জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৮/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৮

শ্যামল জানা

দাদাইজম্ ও অ্যান্টি আর্ট

“The history of art is a parody of the history of politics”— Dada Maxim ৷ প্রতিটি মানুষই সমাজের প্রোডাক্ট৷ আর, এই সমাজই জন্ম দেয় রাজনীতির৷ যেহেতু শিল্পীরা অন্যদের মতো সমাজেরই একজন, তাই, রাজনীতির ইতিহাসই শিল্পের ইতিহাস তৈরি করে৷ রাজনীতির বাইরে গিয়ে শিল্পের স্বতন্ত্র কোনো ইতিহাস তৈরি হতে পারে না, বা কেউ গড়তেও পারে না৷ এই রকমই মনে করতেন দাদাইস্টরা৷ এঁদের অধিকাংশই মনে করতেন— সাধারণ মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে এই যে ভয়ংকর যুদ্ধে চালিত করা হচ্ছে, তার একমাত্র কারণ ও যুক্তি হচ্ছে— সংরক্ষণশীল পুঁজিবাদী সমাজ (Bourgeois capitalist society)৷ আর একটু উদাহারণ দিয়ে ব্যাপারটা খোলসা করা যাক্৷ ধরা যাক্ আমার আঙুল কেটে রক্ত বেরোচ্ছে৷ এই যে রক্ত বেরোচ্ছে, তা আঙুল কাটার কারণে(Reason)৷ আর, কোন যুক্তিতে(Logic) আঙুল কাটল? অন্যমনস্ক হয়েছি বলে৷ ঠিক সেই রকম— মানুষকে যুদ্ধে চালিত করা হচ্ছে, কারণ যুদ্ধ বেঁধেছে বলে(Reason)৷ আর, যে কোনো কিছুই চাহিদার তুলনায় যখন বেশি(উদ্বৃত্ত) হয়, তখনই দখলের প্রশ্ন ওঠে, এবং দখল করতে গেলেই বেঁধে যায় যুদ্ধ(Logic)৷

    তাই, সংরক্ষণশীল পুঁজিবাদী সমাজ যে Reason ও Logic থেকে তৈরি হয়, ওই একই সময়ে একই সমাজে যে শিল্প সৃষ্টি হয়, তাতেও ওই একই Reason ও Logic বর্তায়, অন্যথা হয় না৷ আর, ওই Reason ও Logic অনুযায়ীই তৈরি হয় Aesthetics ৷ ফলে, আমি যদি আমার শিল্পের মাধ্যমে সংরক্ষণশীল পুঁজিবাদী সমাজের বিরোধিতা করতে চাই, তাহলে, আমার শিল্প থেকে ওই সংরক্ষণশীল পুঁজিবাদী সমাজের Reason, Logic ও Aestheticsকেও বাদ দিতে হবে৷ ঠিক এই জায়গা থেকেই সাধারণভাবে একটা শিল্পের মধ্যে যে শিল্পসম্মত ভাবাদর্শগত প্রকাশভঙ্গি  থাকে, তাকেও খারিজ করার ঘোষণ করলেন দাদাইস্টরা৷ তার বদলে তাঁরা বিস্ময়করভাবে সাগ্রহে গ্রহণ করলেন বিশৃঙ্খলা ও অযৌক্তিকতাকে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— জার্মান শিল্পী জর্জ গ্রস্(George Grosz) পুনরাহ্বান জানালেন যে, দাদাইস্ট আর্ট-এর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিবাদ! বললেন— “এই যে পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংসে মেতে ওঠা পৃথিবী, তার বিরুদ্ধেই আমাদের যাবতীয় প্রতিবাদ৷”

  যে কোনো আন্দোলন, বিশেষ করে কোনো শিল্প আন্দোলন, কখনোই হঠাৎ করে শুরু হয়নি বা হয় না৷ দাদাইজম্ও তার ব্যতিক্রম নয়৷ খাতায়-কলমে ১৯১৬ সালে দাদাইজম্-এর জন্ম হলেও, তার অনেক আগেই, অন্তত প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধের আগে শিল্পে যে প্রাক-যুদ্ধ আভাঁ গার্দ আন্দোলন হয়েছিল(যার মধ্যে কিউবিজম্ও ছিল), তাতেই এর বীজ কিন্তু পোঁতা হয়ে গেছিল৷ বিশেষ করে ‘মার্শেল দুশাম্প’-এর হাত ধরে ১৯১৩ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে শিল্পে “অ্যান্টি আর্ট” নামে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার ভেতরেই ‘দাদা’-র দর্শনের পূর্ণ সূত্রপাত থেকে গেছিল৷

  এতদিন শিল্প বলতে যা বোঝাতো, তা সৃষ্টি করার জন্য, সাধারণভাবে যে ধারণা ও মনোভাবকে মিলিতভাবে বিন্যাস ঘটানো হত এতদিন, তাকেই প্রথম প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল এই “অ্যান্টি আর্ট”৷ যা কিনা আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা বিপরীতধর্মী মনে হলেও আদতে তা ছিল না৷ এই যে, অনুকূল পরিস্থিতিতে, নির্বিঘ্নে, বাড়িতে, রয়ে-বসে শিল্প-চর্চার যে রেওয়াজ, এই পদ্ধতিকে এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল, এবং বাতিলও করে দিয়েছিল এই “অ্যান্টি আর্ট” আন্দোলন৷ এই আন্দোলনের মূল দর্শনের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হল দাদাইস্টরা এবং এঁদের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্তও হয়ে গেল৷ দর্শনগত মিল থাকার ফলে এই যে “অ্যান্টি আর্ট”-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল “দাদাইজম্”, এই অভিনবত্বের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব একজনকেই দিতে হয়৷ যাঁর নাম মার্শেল দুশাম্প৷ আর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে যে সম্পূর্ণ নতুন ও অভিনব শিল্পটিকে তিনি হাতিয়ার করেছিলেন, তার নাম— “Readymade and The Found Object”৷ (ছবি-১)
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের হাতের গোড়ায় যে সব অতি ব্যবহার্য বস্তু সারাক্ষণ চোখের সামনে থাকে, তাদের থেকেই কোনো একটিকে খুঁজে(Found object) শিল্পে পরিণত করা৷ এ প্রসঙ্গে আমরা আগে ‘৩০’ ও ‘৩৬’তম কিস্তিতে বিশদ আালোচনা করেছি, ছবিও দেখিয়েছি৷

১৯১৩ সালে তিনি ফেলে দেওয়া বাতিল ফ্রক সমেত একটি সাইকেলের চাকাকে একটি কিচেন টুলের ওপর এমনভাবে প্রতিস্থাপন করলেন, যেন কিচেন টুলটি পেডেস্টাল, ও সাইকেলের চাকাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য(Sculpture)(ছবি- ‘৩০’ ও ‘৩৬’তম কিস্তিতে আছে)৷ এই যে একটি সচল বস্তু, বাতিল হওয়ার পর তার ব্যবহারিক দিককে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে বিস্ময়করভাবে তাকে একটি নতুন কনসেপ্টে ব্যবহার করা, তাকে শিল্প হিসেবে প্রতিপন্ন করা, রিকনসেপ্ট করা— একেই বলা হচ্ছে— “Readymade and The Found Object”৷ শিল্পের ইতিহাসে যেহেতু এটি আগে ঘটেনি, তাই একে বৈপ্লবিক সংযোজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ এর আর একটি অভিনব দিক হচ্ছে— যেহেতু শিল্পটি আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা বা রেডিমেড, খুঁজে পাওয়া(Found Object), তাই এই শিল্পটি প্রস্তুত করতে চর্চা করে অর্জিত দক্ষতা-পরিশ্রম-সময় এসব কোনো কিছুরই সে রকম প্রয়োজন পড়ে না!

  মূলত এই বিষয়টি ছাড়াও দাদাইজম্-এ থাকল কিছুটা কিউবিজম্, উন্নততর কোলাজ, এবং বিমূর্ত শিল্প(Abstract Art)৷ মোট কথা, এই দাদাইজম্ আন্দোলন তাদের শিল্প থেকে বাস্তবতার ও গতানুগতিকতার সীমাবদ্ধতাকে একেবারে ছেঁটে ফেলে দিল৷

  তবে, আমরা যদি ছবি ও ভাস্কর্যের বাইরে চোখ ফেলি, তাহলে দেখব— ফ্রেঞ্চ লেখক ও নাট্যকার ‘অ্যালফ্রেড জেরি’-র ১৮৯৬ সালে লেখা নাটক ‘উবু রোই’-তে বা ১৯১৬-১৭ সালে ‘এরিক সাতাই’-এর ব্যালে ‘প্যারাডে’-তে দাদাইজম্-এর সংকেত ছিল৷ যা, শিল্পের ইতিহাসে ‘প্রোটো-দাদাইস্ট ওয়ার্ক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে৷ তবে, ‘হুগো বল’ ১৯১৬ সালে যে ‘দাদা-ম্যানিফেস্টো’ লিখেছিলেন, ওখান থেকেই অফিসিয়ালি দাদাইজম্-এর জন্ম ধরে নেওয়া হয়৷ (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. ৩২ থেকে ৩৮ পর্যন্ত গোগ্রাসে পড়েছি। এই পর্যন্ত এসে মুগ্ধ
    বিস্ময়ে চমকে উঠেছি বারবার।
    শিল্প বিষয়ক এইরকম বৌদ্ধিক
    আলোচনা আমি অন্ততঃ কমই
    পড়েছি। আমার মনে হয় ভাবীকাল
    সমৃদ্ধ হবে শুধু তাই নয়,আগামী
    প্রজন্মের শিল্পী ও বর্তমান সময়ের
    শিল্পীরাও ঋদ্ধ হবে।
    এইরকম গুরুগম্ভীর বিষয়কে সে
    তার লেখার মুন্সিয়ানায় ও সারল্যে
    এতটাই প্রাঞ্জল করে তুলছে তাতে
    জনারন্যের হয়ে উঠছে এই রচনা।
    সর্বাপেক্ষা বড় কথা লেখাটি পড়ার
    সাথে সাথে ইতিহাস,স্বর্নখচিত অতীত,রাজনীতি,বিজ্ঞান,ভুগোল সব কিছুর আস্বাদ পাঠক পাবে।
    প্রকৃত রসস্বাদন করতে পারলে
    পাঠক বঞ্চিত হবে না,এটা নিশ্চিত
    করে বলতে পারি।
    দীর্ঘদিনের পরিচয়ের সূত্রে জানি
    শ্যামল জানার সমস্ত কাজই দীর্ঘ
    পরিশ্রমের ও অধ্যাবসায়ের। এই
    লেখাটিও শিল্পকলার অভিনবত্ব
    প্রকাশে সুসংবদ্ধ।
    তাকে আমার কুর্নিশ!

    ReplyDelete