জ্বলদর্চি

শঙ্কুর ‘মিরাকিউরল’ বড়িই কি তবে করোনার ওষুধ!/মৌসুমী ঘোষ

শঙ্কুর ‘মিরাকিউরল’ বড়িই কি তবে করোনার ওষুধ!

মৌসুমী ঘোষ

আটের দশকের মাঝামাঝি অরুণ বাগচীর নেওয়া সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় জানিয়েছিলেন, আমি কিন্তু একেবারে ছোটদের লেখা বলতে যা বোঝায়, তা বোধহয় লিখিনি, পারিও না। ওটা আমার ঠাকুর্দা মানে উপেন্দ্রকিশোর একেবারে চূড়ান্ত দেখিয়ে গেছেন। ... সত্যি কথা বলতে কী আমার মনে হয় না বাবাও লিখেছেন।” শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন ভাগ আছে। 'মুকুল' (১৮৯৫) পত্রিকায় শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় শিশুসাহিত্যের বয়সের সীমা তিনটি ভাগে নির্ধারণ
করেছিলেন, (৮/৯-১৬/১৭)। সত্যজিৎ রায়ের ছোটোগল্পগুলো প্রফেসর শঙ্কুর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীগুলো, ফেলুদার গল্পগুলো, তারিণী

  খুড়োর গল্পগুলো সব বয়সের পাঠকরাই পড়তে ভালোবাসেন। প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, শিশুদের জন্য রচিত সাহিত্যই হল শিশুসাহিত্য। তবে এটা সত্যি শিশুর মন জানা থাকলে তবেই শিশুসাহিত্য লেখা সম্ভব। শৈলীবিজ্ঞান তত্ত্ব অনুযায়ী অবশ্য বলা যায়, রচনার ভাষিক রূপ থেকে লেখকের মনস্তত্ত্ব, শিশু পাঠকের অনভূতির মূল্যায়ণ এবং সর্বোপরি রচনার সরল ও সাবলীল বিন্যাস সম্পর্কে এক সামগ্রিক অনুসন্ধানের পরই বলা যাবে সেটি শিশুসাহিত্য কিনা।

  সুকুমার রায়ের রচনায় উজ্জ্বল কৌতুকরসের সঙ্গে সূক্ষ্য ব্যঙ্গাত্মক সমাজচেতনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সময়ের শিশুমন, সুকুমার রায় সময়ের শিশুমন আর সত্যজিৎ রায়ের সময়ের শিশুমন কি একই তন্ত্রীতে গাঁথা?

  প্রফেসর শঙ্কুর আটত্রিশটি সম্পূর্ণ ও দুটি অসম্পূর্ণ ডায়েরি আকারের কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীগুলোর প্রথমটি 'ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী' 'সন্দেশ' পত্রিকায় ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিটি কাহিনীতে লেখক ছোটোদের বিজ্ঞানে উৎসাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে ভূগোলেরও নানা তথ্য দিতে চেয়েছেন। আর আমরা সবাই যা জানি তাহল, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার গণ্ডী ভারতবর্ষ হলেও প্রফেসর শঙ্কুর এক-একটা ঘটনা পৃথিবীর এক-এক জায়গায় ঘটছে। পরীর গল্প, দৈত্যদানোর গল্প, নীতিকথামূলক গল্পের বদলে শিশুদের বাস্তব পারিপার্শ্বিকের চেনা ডুবন সম্পর্কে আরো জানার কথায় উদ্দীপ্ত কৌতূহল চরিতার্থের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজের ক্রমোন্নতি ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনজনিত যে দ্রুত শিল্পায়ন সারা পৃথিবী জুড়ে মানব সভ্যতার একটা বিরাট পরিবর্তন এনে ছিল, তার প্রতিচ্ছাপ অনিবার্যভাবে তাঁর রচনায়ও পরেছিল। এমনকি তার কিশোরপাঠ্য গল্প-উপন্যাসেও।

  সত্যজিৎ রায় অরুণ বাগচীকে দেওয়া সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটিতে আরো বলেন, ...অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্য শিশুরা পড়ে বুঝতে পারবে না। ...ওঁর রাজকাহিনী-টাজকাহিনী অবশ্য আলাদা ব্যাপার। ... বুড়ো আংলার মধ্যে যে ভাষার বুনুনি, তার রসগ্রহণ ছোটরা করতে পারে বলে মনে হয় না।” অনেকেই অবশ্য বলবেন, 'বুড়ো আংলা' অবশ্যই শিশুদের জন্য লেখা সাহিত্য। তবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শকুন্তলা' ও 'ক্ষীরের পুতুল' যেমন রূপকথামূলক, অন্যদিকে 'বুড়ো আংলা' ফ্যান্টাসি-ধর্মী গল্প।

  বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি চরিত্র গোয়েন্দা প্রদোষ চন্দ্র মিত্র, বৈজ্ঞানিক প্রফেসর শঙ্কু আর তারিণীখুড়ো ছাড়াও তাঁর

  “বারো 'টির ছোটগল্পের সংকলনের বেশিরভাগ গল্পেই ধাঁধা ও শব্দ কৌতুকের আধিক্য দেখা গেছে। অনিশ্চিত উৎকণ্ঠা, ভয় আর ধাঁধার রহস্য

  উন্মোচন থাকার ফলে সত্যজিৎ রায়ের গল্পগুলি সবসময়েই দশ বছরের অধিক বয়সের শিশুদের বেশী আকর্ষণ করে এসেছে। এখন প্রশ্ন উঠবে, সবসময় বলতে কি ২০২০র পর যে নতুন করোনা সময় শুরু হয়েছে তখনও সত্যজিৎ রায়ের কাহিনীগুলো পাঠক সমাজে সমাদৃত?

  উত্তর অনেকের জানা, তবু বলি। সত্যজিৎ রায়ের অনেক রচনাই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে আর কমিকসের আকারে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে বর্তমানেও তাঁর বইগুলোর দ্বিতীয় প্রজন্মের পাঠক-সমাজ দ্রুত গড়ে উঠছে। নয়াদিল্লীর প্রবাসী বাঙালী গোপা মজুমদারের সাবলীল অনুবাদের জন্য সত্যজিৎ রায়ের লেখা বাংলার বাইরেও জনপ্রিয় একথা অনেকেই স্বীকার করেন। সত্যজিৎ রায়ের সাথে চিঠিতে ও ফোনে কথা বলে গল্পের মনস্তত্ত্ব জেনে তবেই অনুবাদক অনুবাদগুলি করেছিলেন বলেই বিশ্বের দরবারে আজও সত্যজিৎ রায়ের রচনার এত সমাদর। আর তারসঙ্গে করোনা কালে অডিও বুক তার গল্পগুলোর সমাদর আরো বাড়িয়ে চলেছে।

  সারা পৃথিবীর ইংরাজী মিডিয়ামে শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের কাছে এই মুহূর্তে সবথেকে জনপ্রিয় বইগুলি হল ডায়েরিধর্মী সিরিজগুলো। যেমন, ডায়েরি অফ উইম্পি কিড, রোয়াল্ড ডালের কালেকশান। অন্যদিকে, সত্যজিৎ রায়ের কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর প্রধান চরিত্র স্কটিশচার্চ কলের অধ্যাপক ত্রিকোশেশ্বর শঙ্কুর সমস্ত কাহিনীগুলিও ডায়েরির অংশ থেকে গৃহিত হয়েছে। অ্যানাইহিলিন, নার্ডিগার, স্নাফগান, ক্যামেরাপিড, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, এগুলি ছিল শঙ্কুর আবিষ্কারগুলির নাম। এদের কোনওটি ওষুধ, কোনওটি যন্ত্র, কোনওটি গ্যাজেট। শঙ্কুর ৭২টি আবিষ্কার সম্বলিত ডায়েরিগুলোর গল্পগুলো পড়ে বা শুনে এখনো শিশুরা করোনার সময়েও মানসিক চাপ কিছুটা হলেও কমাতে পারবে। শুধু তাই নয়, আজ তাঁর শততম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে করোনার প্রকোপে অস্তিত্বের সমস্যাসঙ্কুল জগৎটাকে নিয়ে যখন মানুষ হিমসিম খাচ্ছে. তখনও তার গল্পের পাঠক বলতেই পারে আজ যদি প্রফেসর শঙ্কুর 'মিরাকিউরল' বড়ি তৈরি করা যেত তাহলে করোনার দফারফা হতো এক নিমেষে। এইজন্যই এসমস্ত গল্প কালজয়ী আখ্যা পায়। এইসমস্ত কারণেই নতুন প্রজন্মের কাছে পাওয়া না পাওয়ার এক অ্যালিগরি ঘটায় কাহিনীগুলো। তাছাড়াও ভ্রমণ পিপাসু সববয়সী পাঠকের কাছে দুই বা ততোধিক দেশের সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া রূপে ধরা দিচ্ছে শঙ্কুর কাহিনীগুলি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব খুব ভাল একটি লেখা...

    ReplyDelete
  2. ঠিক বলেছো। মিরাকিউরোল বা আনিহিলিন যা দিয়ে কোরোনাকে গায়েব করে দেওয়া যাবে এ সবের খুব প্রয়োজন ! আর সত্যজিতের গল্পে প্রচুর অজানাকে জানার সঙ্গে সঙ্গে মন মুক্তি পায় এক সুন্দর ভুবনে। সেখানে নোংরা কিছু নেই। সেদিক থেকে ছোটদের জন্য উপযুক্ত হলেও সব বয়সী মানুষের পড়ার মতো চিন্তার খোরাক পাওয়ার মতো ম্যাচিওরড লেখা ওনার। খুব ভালো লিখেছো

    ReplyDelete
  3. সত্যিই যদি মিরাকিউরল আবিষ্কার করা যেত তাহলে করোনা কেন সমস্ত রোগ ই তো ভ্যানিস।বেশ ভালো হতো।

    ReplyDelete