চলচ্চিত্রে মানবিক সত্যজিৎ : শতবর্ষের আলোয়
চিত্রলেখা দত্ত
"শ্রীরায়ের ছবি না দেখা আর পৃথিবীতে চাঁদ আর সূর্য না দেখে বেঁচে থাকা একই ব্যাপার।"
----- আকিরা কুরোসাওয়া
পৃথিবীর সেরা ব্যক্তিদের অন্যতম এক অসামান্য মানবিক ব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায়। বাংলা ও ভারতের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে তিনি বীক্ষণের আলোক বাতি। তাঁর অপূর্ব সৃষ্টির ছত্রে ছত্রে বিভিন্ন সামাজিক ,অর্থনৈতিক সমস্যার চিত্রায়ণ তাঁর প্রতিবাদী মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর রাখে। ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রেনোয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার তাঁর কর্মধারায় আমূল পরিবর্তন আনে। লন্ডনে ইটালিয়ান চলচ্চিত্র "Ladri di biciclette"(বাইসাইকেল চোর) দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন। আঠাশটি ফিচার ও পাঁচটি তথ্যচিত্রে তাঁর রুচিশীল নান্দনিক সৌন্দর্য শোভিত ভাবনা ভারতের একমাত্র অস্কার জয়ীর শিরোপা পায়। তাঁর বিচিত্র পরিচিতির মাঝে প্রধান পরিচিতি তিনি একজন মানবদরদী চিত্রপরিচালক যার ক্যানভাসে ভাসছে বিশ্ব মানবতার মুক্তির গান।
অপু ট্রিলজির প্রথম ছবি পথের পাঁচালী(১৯৫৫) ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত। রবীন্দ্রনাথের কথায়-"চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব ভাষা দরকার।" সেই ভাষা মানবিক ভাষা। পথের পাঁচালী থেকে সেই ভাষায় স্বপ্ন দেখেছে বাংলা চলচ্চিত্র। রূঢ় বাস্তবকে তুলে ধরার প্রয়োজনে তিনি গল্পের মূলকে তুলে আনেন বিভূতিভূষণের সাহিত্য থেকে। দৃশ্যের গতিপ্রবাহ এক স্বতন্ত্র রস সৃষ্টি করে। পথের পাঁচালীর দারিদ্রতাকে তিনি নান্দনিক রূপ দান করেছেন। চিদানন্দ দাশগুপ্তের কথায়,"সত্যজিতের গোটা মানসিকতা রবীন্দ্র যুগ থেকে তৈরি"। গ্ৰামবাংলা,শহর,শহরতলি সমস্ত জায়গায় এই ছবির হরিহরের চরিত্র এখনো প্রাসঙ্গিক। স্বপ্নে সে অনুভব করে পালাগান লিখে পেশাদারী পালা লিখিয়েদের হারিয়ে দেবে। সংসারের হাল ফিরবে নিশ্চিত। এই স্বপ্ন সকল কবি , সাহিত্যিকদের মধ্যে লালিত হয়ে আসছে চিরকাল। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে লেখা হয়--
"Pather Panchali is a pure cinema". ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'Best human documentary' হিসাবে এই ছবির বিবেচনা দর্শকের সংবেদনশীল মনকে ছুঁয়ে যায়।
বিংশ শতকের প্রথম দিকে বাংলার এক অজ গ্ৰামের বালক সামান্য গন্ডীর সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বলোকের যাত্রী হয়ে উঠেছে। সর্বজয়া চরিত্রায়ণের তুলনা হয় না। "অপরাজিত " মূলত: সর্বজয়ার দশভূজা হয়ে জীবন সংগ্ৰামের কাহিনী। এক গভীর মানবিক যন্ত্রনার অনুভূতিস্পর্শ করে দর্শককে। ইটালিয়ান নিউরিয়ালিজম স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। অপুর পুরোহিতের কাজ সেরে স্কুলে ভর্তি হয়ে কৃতী হওয়ার স্বপ্ন এখনো সমাজের শিকড়ে জারিত রয়েছে। এখানেও মানবিকতার খামতি নেই। তরুণ অপুর উচ্চাভিলাষ ও মায়ের সঙ্গে অভিমান মর্মভেদী হয়ে ওঠে।
"অপুর সংসারে" 'অপরাজিত' উপন্যাসের শেষাংশ নিয়ে চিত্রনাট্য রচিত হয়। অপু এখানে পুরোপুরি নগরকেন্দ্রিক। তাই মনসাপোতা গ্ৰাম নয়, অপর্ণা ও অপুর সংসার মূলতঃ কলকাতায়। অপু ইন্টারমিডিয়েট পাশ এক যুবক। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করার প্রয়োজনে সে টিউশান করে। ভাড়াবাড়িতে থাকে। তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়ায় তাকে বাড়িওয়ালার কাছে কথা শুনতে হয়। পরিস্থিতির চাপে অপর্ণাকে বিয়ে করে অপু। দাম্পত্য প্রেম এগিয়ে চলে দুর্বার গতিতে। গল্প বাঁক নেয় অপর্ণার মৃত্যুতে। অপুর ভালবাসার অবলম্বনটুকু নিমেষে শেষ হয়ে যায়। শৈশব থেকে মৃত্যু দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা অপু মৃত্যুকে মানিয়ে নিতে পারে না । প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সুব্রত মিত্রের ক্যামেরায় ধরা পড়ে চরিত্রের সূক্ষ্ম নির্যাসটুকু।কাজলের মন কেমন করা দৃষ্টি বুকের ভেতরটা নিংড়ে দেয়। চিরকালের মতো গেঁথে যায় দর্শক মনে। অপুর দাম্পত্যের পরিণতি করুণ হলেও জীবনবোধ মূল্য পেয়েছে এই ছবিতে। অপুর বিবাহ পর্ব বাঙালি জীবনের এক ধ্রুপদী গভীরতাকে ছুঁয়ে যায়। বিস্তীর্ণ ল্যান্ডস্কেপে কাজলকে কাঁধে নিয়ে অপুর এগিয়ে চলা মানবিকতার পথেই যেন হেঁটৈ যাওয়া। সত্যজিৎ রায়ের জীবনের ম্যাগনাম ওপাস অপু ট্রিলজি।
তাঁর অনেক ছবির মধ্যে আরেকটি ছবি "মহানগর" যা মানব মনের গভীরে রেখাপাত করে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'অবতরনিকা' গল্প অবলম্বনে চিত্রায়িত। সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালন করে চাকরি করার পরও সংসারের শান্তির কথা ভেবে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় আরতি। রেজিগনেশান দিতে যাওয়ার মূহুর্তে তার স্বামীর ফোন আসে-'চাকরিটা সে যেন না ছাড়ে'। ব্যাঙ্ক ফেল করায় তার স্বামী দিশাহারা হয়ে জানায় তার স্বামীর চাকরি গেছে। অতি সাধারণ মেয়ে এবার হয়ে ওঠে অসাধারণ। তার মানবিক গুণের প্রকাশ আমরা দেখি যখন সে প্রতিবাদ করে বসের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার সহকর্মী এডিথকে অপমানের কারণে বসকে ক্ষমা চাইতে অনুরোধ করে আরতি। বস না মানলে আরতি রেজিগনেশান লেটার দিয়ে অফিসের বাইরে অনাবিল মুক্তির অপেক্ষায় বেরিয়ে আসে। হতাশার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নিজের সংসারকে বাঁচানোর তাগিদ ছেড়ে সে রুখে দাঁড়িয়েছিল,ভেঙে পড়েনি। সমঝোতা করেনি অন্যায়ের সঙ্গে। মানবিক বুনন এতটাই মজবুত যে এখানে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরির হাহাকার,অভাব অনটন একমূহুর্তে উঠে আসে চোখের সামনে। তবু তারা মানবিকতা হারায় না, হারায় না আত্মমর্যাদা যা মনুষ্যত্বের দলিল।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র মুন্সী প্রেমচাঁদের ছোট গল্প "সদগতি " অবলম্বনে একই নামে চিত্রায়ণ। দলিত সমাজের শিকড়ে জারিত যন্ত্রনার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় লহমায়। "সদগতি"ছবিতে দুখী ব্রাহ্মণ্যধর্মের কাছে মাথা নত করে। অস্পৃশ্যতার এমন বীভৎস কদাকার রূপ দেখে সমাজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না। পায়ে দড়ি বেঁধে দুখীর লাশ টেনে নিয়ে যাওয়া সহ্য করা যায় না। এখানেও সত্যজিৎ রায়ের অন্তরের প্রতিবাদ টুকু খাঁটি মানবতার গহনে ধরা পড়ে। তাঁর গভীর চিন্তন শক্তির তার ছুঁয়ে যায় এ ছবি।
"অভিযান"ছবিতে নরসিংহের ক্রাইসলার গাড়ি যেন এক চেতনা সম্পন্ন মানুষ। তাই ফাঁদের সামনে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। পাহাড়ের চূড়ায় বসে থাকা শকুনি যেন মনে করায় দুই পা এগোলেই বিপদ। বেঁচে থাকার আনন্দ যে কি তার গুরুত্ব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় যখন নরসিংহের চোরাচালান থেকে মত পরিবর্তনের কারণে গাড়িটি হঠাৎ চলতে শুরু করে।
"জন অরণ্য" শঙ্করের কাহিনী নিয়ে সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি। এখানে সত্যজিৎ কঠোর সমালোচক। কলকাতার নগর জীবনের ছবি তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কাটাছেঁড়া করেন অবলীলায়। তাঁর প্রতিবাদ সোমনাথের মাধ্যমে প্রখর হয়ে ওঠে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে করে আমরা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছি ক্রমশঃ যা আমাদের জীবনে ভয়াবহতা ডেকে আনে। নিদারুণ এই অনুভূতি কালোত্তীর্ণ।
"প্রতিদ্বন্দ্বী"- অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া সিদ্ধার্থের জীবনের চিত্রায়ণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিবাচক দিকটিকে তিনি এত নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন যে সেই আলোয় কলকাতার সবকিছুই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এই ছবিতে নায়ক শ্যামলেন্দু জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য নিজের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মানুষের জীবনের ভাবনা ছিল চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই পায়ের শব্দই হয়েছে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার একমাত্র সঙ্গী।
"চারুলতা"র বিজ্ঞাপনে সত্যজিৎ লিখে ছিলেন __"সত্যজিৎ রায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি।" অমল ও চারুর সম্পর্ক সাহিত্যের ভাষা পেয়েছে। চারু ও অমলের মনের মিল দেখানোর জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের উপস্থাপনা। তাদের কাছাকাছি আসার একমাত্র মাধ্যম ভূপতি যে ভালোবাসার অর্থ বোঝে না। নারী চরিত্রের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন সবই চারুর মাধ্যমে পরম মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রেম, বিশ্বাস, নিষ্ঠুরতা সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারুলতা সত্যজিতের ফিল্মি ভাষায় জীবন্ত হয়ে ওঠে।
"ঘরে বাইরে"রবীন্দ্র ভাবনার ছবি। স্বদেশী ভাবনার উপর চিত্রায়িত। আগুন দিয়ে ছবির শুরু। শেষে বিমলার সিঁদুরের টিপ মুছে গেছে। পরনে সাদা থান। তবু মানবিকতা এখানে শেষ কথা বলে। নিখিলেশ বিমলার ঘরে এসেছে সন্দীপ। ঘরের বৌ অবশেষে বাইরে বেরিয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি ছবিই মানবপ্রেমের বার্তা বহন করে। স্বল্প পরিসরে সব বলা সম্ভব নয়। তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদনে তাঁর জন্মশতবর্ষে এই কলমচির কলম ধরা। 'মানব জীবনের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ,শান্ত অথচ গভীর জীবনবোধ এবং মানবপ্রেম 'এই সুধায় সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র চিত্রায়ণ। শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের উক্তিকে স্মরণ করে বলতে চাই----
"তিনি সম্পূর্ণ একজন মানুষ এবং তাঁর সেই সম্পূর্ণতাকে পাওয়া যায় তাঁর ছবিগুলিতে।"
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments