেকে শেষ পর্যন্ত চিত্রকল্পের মায়া দিয়ে আঁকা।
“তিন অক্ষর, তন্ময় পৃথিবী মন্ময় এই জীবন আমাদের
আনন্দমেলায় অবিনাশী গাছ, ধারালো তার আলিঙ্গন দিগন্ত নীল, ছুরির অগ্রভাগ সোনালী তুর্য শতশত
বনপোড়া পাখি মাধবীলতার শীর্ষ ছুঁয়ে উধাও
চৈতন্য জপমালায় বেড়ে ওঠে স্বরচিত ছায়াচ্ছন্ন মাঠ…..”
( ভুবনকথামালা )
অন্য কবিতাগুলিতেও এরকমই নিটোল চিত্রকল্পের অদ্ভুত সব বুনন দেখি।
১.
“বিষণ্ণতার এই লক্ষ্যে দ্বিধা নাব্যতার খোঁজে একক শূন্যতারও থাকে আগ্রাসন। হিরণ্য জলে মাৎস্যন্যায়
………
সাধ্যাতীত যুদ্ধ শেষে নির্জন স্বরলিপি কিছু
অগ্নিপাটের অনেক ওপরে বাতাসে বাতাস হয়ে অক্ষরবৃত্তের মতো ভারহীন ভেসে ভেসে গড়ে তুলেছে অন্য ভুবন…”
২.
“সুতরাং নততলের সন্ধানে মূর্তিমান ছায়ার জন্য উৎসর্গ করি সমূহ লেখা।”
( মানুষের কথা : এক)
৩.
“বেঁচে থাকার আনন্দ বিসর্জন সেরে বাড়ি ফিরে আসে একলা মানুষ
বাড়িতে প্রতিবেশী। তাদের সম্বল দ্বিরুক্তি শ্লেষ ব্যাজস্তুতি …
নিকটবর্তী হয় দিগন্ত, দেশ, নিশ্চেতন রাতের আশীর্বাদধন্য ঘুমন্ত তারা
কৃতজ্ঞতার মাঠে মুখোমুখি পক্ষ বিপক্ষ এক সব আপাত
ছায়া পায় শরীর। ক্রমে ক্রমে জাগে আনন্দ, এষণা, সংবিৎ”
(মানুষের কথা:দুই)
৪.
“একাকী ছিল না কিছুই শ্রেণিকক্ষের নির্জনতা
শান্তি প্রস্তাবে ছিল কাশফুল বিস্ময়, ভাষার উড়ান
কীভাবে টুকে নিতে হয় বেদবাক্যসম বিজ্ঞাপন
কীভাবে নিজেকে ভাসাতে হয় সঙ্গতিহীন কোলাহল স্রোত অনিবার্য”
সময়ের নানান বৈপরীত্যকে কবি নির্মোহ চোখে দেখেছেন ও নিজের মত করে প্রকাশ করেছেন। এই প্রকাশের ভঙ্গি কবির একান্ত নিজের। সমাজ, পরিবার এমনকি নিজের ভাবনার ভেতরেও ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপক্ষের যুদ্ধ চলছে— নিরন্তর এই সত্যকে প্রকাশ খুব সহজ নয়, অথচ কবি ঋত্বিক অবলীলায় করে দেখিয়েছেন।
“বিপরীতেই হয় বন্ধুত্ব গভীর, আত্মশুদ্ধি
শ্রাবণে ভিজে যায় যেমন শাল ও সেগুন
সমান্তরাল যুযুধান
………
ভয় ও সংকর ধানের হে প্রিয় গ্রাম
পিঠে পিঠ, দৌরাত্ম ও গ্লানি অভিমানেই
ধ্বংস, অভিমানেই শত গদ্য পদ্যমুখী
(বিপ্রতীপ ১)
“আসলে ঘুঘু ও গৃহস্থ বাঘ একসঙ্গে মশারি টাঙায়
কত কাল আগে নিবিড় সুভাষ হারিয়ে দিব্যা ভারতী যেমনটি আজ গাছের নীচে দেখা গেল
প্রাজ্ঞজনেরা ব্যস্ত মৃত কবি জয়দেবের হস্তরেখা বিচারে”
( বিপ্রতীপ ২)
‘আকর্ষণ ও অনুবাদ’,‘ব্রাত্যজন’ প্রভৃতি কবিতাতেও এমনই বিপরীতধর্মী অভিজ্ঞতা ও সংশয়ের নানান টানাপোড়নের রূপ প্রতিচিত্রিত।
“সংশয় ও আবেগ ভরে ওঠে পুষ্পাভরণে, উপমায়
কঠিন শৃঙ্খলে প্রাতিভাসিক অসংলক্ষ্যক্রম ধ্বনি
…..
স্বাভাবিকভাবেই চন্দ্র- সূর্যের পাশেই সাপ ও ফনা
ত্রিভুজের সূচিমুখে আমরা কিশোররাক্ষস ফের দাঁড়ালাম…
( আকর্ষণ ও অনুবাদ)
“রোদ ও শামিয়ানার মাঝে প্রতিবাদ ও সম্মতি আমাদের পরসম্বন্ধী ভয় আছে, পরিণতি ও সংকীর্তন সহজেই সম্মতি দিয়েছি সুলক্ষণ ভূমা নক্ষত্রলোকে। আর
রত্নখচিত সুবর্ণপাত্র ঘিরে চিত্তশুদ্ধির পরিণয়গীত।”
(ব্রাত্যজন)
‘ছিন্নমতি’, ‘মহাকাশ-উত্তরকথা’, ‘বিস্ময়চিহ্ন’, ‘নিষিদ্ধ চারণভূমি’, ‘অভিজাত ডুবোজাহাজ,’ ‘সোনার কাঠি রুপার কাঠি’, ‘প্রবন্ধসার’ ‘মাঠ পেরোচ্ছে শুকুন মান্ডি’ প্রভৃতি কবিতাগুলি কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত বাক-চিত্র! কবির সৃজনী শক্তির মহত্তর প্রকাশ এগুলি। সংক্ষিপ্ত, সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত সংবেদনায় সহজ হয়ে প্রকাশিত। জীবনের জটিল ও গভীর ক্রিয়াগুলি যেখানে বিস্তৃততর হয়ে প্রকাশিত হতে পারত —কবি অনিবার্যভাবেই তাকে চলমান ঘোড়সও়যারের মতো লাগাম দিয়ে বেঁধেছেন। অথচ বন্দী করেননি।
“লক্ষণরেখার মতো উন্নত আর কি-ই বা হতে পারে চিত্রকল্প
অলংকৃত রেখাচিত্রের স্মৃতি-একক সংসার, লুকিয়ে মহাদেশ
আগুনের ব্যাঞ্জনা ধ্রুবপদ। সামান্য বিধি নিষেধ সেখানেও”
(নিষিদ্ধ চারণভূমি)
কিংবা
“ ভূতগ্রস্ত পলক ও পলকের মাঝে অখণ্ডিত প্রকরণ
শুকুন হাঁটছে, পাশে আমরাও সুখে অসুখে দ্বিধাহীন.. আরতির রীতিতে বাতাসে মিশছে রেণু কাঁটাঝোপ থেকে
পরাগ মিলনের উপধারায় সংজ্ঞা পাচ্ছে মাঠের নরম প্রচ্ছদ”
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
সন্তানের পাশে থাকে পূর্বজের ছায়া। অপত্যের রহস্যস্পর্শে জেগে থাকে কবির আবশ্যিক কথামালা। ‘ক্রিসপার টেকনোলজি’র যুগেও কবি মায়ায় আক্রান্ত হয়ে ওঠে। নিঃশ্বাস প্রবাহিত হয় আত্মজের অন্তঃশিরায়। ‘ঋতরূপ’ কবিতাটিও তাই কবির অবশ্যম্ভাবী সৃষ্টি।
“ এ সেই অবশ্যম্ভাবী জলাধার মায়ার শরীরে রূপক। যেখানে লুকিয়ে আছে আলোকবর্তিকা, শেষ নিঃশ্বাস”
না বললেই নয়, সংকলনের শেষ কবিতাটি সম্পর্কে। ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’। প্রত্ন-মায়ায় জড়িয়ে কবি ঋত্বিক সভ্যতার গভীরে ডুবসাঁতার কেটেছেন। আধুনিক অনুষঙ্গে পাঁচহাজার বছরের মৃত্তিকা খনন করে তিনি রামায়ণ ভূমিতে বিচরণ করেছেন। সীতা,রাবণ কিংবা অহল্যা আবহেই চন্দ্রাবতীর পাঁচালি। পূর্বধ্বনিত ‘কীলক’ লিপিতে ভ্রমণ করেছেন দীর্ঘপথ। বাল্মীকি পেরিয়ে বড়ু চন্ডীদাস। পাতাল নিহিত সীতা থেকে প্রক্ষিপ্ত-প্রচ্ছদের শ্রীরাধা। হাহাকারের লিপিকরণ।
কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’ একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রাচীন প্রবন্ধ সঙ্গীতের মতো কখনো তার বিলম্বিত চলা আবার কখনও স্পর্শ অতিক্রম করে দ্রুত স্নায়ুতে আশ্রয় নেওয়া। তার অন্তর ও বাহির কখনো দৃশ্যচেতন কখনো শ্রুতি নির্ভর।
কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা । ঋত্বিক ত্রিপাঠী ।
সিগনেট প্রেস । ডিসেম্বর ২০২৩
🍂
1 Comments
উৎকৃষ্ট কবিতাগুলি নিয়ে ভালো আলোচনা করেছো তুলসী।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো।