জ্বলদর্চি

এই যে আলোর আকুলতা-১(উৎসব ১৪২৮)আবীর ভট্টাচার্য

এই যে আলোর আকুলতা...
আবীর ভট্টাচার্য 

প্রস্তাবনা

জল,জঙ্গল,মাটি... মানুষের চিরায়ত আশ্রয়। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই।  একে ঘিরেই তার আনন্দযাপন, ঘরকন্না খেলা। একদল শহুরে মানুষ কুমারী-প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কিভাবে সম্পৃক্ত হয়, বিনির্মিত হয়, আপনার অন্তরতম সত্ত্বায় জাগরিত হয়, লোকায়ত দেবদেবী লোকোত্তর মহিমায় সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে কিভাবে জড়িয়ে থাকে, প্রান্তিক মানুষেরা শত সমস্যার মধ্যেও আপন জীবনছন্দ কিভাবে কিভাবে অবিকৃত রাখে, তার কথকতা লিখিত এই আখ্যানে। উপন্যাস যদি নর-নারীর সম্পর্কের জলছবি হয়,  তবে এ শুধুই উপন্যাস নয়, আখ‍্যান-লেখ জীবনকথা; সংস্কৃতি, মানুষ ও সমাজের প্রতি নিবিড় আসক্তিময় ভালোবাসার এবং উত্তরণের জয়গান। প্রকৃতি, লোককথা, ইতিহাসও এখানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, কখনও নায়ক, কখনও নায়িকা, কখনও বা এক অঙ্গে অর্ধনারীশ্বররূপে যার সুপ্রকাশ। 

সবশেষে বলার কথা এই যে, লেখনীর অসঙ্গতির দায় আমার একারই, আর কিছু ভালো লেগে থাকলে, সে কৃতিত্ব আমার প্রিয়জনেদের, তাদের শুভেচ্ছা ও সাহসদান আমার পাথেয়। তথ্য ঋণে সমৃদ্ধ হয়েছি শ্রদ্ধেয় মধুপ দে দাদার কাছে, তাঁর 'ঝাড়গ্রাম, ইতিহাস ও সংস্কৃতি'-নামের বইটি; আর নামকরন সহ প্রতিটি অক্ষরে ঋণী জীবনদেবতার কাছে…
'আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব'
নমস্কার।


প্রথম অধ‍্যায়

বর্ষা শেষ  হয়ে এলো। এই সময়টা বড্ডো ভালো লাগে অরনির। চারপাশের গাছপালায় বৃষ্টি-ধৌত উজ্জ্বল শ্যামলতা,মেঘভারমুক্ত নির্মল আকাশ সেই ছোট্ট থেকেই বড়ো প্রিয়। ছেলেবেলা কেটেছে বেলপাহাড়ির এক গ্রামে, বনের পাশেই তাদের গ্রাম। উচ্চাবচ তরঙ্গায়িত লালমাটি, বুনোহাতির বছরভর আনাগোনা, নাম না জানা অসংখ্য পাখ-পাখালির সখ্য, চারিদিক ঘেরা মাটির বাড়িতে কাকা-জেঠু-বাবা মিলে মস্ত সংসার; একধারে পারিবারিক মন্দির,পাশে গোয়াল... এই ছিলো তাঁদের 'বাকুল'। 

প্রতিদিন সকাল হোত ঠাকুমার ডাকে, সন্ধ্যা নামতো মা-কাকীমার শঙ্খধ্বনিতে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা গ্রামের স্কুলেই, খুব বেশীক্ষণনা পড়লেও, পড়তে ভালো লাগতো তাঁর; স্নেহধন্য ছিলেন ইস্কুলের মাষ্টার দিদিমনিদের, রেজাল্ট কখনও খারাপ হয়নি। তারপরে, উচ্চমাধ্যমিক শেষে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র। আর ফিরে তাকাতে হয়নি পিছনে; পড়াশেষে আকর্ষণীয় চাকরী, একাধিকবার বিদেশভ্রমণ; সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী রুপা, ফুটফুটে সন্তান জোজো, নগরীর অভিজাত এলাকায় ডুপ্লে-ফ্ল্যাট, বিদেশী গাড়ী; জাগতিক কোনকিছুই অধরা নেই মিঃ.অরণির। ফ্ল্যাটটি যে আবাসনে, সেখানে তাঁরা ছাড়াও সপরিবারে থাকেন তাঁর আরও দুই বন্ধু, কর্মসুত্রে আলাপ হলেও এখন সম্পর্ক প্রায় পারিবারিক: অরূপ-দোলা ও তাদের কন্যা রিমলী, এবং বিমল-অরূন্ধতী,ওনারা নিঃসন্তান। রুপা ও দোলা চাকরী-বাকরীর চক্করে না গিয়ে সুখী গৃহিনী; অরূন্ধতী স্হানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মোটামুটি, এই সব নিয়ে বেশ ছন্দে চলেছে তাঁদের জীবন। ছেলেমেয়েরা ছোট, নিজেদের কাজের সুবিধামতন সপ্তাহান্তে একবার পার্টি, মাসে একবার কাছেপিঠে বেড়ানো, বছরে একবার দেশ বা বিদেশে ভ্রমণ;... আবাসনের অনেকেই ঠাট্টাচ্ছলে অষ্টবসু বলেই ডাকেন তাঁদের।

সবকিছুই চলছিলো ঠিকঠাক, এই করোনা ভাইরাস এসেই সব যেন লন্ডভন্ড করে দিলো। কতো সখ ছিলো, এবার পুজোয় সবাই মিলে আন্দামান যাবেন, বিয়ের পরপরই গিয়েছিলেন, খুব আনন্দ হয়েছিলো, মনে আছে। 
তা না; এক বিপদজনক মারণ অসুখে জনজীবন আক্রান্ত, বিপর্যস্ত। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ, তাঁদের সব কাজকর্ম বাড়িতে বসেই, গৃহসহায়িকা নেই, গৃহিণী বাকি কাজকর্ম সামলিয়ে ভাতে-ভাতটুকু উপাদেয় করার চেষ্টায় দেদার ঘি ভাজাভুজি আর আচার-জেলীর উপরে নির্ভর করছে, ফলস্বরূপ মেদ বৃদ্ধি; মেজাজ খিটখিটে, খাওয়া-ঘুমের সময়-অসময় নেই, জিমে যাওয়ার উপায় বা সুযোগ নেই, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই; সে-অর্থে এক বিশ্রী অবস্থা। ঐ যা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে টুকটাক সৌজন্য চালাচালি।
       কয়েকদিন ধরেই একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সবার, বাইরে কোথাও না হোক, একবার যদি কারুর বাড়িতে যথাসাধ্য নিরাপত্তা নিয়ে দেখাসাক্ষাৎ করা যায়; এই মানসিক চাপ হয়তো একটু কমানো যায়। 
কিন্তু কোন এক অজানা আশঙ্কায় কেউ মুখ ফুটে সেকথা প্রকাশ করছেন না। শেষে প্রস্তাবটা দিয়েই ফেললো বিমল,
-আগামীকাল সন্ধ্যায় আয় না সবাই আবার আগের মতো, একসঙ্গে জুটি?
মহিলাদের একটু দ্বিধা ছিলো, সঙ্গতকারনেই; বিশেষতঃ রূপা ও দোলার; তবে অরূন্ধতী দায়িত্ব নিয়ে বললেন,
-জমায়েতটা আমাদের বাড়িতে হোক।আমি সব আগেই স্যানিটাইজ করে রাখবো। তবে, আমার ইচ্ছে, শুধু দেখা আর আড্ডা নয়, দুপুরবেলা আসুন, নিজে রান্না করে খাওয়াবো সবাইকে।
   
 যেহেতু এখন কারো বাড়িতেই বাইরের মানুষের প্রবেশ নিষেধ,আবাসনে নিয়ম করে সপ্তাহে একদিন স্যানিটাইজ করা হয়, দ্বিধা ঝেড়ে সবাই রাজি, বাচ্চাদের তো আনন্দ লাগামছাড়া, যেন পাশের বাড়ি নয়, যাওয়া হচ্ছে  বিদেশভ্রমণে।
          
     কথামতোই, পরেরদিন ওনারা সবাই একটু আগে-আগেই পৌঁছলেন বন্ধুর ফ্ল্যাটে, ওদের ফ্ল্যাটটিও ডুপ্লে, তবে ছোট্ট খোলা বারান্দায় কয়েকটি গাছ, একটি ছোট্ট দোলনা ফ্ল্যাটটিকে বাড়ির লালিত্য দিয়েছে। বাচ্চারা তো এসেই একছুটে সেখানে, ওদের খুব প্রিয় জায়গা ওটি। ওদের মুহুর্মুহু ডাকে খানিকক্ষণ পরে অরণি পৌঁছলেন, এবারের নতুন সংযোজন কার্ডবোর্ড-নাইলন দড়ি দিয়ে কয়েকটি হাতে বানানো পাখির দোলনা, পাখির জন্য রাখা খাবার এবং জলের বাটি। লকডাউনের দৌলতে গাছগুলিও পর্যাপ্ত যত্ন পেয়ে নবপত্রপুষ্পে পল্লবিত। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিলেন, সম্বিত ফিরলো অরূন্ধতীর ডাকে,
-আপনার চা।
উজ্জ্বল সোনালী দার্জিলিং চায়ের সুগন্ধ-আকুল মন অজান্তেই মুগ্ধচোখে তাকালে অতিপরিচিতার দিকে,

-এই গুণটির কথা তো জানা ছিলো না!

সলজ্জে মুখ নীচু, কোন পুরুষ, সে তিনি প্রিয়-অপ্রিয় যাই হোন না কেন, আন্তরিকভাবে তখন কোন নারীর শিল্পীসত্ত্বায় আবিষ্ট হন, প্রৌঢ়ামুখেও কুমারী আলো জ্বলে!
 
-একাই তো থাকি,উনি সারাদিন কাজে ব্যস্ত, আমার এখন স্কুলে ছুটি। তাই দিন কাটে এসব নিয়েই..

ইতিমধ্যে বাকিরাও এসে পড়েছে ছেলেমেয়েদের ডাকাডাকিতে, সবাইকার উচ্ছসিত প্রশংসায় দুজনের এই নিভৃত মুহূর্তটি হারিয়ে গেল হাটের মাঝে।

বেশ খানিকটা প্রাণখোলা গল্প-হাসাহাসির পরে এলো খাওয়া-দাওয়ার পালা। বেশী তেমন কিছুই নয়, অরূন্ধতীর নিজের হাতে বানানো গয়নাবড়ি ভাজা, হালকা ঘি-জিরে-ফোড়ন দেওয়া লাউ-চিংড়ি, গরমমশলার আদরে জারিত খাসিমাংসের লাল টুকটুকে ঝোল,মাছের ডিম মেশানো কচি আমড়ার চাটনী। 
একেবারেই ঘরোয়া রান্না, কিন্তু যেন মায়ের হাতের আদর লেগে আছে তাতে।
 আগেও অনেকবার খেয়েছেন; কন্টিনেন্টাল ডিশগুলির সঙ্গে সঙ্গে একেবারেই খাস কলকাতার মেয়ে হয়েও এইসব দেশোয়ালী রান্নায় তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। রান্না করতে, খাওয়াতে তিনি ভালোবাসেন, ঘরোয়া পার্টির রান্না তিনি সবসময়েই নিজেই করেন, তবে আজকের স্বাদটুকু সবাই যেন চেটেপুটে নিতে চাইলো।
        
           খাওয়া-দাওয়ার পরে আবার বেশ খানিকক্ষণ গল্প। অন্যদিন দিবানিদ্রায় আছন্ন থাকেন সবাই,আজ যেন ফিরে গেলেন যে যার শৈশবে; সবার অনুরোধে অরণি শুরু করলেন তাঁর মাতৃভূমির গল্প; বাচ্চারা তো বটেই,শহুরে মানুষেরাও প্রকৃতির মদির রহস্যময় এইসব লোকায়তকথা শুনতে বেশ ভালোবাসেন।

  হঠাৎ অরূপ-দোলা যৌথভাবে বলে উঠলো,
-এবার পুজোয় যদি আমরা ওখানে বেড়াতে যাই!
-না মানে, ওখানে তো দূষণ তেমন নেই,তাই বলছিলাম আর কি!...

  সবাই উচ্চ-স্বরে হেসে উঠলো। বাড়ি থেকে দুপা দূরের বন্ধুর বাড়ি আসতে দু-ঘন্টা আগেও যাদের ছিলো এত দ্বিধা, খানিক প্রিয়সঙ্গ তাদের কতখানি স্বাভাবিক করে তুলেছে! সত্যিই মানুষ সামাজিক জীব, মানুষের সঙ্গ ছাড়া সে ভালো থাকে কি!

তাই মজার কথা এই যে, হঠাৎ করে তোলা কথাটি কিন্তু সবার কাছেই খুব গ্রহণযোগ্য মনে হো'ল; খানিকক্ষণের মধ্যেই সিরিয়াস আলোচনা শুরু হয়ে গেল এই ব্যপারে, বাচ্চা দুজন তো ওখানের জঙ্গলে বরফ পড়ে কিনা,আঙ্কোরভাটের মতো পুরনো মন্দির আছে কিনা, ট্রেকিং করা যাবে কিনা,এসব আজগুবি প্রশ্নে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো।

 জোজো এই সবে নিজস্ব ল্যাপটপ পেয়েছে, সে বিজ্ঞের মতো বলে উঠলো,

-চাপ নিও না, আমি রাতে সার্চ করে সব ফীডব্যাক দিয়ে দেব।

  বেচারা রিমলী এখনও একটু ছোট, মায়ের মোবাইল বা ল্যাপটপেই ওকে অনলাইনে ক্লাশ করতে হয়, গেম খেলতে হয়। ও অসহায়ভাবে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। দেখে বড্ডো মায়া হলো অরণির, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-গুগুল সার্চ করার মতো কোনো বিষয়ই নয় এটা; আঙ্কোরভাট নয়, সুইজারল্যান্ড নয়, এমনকি আরাকুভ্যালিও নয়, তবে ওখানে বরফের চাইতেও স্নিগ্ধ শিশিরপাত হয়,গাছে গাছে অসংখ্য পাখি ডাকে,গল্পে পড়া অপু-দুর্গার মতো বেশভূষাহীন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারা গ্রাম দৌড়ে বেড়ায়, রাতে লক্ষ লক্ষ জোনাকি-আলোয় তারা রূপকথার গল্প শোনে।

-আহা!

  তিনি এতক্ষণ লক্ষ্য করেননি,সবাই যেন মোহাবিষ্ট হয়ে তাঁর কথা শুনছিলো, লৌকিক সাফল্য, প্রতিষ্ঠার অতলেও সবারই হয়তো মনে মনে এমন বীতশোক জীবনের স্বপ্ন থাকে! এই স্বপ্নের আকুলতাই হয়তো তার মনে নতুন নতুন সৃষ্টির প্রেরণা-আঁচল বিছিয়ে রাখে,আমরা জানতেও পারিনা...
 
এদিকে, দিন শেষ হয়ে এলো,সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া অভ্যস্হ ব্যস্ততার ডাকে; তবু দিনটি যেন অনেক দিন পরে শেষ হলো এক স্বাভাবিক জীবনের স্মৃতি নিয়ে, নতুন সুস্থ জীবনের স্বপ্ন নিয়ে। 

  তবে, ফেরার আগে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো,সব খবরাখবর নেওয়া হোক, এবার কিন্তু পুজোর ছুটির ডেষ্টিনেশ্যন,বেলপাহাড়ি। এই প্রথমবার ফ্যামিলি-ট্যূর-প্রোগ্রাম-মিটিং এতো কম সময়ে, অবিতর্কিতভাবে শেষ হলো; নাহলে তো অন্যান্যবার ছয়জনের মতবিরোধ, মতবিনিময় চলতে থাকে বেশ কয়েকদিন ধরে, কেউ দেশ, কেউ বিদেশ, কেউ সমুদ্র, কেউ পাহাড়...যা সব ক্ষেত্রেই হয় আর কি!
এও কি লক্-ডাউনের জের!!
                                (আগামীকাল)
চিত্র- লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 



Post a Comment

5 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি স্রোতস্বিনী সুস্মিতা

      Delete
  2. সেই শব্দের জাদু আর অদ্ভুত ছন্দময়তায় এগিয়ে চলছে নিটোল গল্প। আগামী পর্বের অপেক্ষায়।

    ReplyDelete
  3. সুন্দর শুরুয়াৎ..👌

    ReplyDelete