জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- ইউরোপ (ইংল্যান্ড)নেংটি ইঁদুরের পাড়াপড়শি /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- ইউরোপ (ইংল্যান্ড)
চিন্ময় দাশ

নেংটি ইঁদুরের পাড়াপড়শি 

ধেড়ে ইঁদুর নেংটি ইঁদুর এক বাড়িতেই বাসা।
মিলে জুলেই থাকে দুজন দিন কেটে যায় খাসা।

  কাঠের একটা পূরানো বাড়ি। তাতে থাকে দুই বন্ধু-- ধেড়ে ইঁদুর আর নেংটি ইঁদুর। সকাল হয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ল দুজনে। এবার পেটের চিন্তা। উনুনে জল চাপিয়ে, বেরিয়ে পড়ল তারা।
ফিরে এলো যখন, দুজনের মুখেই কয়েকটা করে বাজরার দানা। দুজনেই ভাবল, পুডিং বানানো যাবে আজ। জল তো ফুটছিলই হাঁড়িতে। ধেড়ে ইঁদুরের অসুবিধা হল না। মুখ উঁচিয়ে, বাজরাগুলো হাঁড়িতে ফেলে দিল।
  নেংটির ছোট চেহারা। হাঁড়ির মুখের নাগাল সে পাবে কী করে? কিন্তু যে কোনও উঁচু যায়গায় বেয়ে বেয়ে উঠে পড়তে ভারী ওস্তাদ সে। নেংটিটা করেছে কী, উঠে পড়েছে হাঁড়ির গা বেয়ে।
আর, যেই হাঁড়ির মুড়িতে দুটি পা তুলেছে, অমনি হাঁড়ি গেল উল্টে। নেংটিটাকে নিয়েই। 
জল তো ফুটছিলোই টগবগ করে। গরম জলে মাখামাখি হয়ে ছটফট করতে লাগল সে। কিছুক্ষণ কিচ-কিচ শব্দে চেঁচাল। তারপর মরেই গেল বেচারা।
নিজের বাসা থেকে শব্দটা কানে গিয়েছে ধেড়ে ইঁদুরটার। সে বেরিয়ে এসে দেখতে চলল, ব্যাপারটা কী? চেঁচায় কেন নেংটি?
  একটা তে-পায়া টুল ছিল ঘরটার এক কোণে। সে ধেড়েকে ডেকে বলল-- কী হয়েছে গো? অমন হনহনিয়ে চললে কোথায়? 
  ততক্ষণে ধেড়ে পৌঁছে গিয়েছে নেংটির কাছাকাছি। উল্টানো হাঁড়ি, জলে মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকা নেংটি-- সব দেখে, বুঝতে কিছুই বাকি রইল না তার। ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগল সে।
তে-পায়া বলল-- আরে, কাঁদছো কেন? হোলটা কী, বলবে তো।
-- দেখতে পাচ্ছ না, নেংটি মারা পড়েছে গরম জলে পুড়ে।  তাই তো কাঁদছি আমি।
-- আরে, আরে! তাই নাকি? দাঁড়াও। আমি আসছি। বলেই, তিন পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে লাগল তে-পায়া। 
  একটা ঝাড়ু ছিল ঘরটার অন্য এক কোণে। তে-পায়াকে  লাফাতে দেখে, সে বলল-- কীগো, তিন-ঠেঙে। লাফাচ্ছ কেন? চললে কোথায়? 
তে-পায়া বলল-- নেংটি মারা পড়েছে গরম জলে পুড়ে। ধেড়ে কান্নাকাটি করছে তা দেখে। তাদের কাছে যাচ্ছি আমি।
  ঝাড়ু বলল-- সে কী? ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। আগে একটু সাফ-সুতরো করে দিই মেঝেটা। সে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করে দিল।
এমন সময় দরজার পাল্লা বলে উঠল-- হোলটা কী আজ? সাত সকালে ঝাঁট দিতে লেগেছ যে বড়? অন্যদিন তো অতো গরজ দেখি না বাপু তোমার?
ঝাড়ু বলল-- নেংটি মারা পড়েছে গরম জলে পুড়ে। তা দেখে, ধেড়ে কান্নাকাটি করছে। তে-পায়া যাচ্ছে তাদের কাছে। তাই আমি এসে একটু পরিষ্কার করে দিচ্ছি মেঝেটা।
  পাল্লা বলল-- আহারে ! তাই নাকি? ভারী কষ্ট হচ্ছে শুনে। কী করি বালো? আমার তো হাত পা বাঁধা। যাবার উপায়টি নাই।বলেই কাঁদতে শুরু করে দিল সে। আর তাতে ক্যাঁচর-ক্যাঁচর শব্দ হতে লাগল কাঠে আর কব্জায়। 
  সে শব্দ শুনে জানালার পাল্লা বলল-- হঠাৎ কী হল, দরজা-দাদা? কান্নাকাটি কীসের?
দরজার পাল্লা বলল-- আর বোল না, ভাই। নেংটি মারা পড়েছে গরম জলে পুড়ে। তা দেখে, ধেড়ে কান্নাকাটি করছে। তে-পায়া যাচ্ছে তাদের কাছে। ঝাড়ু এসে পরিষ্কার করতে লেগেছে মেঝেটা। তাতে কান্না সামলাতে পারছি না আমি।
  জানালার পাল্লা বলল-- সে কী কথা গো, দাদা? এত সব কাণ্ড হয়েছে? আমি জানতেই পারিনি! বলেই,সেও কান্না জুড়ে দিল। তাতেও ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ উঠতে লাগল আবার।
  জানালার ঠিক বাইরে ছিল একটা পুতুল-বুড়ো। অনেক দিন ধরেই পড়ে আছে পুতুলটা। জানালার শব্দ শুনে সে বলল-- তোমার আবার হোলটা কী? শব্দ করো কেন?
জানালার পাল্লা বলল-- আমার আবার কী হবে? নেংটি মারা পড়েছে গরম জলে পুড়ে। তা দেখে, ধেড়ে কান্নাকাটি করছে। তে-পায়া যাচ্ছে তাদের কাছে। ঝাড়ু এসে পরিষ্কার করতে লেগেছে মেঝেটা। তাতে দরজার পাল্লা কান্না জুড়ে দিয়েছে। আমিও আর নিজেকে সামলাতে পারছি না গো। যতই হোক, একই জায়গায় কতদিন আছি সবাই। কষ্ট তো হয়ই, বলো?
পুতুল বলল-- সে কী কথা গো? এই তো একটু আগে দুটিতে ফিরেএল দেখলাম। হায় হায়, এ কী হল? এখন আমি কী করি? বলেই, কী যে হল বুড়োটার, ছুট লাগিয়ে দিল জোর কদমে। বাড়িটাকেই চক্কর কাটতে লাগল ছুটে ছুটে।
  একটা কাঠবাদামের গাছ ছিল বাড়িটার পিছন দিকে। অমন করে বুড়োকে ছুটতে দেখে, কিছুই ঢুকল না তার মাথায়। সে চেঁচিয়ে বলল-- কী হল গো, বুড়োদাদা? ক্ষেপে গেলে না কি?
  পুতুল বলল-- ক্ষেপে যাবার মতোই ঘটনা যে। এই দেখলুম, নেংটি ঘরে ফিরে এল। এরই মধ্যে সে মারা গেল গরম জলে পুড়ে। তা দেখে, ধেড়ে কান্নাকাটি করছে। তে-পায়া যাচ্ছে তাদের কাছে। ঝাড়ু এসে পরিষ্কার করতে লেগেছে মেঝেটা। তাতে দরজার পাল্লা কান্না জুড়ে দিল। জানালার পাল্লাও কাঁদতে লেগেছে। মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার।
-- বলো কী গো? তাই নাকি? হায়, হায়! এ কী সর্বনাশ। বলেই, হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল গাছটা। বলল-- এই দুঃখের সময়, এমন সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক নয় একেবারে। সব পাতা ঝরিয়ে ফেলব আমার। 
যেমন বলা, তেমন কাজ। গাছটার ডালপালা থেকে সব পাতা ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। কী মজবুত আর গোল গোল সবুজ রঙের পাতা! দেখতে দেখতে সব পাতাই ঝরে পড়ে গেল গাছটার।
  হয়েছে কী, একটা ছোট্ট পাখি বাসা বানিয়ে থাকত সেই পাতার আড়ালে। এখন একেবারে আলগা হয়ে গেল তার বাসাটা। সে অবাক হয়ে গাছকে বলল-- এ কী করলে গো? এমন করে পাতা সব ঝরিয়ে দিলে কেন?
কাঁদতে কাঁদতে গাছ বলল-- আরে, শুনছোটা কী তাহলে? নেংটিটা মরে গেল গরম জলে পুড়ে। তা দেখে, ধেড়ে কান্নাকাটি করছে। তে-পায়া যাচ্ছে তাদের কাছে। ঝাড়ু এসে পরিষ্কার করতে লেগেছে মেঝেটা। তাতে দরজার পাল্লা কান্না জুড়ে দিল। জানালার পাল্লাও কাঁদতে লেগেছে। সেই দুঃখে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে বুড়ো পুতুলটা। এ অবস্থায় কি চোখে জল রাখা যায়, না কি দাঁড়িয়ে থাকা যায় সাজগোজ করে? তুমিই বলো? আমিও সব পাতা ঝরিয়ে ফেলে দিলাম। 
-- সত্যিই ভারী দুঃখের কথা। কাঁদতে কাঁদতে পাখিটা বলল-- তাহলে, আমিও আমার সব পালক ঝরিয়ে ফেলে দেব। পাখিটার গলা তো ভারী মিষ্টি। কাঁদছে বটে, শোনাচ্ছে একেবারে মিষ্টি সুরের গানের মত। আর, তার অতো সুন্দর পালকগুলো ঝরে ঝরে পড়তে লাগল শরীর থেকে।
  সে সময় একটি ছোট্ট মেয়ে যাচ্ছিল সেই পথ দিয়ে। এক ভাঁড় দুধ নিয়ে যাচ্ছিল, ভাই-বোন মিলে খাবে বলে। এতো সব সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড দেখে, অবাক গলায় বলল-- কী হয়েছে গো? অমন করে সব পালক ঝরিয়ে ফেললে কেন?
  কাঁদতে কাঁদতে পাখি বলল-- খুব দুঃখের ব্যাপার গো, মেয়ে। নেংটিটা মরে গেল গরম জলে পুড়ে। তা দেখে, ধেড়ে কান্নাকাটি করছে। তে-পায়া যাচ্ছে তাদের কাছে। ঝাড়ু এসে পরিষ্কার করতে লেগেছে মেঝেটা। তাতে দরজার পাল্লা কান্না জুড়ে দিল। জানালার পাল্লাও কাঁদতে লেগেছে। সেই দুঃখে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে বুড়ো পুতুলটা। এ অবস্থায় চোখে জল রাখা যায়, বলো? 
  -- দূর ছাই। সকলের মনে এতো কষ্ট। এখন কি আর দুধ খাবার সময়? ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে দিল মেয়েটা। সাদা দুধ গড়িয়ে যেতে লাগল মাটিতে।
যে বাড়িতে এত সব কাণ্ড ঘটে চলেছে, তার মালিক একটা বুড়ো লোক। তার কাঠের বাড়িটাও বুড়োর মতোই অনেক দিনের পুরাণো। একটা সিঁড়ি লাগিয়ে, নড়বড়ে বাড়িটা মেরামত করছিল বুড়ো। সবই দেখছিল, আর শুনছিলও সে।     
  ছোট্ট একটা মেয়ে দুধ ফেলে দিতে, টনক নড়ল বুড়োর। এখন কি আর চুপ করে থাকবার সময়? সেও পা দিয়ে ঠেলে সিঁড়িটা ফেলে দিল। তাতে সিঁড়িটা তো পড়লোই, নিজেও পড়ে গেল ধপাস করে। তাতে কোমরটাই ভেঙে গেল বুড়োর। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাও রইল না। তা দেখে, শিকড়-বাকড় শুদ্ধ উপড়ে পড়ে গেল বাদামগাছটা। বুড়ো পুতুলটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তাতে। 
  তারপর? সে এক হলুস্থুল কাণ্ড। গাছের ভারে প্রথমে ভাঙল জানালাটা। জানালা গিয়ে পড়ল দরজার উপর। দরজা গিয়ে পড়ল ঝাড়ুর উপর। ঝাড়ু পড়ল তে-পায়ার উপর। তখনও বন্ধুর জন্য হাপুস-হুপুস করে কাঁদছিল ধেড়ে ইঁদুরটা। তারই উপর এসে পড়ল তে-পায়াটা।
বলতে এতখানি সময় গেল বটে, কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে গেল চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে। গাছের ভার সইতে না পেরে, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেল কাঠের গোটা বাড়িটাই। সবাই চাপা পড়ে গেল তার তলায়।
নেংটি ইঁদুরের জন্য কাঁদছিল তার বন্ধু। এখন এত জনের জন্য কাঁদবে কে? কেউ তো আর রইল না কোথাও? 
  ছোট্ট মেয়েটা কেবল দাঁড়িয়ে ছিল পথের উপর। সে বেচারি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভগ্নস্তুপটার দিকে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 


Post a Comment

1 Comments