জ্বলদর্চি

সত‍্যজিৎ রায় : যেমন দেখেছি, যেমন পড়েছি /শীর্ষেন্দু পাল


সত‍্যজিৎ রায় : যেমন দেখেছি, যেমন পড়েছি  

শীর্ষেন্দু পাল

সত‍্যজিৎ রায়ের লেখার সঙ্গে আমার আলাপ কৈশোরে। বাড়িতে নিয়মিত আসতো সন্দেশ পত্রিকা। এখনকার মত উন্নত প্রযুক্তিবিদ‍্যার সাহায্য পেলে কি করতেন জানি না কিন্তু সেই সময়ের ছাপার পদ্ধতিতে অবলম্বন করেই সত‍্যজিৎ রায় পত্রিকার ব‍্যাপারে যে যথেষ্ট খুঁতখুঁতে ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখা নির্বাচন যথাযথ তো ছিলই, সময়োপযোগী বিষয়ের উপস্থাপন এবং ঠিক কাদের জন্য এই পত্রিকা সেটা মাথায় রেখেই পত্রিকা করতেন। তবে এসবের উপরে ছিল পূর্ণাঙ্গতা, ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি পারফেকশন - সেটার দিকে তাঁর কড়া নজর। বেশ মনে আছে, ' পুরোনতুন ' নামে একটা বিভাগ থাকত সেই সময়। সেই পাতায় পুরোনো ও নতুন লেখক লেখিকাদের এবং বিষয়ের লেখা থাকত। এই পুরোনতুন কথাটার মধ্যেই 'পুরোনো' ও 'নতুন' কথাদুটোকে যাতে খুঁজে পাওয়া যায়, তার জন্য শব্দের মাঝের ' ন ' এর আধখানা পর্যন্ত কালো ও বাকি অংশ সাদা - এইভাবে ছাপা হত। উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও অভিনবত্বের চমৎকার মিশেল ঘটিয়ে বরাবরই পাঠক ও দর্শকদের এভাবেই ভাবতে বাধ্য করতেন তিনি। 
নিজে ভালো চিত্রশিল্পী হওয়ার ফলে তাঁর তৈরি ছবিগুলোর সেট নির্মাণের ব‍্যাপারে পেশাদারি মানুষদের পরেও তাঁর নিজস্বতা তাই ছাপ রেখে গেছে।জহুরির চোখ ছিল তাঁর, ছিল অসম্ভব মন পড়ার ক্ষমতা। কোনো গল্প বা উপন্যাস পড়ার পর পাঠকের মনে সেই গল্পের বা উপন্যাসের চরিত্রগুলো কিরকম মানুষের রূপ নিয়ে আসছে - এটা বোঝার এক সহজাত দক্ষতা নিয়েই যেন ছবি তৈরির কাজে নেমেছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত বলা যায়, এ ব‍্যাপারে বেশ খানিকটা ঝুঁকি ও নিয়েছিলেন তিনি। ধরা যাক সোনার কেল্লা ছবিটার কথাই। যখন তিনি ফেলুদাকে নিয়ে ছবি করবেন ভাবছেন, অবধারিত ভাবেই ফেলুদা চরিত্রের জন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে নির্বাচিত করছেন তা নয়। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, শরীর সচেতন অথচ বাঙালিয়ানায় ভরপুর, প্রচুর বিষয়ে পড়াশোনা থাকা সত্বেও বিনয়ী এবং অবশ্যই একেবারে পাড়ার পরিচিত দাদার মত একটা চরিত্র যার সঙ্গে সহজেই নিজেকে রিলেট করতে বেগ বেগ পেতে হয় না - এমন চরিত্র ভেবেই তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম মনোনীত করছেন। যদি কোনভাবে পাঠক- দর্শক নিজেদের মনে এঁকে রাখা চরিত্রের সঙ্গে সৌমিত্রকে মেলাতে না পারতেন, তাহলে ইতিহাস বদলে যেত তা বলাই বাহুল্য। এখানেই সত‍্যজিৎ রায়ের দূরদর্শিতা। কোন একটা সাক্ষাৎকারে তোপসের চরিত্রে অভিনয় করা সিদ্ধার্থ চ‍্যাটার্জী বলেছিলেন যে সোনার কেল্লা ছবিতে দুধ খাওয়ার দৃশ্যটি মোট এগারোটা শটে ওকে হয়েছিল এবং ততক্ষণে দুধ খেয়ে খেয়ে তাঁর পেট জয়ঢাক হয়ে গেছে। কতটা খুঁতখুঁতে এবং ডেডিকেটেড হলে তবে এরকম করা যায়, এটা তার একটা উদাহরণ মাত্র।চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা, অভিনেত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পারফেকশন সত‍্যজিৎ রায় কোন লেভেলে নিয়ে গেছিলেন, তা পরিষ্কার হয়ে যায় তাঁর পরিচালিত ছবিগুলোর পার্শ্বচরিত্রদের দেখলে। একজনের স্ক্রিন প্রেজেন্স কতটুকু সময়ের জন্য সেটা মাথায় না রেখে তিনি সবসময় জোর দিয়েছেন পাঠকের মনে ফুটে ওঠা ছবিটাকে যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে। আর তাই মুকুলের বাবা, লালমোহন বাবুর গাড়ির ড্রাইভার কিংবা ট্রেনে জটায়ুর গল্প শুনতে থাকা অবাঙালি ভদ্রলোক - সকলেই আমাদের মনের মত হয়ে ওঠে। জটায়ুর চরিত্রে যেমন সন্তোষ দত্ত ছাড়া কাউকে ভাবেননি ঠিক তেমনই পরশপাথর এর তুলসী চক্রবর্তী কে কোনভাবেই জটায়ু করা যেত না এটাও বুঝেছিলেন। শোনা যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি অনুযোগ করেছিলেন যে নায়ক ছবিতে কেন তাকে নিলেন না সত‍্যজিৎ রায়। তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে নায়কের চিত্রনাট্য তিনি লিখেইছিলেন উত্তমকুমার কে মনে রেখে। এখানেও সেই পারফেকশনের জন্য বিন্দুমাত্র সমঝোতা করতে রাজি হননি, সে যতই তাঁর সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুসম্পর্ক হোক না কেন। একইরকম ভাবে তাঁর লেখালেখির ক্ষেত্রেও পরিমিতিবোধ স্পষ্ট দেখা যায়। ফেলুদার উপন্যাসগুলোতে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার কথা থাকলেও কখনই ন‍্যারেটিভ এর কোন অংশকে নিছক ভ্রমণকাহিনী মনে হয় না। রহস‍্যের টানটান মোড়কের মধ্যেই ফেলুদার সঙ্গে পাঠক তাই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন ভারতের বিভিন্ন জায়গার বর্ণনা। গল্প বলার ফাঁকে কত অজানা জিনিস তিনি একেবারে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছেন আট থেকে আশি সবাইকে। গল্প বলার ভঙ্গি এত সরস এবং অনায়াস যে তথ‍্যসমৃদ্ধ হয়েও গল্প একবারও একঘেয়েমির কারণ হয় না। শুধুমাত্র গোয়েন্দা উপন্যাস নয়, একথা প্রযোজ্য সত‍্যজিৎ রায়ের লেখা অন্যান্য ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও।

    সত‍্যজিৎ রায়ের আরো একটা অনন্য সৃষ্টি প্রোফেসর শঙ্কু। কল্পবিজ্ঞানের জগতের প্রতি অগোছালো একটা দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার অভ‍্যাস থেকে সরিয়ে এনে মূল ধারার সাহিত্য করে তোলার জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা এবং সত‍্যজিৎ রায়ের প্রোফেসর শঙ্কু দুটো চরিত্রই সমান উল্লেখ্য।  এক্ষেত্রেও স্বকীয়তার নজির গড়লেন সত‍্যজিৎ রায়।প্রোফেসর শঙ্কুর আবিষ্কৃত জিনিসগুলোকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন যা প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।ভবিষ্যতে আদৌ কোনদিন  এই ধরনের যন্ত্রগুলো আবিষ্কৃত হবে কি না সেই তর্ক বরং থাক প্রোফেসর শঙ্কু কেন্দ্রিক উপন্যাস গুলোতেও আমরা কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে রহস্য বা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাই এবং সচেতনভাবেই সবক্ষেত্রে মানবতা জয়ী হয় শেষ পর্যন্ত। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের সমকক্ষ হয়েও যে শঙ্কু তাঁর নিজের দেশীয় গবেষণাগারের উপর ভরসা রাখেন সেটা একপ্রকার জাতীয়তাবোধ বলেও আমার মনে হয়। একেবারেই সামান্য উপাদান ব‍্যবহার করে শঙ্কু অবিশ্বাস্য সব আবিষ্কার করছেন - কল্পনাশক্তির এই পর্যায়ে ননসেন্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সুকুমার রায়ের ছায়া এসে পড়ে। কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক ছোটগল্প বঙ্কুবাবুর বন্ধু তে একজন নিরীহ গোবেচারা স্কুলশিক্ষক কে শেষপর্যন্ত ঘরোয়া আড্ডায় সুপারম্যান বানিয়ে আমাদের মনে পরিতৃপ্তির প্রশান্তি এনে দেন। 

    পথের পাঁচালির মত মাস্টারপিস দিয়ে শুরু করেও সত‍্যজিৎ রায় ছোটদের জন্য ছবি তৈরির যখন মনস্থির করেন, তখন তাঁর মধ্যে সিরিয়াসনেস এর কোন অভাব দেখা যায় না। হীরক রাজার দেশে ছবি নামেই ছোটদের জন্য ; এর ছত্রে ছত্রে যে পলিটিক্যাল স‍্যাটায়ার তা উপভোগ্য হয়ে ওঠে চিত্রনাট‍্যর সরস গুণে। আবার এই মানুষটিই যখন অরণ্যের দিনরাত্রি করেন, অবাক হয়ে ভাবতে হয় যে বাংলা সিনেমাকে সাবালকত্ব দেওয়ার চেষ্টা কত পরিমিত ভাবেই  করে গেছেন তিনি। বিরিঞ্চিবাবা গল্পটা পড়েছিলাম মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হিসেবে, টিভির পর্দায় যখন পরে দেখি, অস্বীকার করার জায়গা নেই যে আমার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠা মানুষগুলোই যেন পর্দায়
অভিনয় করতে নেমে পড়েছিল। ' মহানগর ', ' চারুলতা ', ' অশনি সংকেত ', ' আগন্তুক ' - ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর ছবি তৈরি করে তিনি বার্তা দিয়ে গেছেন আমাদের। তাঁর তৈরি ছবির চরিত্ররা তাঁর মতোই ঋজু, বাঙালিয়ানা ধরে রেখেও মননে আন্তর্জাতিক। অসম্ভব তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বহু বিষয়ের উপর পড়াশোনা এবং অবশ্যই কাজের ব‍্যাপারে কোনকিছুর সঙ্গে আপস না করার একরোখা স্বভাব - এসবের মিশেলে ভারতীয় সিনেমার এক অনন্য স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন সত‍্যজিৎ রায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments