মূলা ষষ্ঠী
ভাস্করব্রত পতি
অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন মহিলারা উপোস করে এই ব্রত উদযাপন করে। এতে প্রয়োজন হয় মূলো, পান, ময়দা এবং কলা। এই লৌকিক উৎসবের অন্যতম উপচার হল এদিন কোনও রকম আমিষ খাওয়া তো চলেই না বরং পুরোপুরি উপোস করে পূজো করতে হয়। পূজোর পরে রুটি দিয়ে মূলোর তরকারি খাওয়ার বিধান রয়েছে। এই মূলা ষষ্ঠীকে 'মূল করনী ষষ্ঠী'ও বলে। এটি পালন করলে সংসারে ছেলে মেয়ের কোনো রোগজ্বালা হয়না। তাঁরা নীরোগ হয়ে বসবাস করে সংসারে।
আসলে শীতকাল এলেই বাজারে নতুন নতুন সবজির আমদানি হয়। সেগুলির মধ্যে লম্বা, সাদা মূলো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহজেই। কেবলমাত্র শীতকাল এলেই এখানে মূলো মেলে। আর ঠিক এই সময় তথা অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীও পড়ে শীতকালে। বাংলার বহু লৌকিক উৎসবের সঙ্গে পরিবেশ প্রকৃতির ওতোপ্রতো সম্পর্ক রয়েছে। এই সময়ের ষষ্ঠী পূজার সাথেও শীতকালীন ফসল মূলো খাওয়ার বিধান বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই যুক্ত হয়ে গিয়েছে। সব্জির তালিকায় থাকা ছাপোষা মূলো খাদ্যবস্তু থেকে দেবীর নৈবেদ্যতে রূপান্তরিত হয়েছে। কোথাও কোথাও মা কালীকেও মূলো নিবেদন করে নৈবেদ্য হিসেবে। একে বলা হয় মূলো কালী। অনেকে বাড়ির গৃহদেবতাকেও পৌষমাসে মূলো নিবেদন করেন। বিভিন্ন কালীমন্দিরে দেবীর কাছে জোড়া মূলো উৎসর্গ করতে লম্বা লাইন পড়ার দৃশ্য দেখা যায়। কালীঘাটেও পরিলক্ষিত হয়।
মূলো ষষ্ঠী উপচার শুরুর পেছনে একটি লৌকিক কাহিনীর সন্ধান মেলে। কোনও এক সময় এক দেশে এক বামুন তাঁর ছেলে বউ নিয়ে বাস করতো। একদিন বামুনের বড্ড মাংস খাবার ইচ্ছে হল। বামুন খানিকটা হরিণের মাংস নিয়ে বউকে রাঁধতে দিলে। মাংস রান্না হলে বউ ঝিকে ডেকে একটু মাংস চাকতে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “নুন ঝাল ঠিক হয়েছে"?
ঝি বলল, "কিছুই টের পেলুম না, আর একটু দাও”। বউ আবার দিল। ঝি। ঝি আবার খেয়ে বলল, "কিছুই স্বাদ পেলাম না, আর একটু দাও”। এমনি করে যখন প্রায় সব খাওয়া শেষ, তখন বউ বলল, “কি সৰ্ব্বনাশ! মাংস যে সব ফুরিয়ে গেল, আমি কি করে শ্বশুরকে খেতে দেবো”?
ঝি তখন বলল, “দেখি, বাজারে মাংস আছে কিনা”। এই বলে সে মাংস কিনতে বেরিয়ে গেল। কিন্তু বাজারে কোথাও মাংস পেলনা। সমস্ত দোকান বন্ধ। যদিও বা দুএকখানা দোকান খোলা আছে, সেখানে মাংস নেই ৷ তখন কি করা যায়, সামনে বাগানের ভেতরে একটা মরা বাছুর পড়ে ছিল। সেটা থেকেই খানিকটা মাংস কেটে নিয়ে বেশ করে পরিস্কার করে এনে বউকে দিয়ে বলল, “এই নাও, এবার রান্না বসিয়ে দাও”। তখন বউ তাড়াতাড়ি রাঁধতে লেগে গেল। এদিকে মাংস নামাতে গিয়ে দেখতে পেল যে মাংস সিদ্ধ হয়নি। তখন ঝিকে বলল, “হ্যাঁ রে, এ কি মাংস এনেছিস? এ যে একেবারেই সিদ্ধ হচ্ছেনা"। ঝি তখন বলল, “কি জানি বাপু, আমারও কেমন সন্দেহ হচ্ছে”।
কিছু সময় পরে বামুন এসে ভাত খেতে চাইলো। বউ তো ভয়েই অস্থির। কি করবে! শেষকালে একটা উপায় ঠিক করে ঝিকে জানিয়ে রাখে, “দেখ, তুই চারদিকে জল ছড়িয়ে খুব পিছল করে রাখ। আজ আমি যখন থালা নিয়ে পরিবেশন করতে যাব, অমনি পা পিছলে পড়ে যাব। আর তুই তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে, আমার মুখে মাথায় জল দিবি। তাহলে ভাত তরকারি সব নষ্ট হয়ে যাবে। আর খেতে দিতে হবে না”।
তারপর বামুন খেতে বসতেই বউ যখনি পরিবেশন করতে এলো, আর অমনি পা পিছলে পড়ে গেল। বামুন তখন "কি হল, কি হল” করে চেঁচিয়ে উঠলেন। ঝি তখনি তাড়াতাড়ি এক ঘটি জল নিয়ে তাঁর মুখে মাথায় দিতে লাগলো। সেই জলে হেঁসেলের সব খাবার নষ্ট হয়ে গেল। বামুনের আর সেদিন খাবার জুটল না। কিন্তু এ ঘটনায় বউয়ের মনে খুব কষ্ট হল। সে তাঁর স্বামীকে ডেকে সব কথা খুলে জানালো। তারপর ঝিকে বলল, “তুই কোথা থেকে মাংস এনেছিস, দেখাবি চল"। ঝিয়ের সঙ্গে বামুন চলে গেল। ঝি যেখান থেকে মাংস এনেছিল, দেখিয়ে দিল। তখন বামুনের ছেলে দেখে তো অবাক। তারপর ফিরে এসে বউকে বলল, “ঐ ঝি টা একটা মরা বাছুরের মাংস নিয়ে এসেছিল”।
সেদিনটা ছিল অগ্রহায়ণ মাসের ষষ্ঠী। বউ তাড়াতাড়ি মূলো, কলা, পান দিয়ে মা ষষ্ঠীর পুজো করে মরা বাছুরের ওপর ফুল জল ছড়িয়ে দিল। এটা করতেই সঙ্গে সঙ্গে মরা বাছুরটা বেঁচে উঠলো! এই আজব কাণ্ড দেখে সবাই খুব অবাক! তৎক্ষণাৎ চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল ঘটনাটা। এরপর বউ সমস্ত ঘটনা শ্বশুরকে খুলে বলল। শ্বশুর শুনে তো তাজ্জব। দারুণ সুখ্যাতি করল বউয়ের। বউ তখন খুব ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করল। আর বলে দিল অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন কেউ যদি মাছ মাংস খায় তবে তা গোমাংস খাওয়ার সমান পাপ হবে। ঠিক সেদিন থেকেই আপামর জনসাধারণ এই দিনটিতেমা ষষ্ঠীর পুজো করে যে কোনও ধরনের মাংসের বদলে মূলোর তরকারি দিয়ে রুটি খায়।
এই প্রথাটির নাম হল মূলা ষষ্ঠী। আস্তে আস্তে সারা দেশে মূলো ষষ্ঠীর পূজো প্রচারিত হয়ে গেল। সবাই ভক্তি ভরে এই লৌকিক উৎসবটি যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে পালন করতে থাকলো।
উল্লেখ্য যে, মূলা ষষ্ঠীকে কেন্দ্র করে পুরাতন মালদার মোকাতিপুর এলাকার বেহুলা নদীর তীরে একটি বিশেষ মেলা বসে। একে 'জুয়াড়ি মেলা' বলে। তবে 'লেউড়ির মেলা' নামেও পরিচিত। এখানে বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন, যার নাম 'লেউড়ি' খুব পাওয়া যায়। দেদার বিকোয়। এই লেউড়ি কেবলমাত্র এখানকার মেলাতেই মেলে। অন্যান্য মিষ্টি বিক্রিবাটা হলেও লেউড়ি মিস্টির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এই মেলাকে জুয়াড়ি মেলাও বলা কারণ এখানে নাকি রীতি মেনে মহিলারাও জুয়া খেলে থাকেন। বেহুলা নদীর পাড়ে মহিলারা লক্ষ্মী প্রতিমা পূজার্চনা করেন। পূজার প্রসাদে থাকে 'লেউড়ি'।
🍂
0 Comments