ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি
(তেইশ তম পর্ব --গজল গানের স্রষ্টা নজরুল )
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
বিশ্বময় প্রবাহিত সহস্র সুরের ধারায় ,সংগীতের লহরীতে--- বহুমাত্রিক, বিষ্ময়কর প্রতিভার অধিকারী বাংলা গজল গানের অন্যতম স্রষ্টা ও একচ্ছত্র সম্রাট বাঙালীর প্রাণের কবি কাজী নজরুল। আধুনিক গানের ধারায় কাব্যের সংস্পর্শ মিশিয়ে প্রথম দৃশ্যময় কাব্যরসে শ্রোতার স্বাদে বিস্তর পরিবর্তন এনেছিলেন। শিল্পী কবি একাধারে কাব্য রচয়িতা এবং অসাধারণ রাগ রাগিণী সংগীতের ও অনুপম স্রষ্টা। তাঁর রচিত গানগুলি হৃদয়ের গভীরতম শিল্পসুষমায় বিকশিত হয়ে মন স্পর্শ করে। নানা সুর ও বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর মিশ্রণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে যে অভিনব রসের সৃষ্টি হতে পারে তাও প্রমাণ করলেন তাঁর নব রাগ সৃষ্টিতে।
বাল্যকাল থেকেই সঙ্গীতশাস্ত্র সম্পর্কে নজরুলের সূক্ষ্ম জ্ঞান ও রসবোধ অতুলনীয়। সমকালীন অধিকাংশ গানের সুরে এ বিষয়টির অভাব তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ‘বেণুকা’ ও ‘দোলনচাঁপা’ নামে দুটি রাগিণী সৃষ্টি করেছিলেন। হিন্দি ভাষা ছাড়া ও যে খেয়াল, ধ্রুপদ ঠুংরি ইত্যাদি উচ্চাঙ্গসঙ্গীত রচিত হতে পারে নজরুল তাঁর সৃষ্টিতে রাশিরাশি প্রমাণ রেখে গেলেন। তিনিই সেই সংগীতশিল্পী ও স্রষ্টা যিনি বিভিন্ন বিদেশী শব্দ এবং সুর সমন্বয় করে বাংলা গানের জগৎ কে বিশেষ সম্মৃদ্ধময় করে তুলেছেন। নজরুলের গানগুলি তাঁর সমস্ত হৃদয় নিংড়ানো ব্যথা বেদনা রাগ অনুরাগের গভীরতম শিল্পসুষমার এক আন্তরিক নিবেদন।
🍂
গজলগান ফারসি, আরবি ও উর্দু ভাষায় রচিত ক্ষুদ্রগীত বা কবিতার রূপকল্প যা সুরের চেয়ে কথার ওপর বেশি জোরদেয়।যেমন সনেট কবিতার একটি রূপকল্প এবং বাংলা ভাষায় সনেটের জন্মদাতা যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত,তেমনি বাংলা গানে গজলের জন্মদাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন প্রাণের কবি নজরুল।
গজল গান একটি প্রণয় সংগীত বা প্রেমালাপ। বিশেষ ধরনের কবিতা ও গান যা প্রেম, ভক্তি, বিরহ এবং জীবনের অন্যান্য অনুভূতি প্রকাশ করে। অবশ্যই পারসিক/ফার্সি /উর্দু ভাষায় রচিত ক্ষুদ্রগীত বা কবিতার গীতিরূপই গজল যা সুরের চেয়ে কথার ওপর বেশি জোরদেয়। গানের ধারায় যুক্ত করেছিলেন পারস্য প্রেমের কবিতা 'গজল 'সেখানে তিনি মুক্ত সুরবিহারের মাধ্যমে পারস্য আর ভারতীয় সুরকে একই গ্রন্থিতে তাল আর ছন্দের বন্ধনে বাঁধার চেষ্টা করলেন। তাঁর গানে প্রচলিত তালের কাঠামোতেই সুর আর বাণীর ছন্দে তালের ছন্দ বিভাগ পেল এক নতুন মাত্রা; যা বর্তমান কালের শিল্পীর পরিবেশনাতে ও নতুন রূপে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এখানেই নজরুল ইসলামের গজলের কৃতিত্ব। গজল গানে প্রচলিত তালগুলোর ব্যবহারের নানা দিক উঠে এসেছে | সাধারণত প্রেম ও বিচ্ছেদের আবেগকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও আধ্যাত্মিকতা, দার্শনিকতা এবং অন্যান্য বিষয় যা গজল গানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। তিনি একমাত্র সংগীত স্রষ্টা যিনি বিভিন্ন বিদেশী শব্দ এবং সুর সমন্বয় করে আমাদের বাংলায় গজল কে জনপ্রিয় ও সম্মৃদ্ধ করেছেন। বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুলের বহুমুখী প্রতিভা ও অবদান অনস্বীকার্য। সংগীতে ও কাব্যের আকাশে নজরুল চিরউজ্জ্বল এক নক্ষত্র।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে টালমাটাল পরিস্থিতিতে পৃথিবী জুড়ে অশান্তির আগুন যুদ্ধের ঘোরতর দামামা অস্ত্রের ঝনঝনানি বেজে চলেছে যখন পিতৃবিয়োগের পর জীবনের নানা ওঠা পড়ায় ঘাত প্রতিঘাতের দোলায় নিদারুণ অর্থ সংকটে বহু চড়াই উৎরাই পারহয়ে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ১৭ বছরের কবি পৌঁছলেন করাচীতে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেনাবাহিনীর পদে চাকরি নিলেন। সেইখানে কবির নানান ধরনের অভিজ্ঞতা এবং ,ফারসি ভাষা ও গজলের সাথে নিবিড় পরিচয় ঘটায় কী এক অচেনা সুর তাল ছন্দের আকর্ষণে বিহ্বল জাতশিল্পী কবি মরীয়া হয়ে উঠলেন গজল গানের আদ্যন্ত আবিষ্কারে। কাজের অবসরে পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে ফারসি ও গজল বিষয়ে শিক্ষালাভ করলেন।
ফারসি গজল মূলত ঈশ্বর প্রেমের গান হলেও পরে এতে নরনারীর প্রেমও বিষয়বস্তু হওয়ায় যুক্ত হয়েছে পারস্যপ্রেমের কবিতা ,বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে ফারসি ও উর্দু গজলের ক্ষেত্রে এ তথ্য চিরসত্য। এরপর তিনি বাংলা গানের ধারায় যুক্ত করলেন তাল আর ছন্দ যা 'গজল' নামে পরিচিতি পেলো। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর একক বন্ধনীতেমুক্ত সুরবিহারের মাধ্যমে পারস্য আর ভারতীয় সুরকে তাল আর ছন্দের একই গ্রন্থিতে বাঁধার চেষ্টা করলেন। প্রচলিত তালের কাঠামোতেই সুর ,বাণীর ছন্দে তালের ছন্দ বিভাগ পেল নতুন মাত্রা। যা এই আধুনিক যুগেও অজস্র শিল্পীর পরিবেশনাতে নিত্য নতুন রূপে প্রকাশিত হচ্ছে। এখানেই কাজী নজরুল ইসলামের গজলের কৃতিত্ব। গজল গানে প্রচলিত তালগুলোর ব্যবহারের নানা দিক উঠে এসেছে কবির সঙ্গীত সৃষ্টির নিপুনতায়। |
নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেছেন ''গজল একটি বিশেষ ধরনের কবিতা ও গান যা প্রেম, ভক্তি, বিরহ এবং জীবনের অন্যান্য অনুভূতি প্রকাশ করে। নজরুল একমাত্র সংগীত স্রষ্টা যিনি বিভিন্ন বিদেশী শব্দ এবং সুর সমন্বয় করে আমাদের বাংলা গানকে করেছেন সম্মৃদ্ধ। বিভিন্ন রাগ-রাগিণী ও সুর তালের ব্যবহারে আধুনিক বাংলা গানকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন, তাই হাজার বছরের বাংলা গানের ইতিহাসে তিনি এক আসামান্য স্রষ্টা। তাঁর গান একদিকে যেমন মধ্যযুগীয় বাংলার কীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত বা ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীতকে বিষয় ও সুরের দিক থেকে অবলম্বন করেছে, অপরদিকে তেমনি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীত ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুম্রি, টপ্পা ও গজলকে আঙ্গিক ও সুরের ভিত্তি করেছে। সর্বোপরি প্রেম ও প্রকৃতিকে অবলম্বন করে নজরুলসঙ্গীত হয়ে উঠেছে আধুনিক বাংলা গানের এক অমূল্য সম্পদ।''
পারস্যের প্রেম সঙ্গীত রূপায়নের জন্যই গজলের জন্ম। গজলের দুটি অংশ –
১) অস্থায়ী এবং ২) অন্তরা। অস্থায়ী অংশ সুর ও তাল সহযোগে গাওয়া হয়, অন্তরা তাল ছাড়া, এই অংশকে বলা হয় – শের বা শেয়র। গজল গানে নজরুল নানারকম রাগ রাগিনী এনেছেন। মূল কাঠামো ঠিক রেখে তিনি – ঠুংরী ও দাদরার আঙ্গিকে বেশ কিছু গজল রচনা করেছেন। এরকম কয়েকটি গান – “উচাটন মন ঘরে রয়না”, “আধো আধো বোল লাজে”।
আবার বিভিন্ন রাগের সংমিশ্রনে নতুন ধারার গজল সৃষ্টিতে তিনি অদ্বিতীয়।
বাগেশ্রী এবং পিলু রাগের মিশ্রনে তিনি সৃষ্টি করলেন একটি বহুল প্রচলিত অনবদ্য গজল। কবি গাইলেন ‘ ----
ভুলি কেমনে আজো যে মনে
বেদনা-সনে রহিল আঁকা।
আজ সজনী দিন রজনী
সে বিনে গনি সকলি ফাঁকা॥
এই গানে কবি তার প্রিয়জনের দ্বারা প্রাপ্ত বেদনার আঘাত কে ভুলতে না পারার হতাশা প্রকাশ করেছেন।তাঁর প্রিয়া একদিন যে হৃদয়ে 'চুরি করেছিল। সে প্রিয়া ই আজ তার হৃদয় কে ছুড়ি দিয়ে খন্ড খন্ড করছে।তিনি বলছেন যে বেদনা যত গভীরই হোক না কেন, তা আজও তার হৃদয়ে একইভাবে রয়ে গেছে। স্মৃতি কবিকে ভুলতে দিচ্ছে না, তার থেকে কিছুতেই মুক্তি নেই।তার হৃদয়ে একইভাবে ক্ষত রয়ে গেছে। ভুলতে চাইলেও স্মৃতির থেকে কিছুতেই কবির মুক্তি নেই।
“পিলু রাগে মন স্পর্শ করা অপূর্ব আর একটি বিখ্যাত গজল ---
চেয়োনা সুনয়না এই নয়ন পানে
চেওনা এই নয়ন পানে
জানিতে নাই কো বাকি
সই ও আঁখি কি যাদু জানে চেওনা সু নয়না আর চেও না---
দুটি বিপরীতমূখী রাগ এই গানে একাত্ম হয়ে গেছে।কবি সৃষ্টি করলেন এক অসাধারণ সংগীত ---
আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়।
মোছ আঁখি, দুয়ার খোলো, দাও বিদায়॥
ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে
ঝরে ধূলায় ভোর বেলাতে
আমায় তারা ডাকে সাথে − আয় রে আয়।
সজল করুণ নয়ন তোলো, দাও বিদায়॥
প্রেম পর্যায়ের এই গানটি । কোনো এক শুভক্ষণে প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরের সাথে প্রেমময় মধুর সময় মিলনের প্রহর শেষে এসেছে বিদায়ের বেলা। এখন প্রেমিক এই বিচ্ছেদ-বেদনার অশ্রু মুছে ফেলে প্রেমিকার কাছে বিদায় প্রার্থনা করছে। প্রেয়সীকে যেন সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, চিরকালের জন্য এই মিলন স্থায়ী না হলেও দুঃখ করার কিছু নেই। বরং এর ভেতর দিয়ে যে মধুর স্মৃতির জন্ম হবে, তা না হয় চোখের জলের ভিতর দিয়েই লেখা রইবে। বর্ষার মিলনাকাঙ্ক্ষায় কেকা যেমন, আহ্বান বুকে নিয়ে বসন্ত অতিবাহিত করে। তেমনি প্রেমিকাকে বসন্তের মিলনের স্বপ্নকে দুরাগত ভেবে যেন ভুলে থাকে।
কবির রচিত অসামান্য আর একটি গজল-- ”পাষানের ভাঙলে ঘুম /“কে তুমি সোনার ছোঁয়ায় /গলিয়া সুরের তুষার গীত-নির্ঝর ব'য়ে যায়॥" ভীমপলশ্রী রাগে ,তাল দাদরায় এই গজল গানটি কবি স্বকণ্ঠেই গেয়েছিলেন যার জনপ্রিয়তা অপ্রতিরোধ্য ছিল।
গানটিতে বোঝানো হয়েছে যে, একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা "সোনার ছোঁয়া" আসার ফলে কঠিন, পাথরের মতো মন থেকেও ঘুম বা জড়তা ভেঙে যায় এবং তার ভেতর থেকে সুমধুর সঙ্গীত ও স্রোতের মতো অনুভূতি প্রবাহিত হতে শুরু করে। নজরুলের গজলের কয়েকটি বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয়। যেমন ,ক্ষুদ্র গীত যা সুরের চেয়ে কথার ওপর যেন বেশি জোর দিয়েছেন।
অথবা আমরা পেলাম ভৈরবী রাগে '‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে’ ./
মিশ্র বেহাগ-খাম্বাজ রাগে ‘কেন কাঁদে এ পরাণ’/
কি বেদনায় কারে কহি।
সদা কাঁপে ভীরু হিয়া রহি’ রহি’।।
সে থাকে নীল নভে আমি নয়ন-জল-সায়রে---
আরবী, ফার্সী শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ ছাড়াও বিদেশী শব্দগুলো কে বাংলা ভাষায় সহজ ভাবে ব্যবহার করে এমনি অজস্র গানের সুর সৃষ্টিতে নজরুল মহান স্রষ্টা হয়ে রইলেন।
এককথায় বাংলা সঙ্গীতে নজরুলের গজল একটি বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আগে বিত্তশালী এবং মুটে মজুরের গানের যে সীমারেখা ছিল – নজরুলের গজল যেন একটি যাদুকাঠিতে সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। “বাগিচায় বুলবুলি তুই” বা “কে বিদেশী, মন উদাসী” গজল গুলি জাত বেজাতের সীমা লঙ্ঘন করল। তাঁরই একটি গানের দৃষ্টান্ত – “পাষানের ভাঙালে ঘুম, কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়? ” ।
১৯২৮ সালে প্রকাশিত "বুলবুল" নজরুলগীতি সংকলনে তাঁর গজলগুলো স্থান পেয়েছে।
তার গজলে আছে ইরানি কাব্যসুষমার লালিত্য ও ভারতীয় সংগীতের অপূর্ব সুর। নজরুলের গজল তাই সৃষ্টি রসে অতুলনীয়। তার গজলে অবশ্য ইরানি মহাকবি হাফিজের প্রভাব লক্ষণীয়। সেই সঙ্গে ওমর খৈয়ামেরও।
এতদিন বিখ্যাত গজল কবি মীর্জা গালিব, জওক, মীল, আরজুসম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান গজল গানের সুরে সুরলোক মুখরিত করে রেখেছিলেন। এবার বাংলা গজলের ভুবন মাতালেন নজরুল । যদিও বাংলা গজল রচনার পথিকৃৎ ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন, যিনি লক্ষ্ণৌতে থাকার সময় এই ধারার সঙ্গে পরিচিত হন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা গানে গজল শৈলী যুক্ত করেছেন। তিনি প্রেমের (পার্থিব ও অপার্থিব) এবং আধ্যাত্মিক বিষয়কে কেন্দ্র করে বহু গজল রচনা করেছেন। তাঁর গজলগুলো বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দিক উন্মোচন করেছে, যেখানে তিনি পারস্যের প্রেমের কবিতার প্রভাবকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।"
ক্রমশঃ
0 Comments