জ্বলদর্চি

রাজকুমার পণ্ডা (কবি, সম্পাদক, সাংবাদিক, কাঁথি)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬০
রাজকুমার পণ্ডা (কবি, সম্পাদক, সাংবাদিক, কাঁথি) 

ভাস্করব্রত পতি

এই বয়সেও ছুটে বেড়াচ্ছেন পত্রিকা নিয়ে। জেলার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। সম্পাদিত পত্রিকা 'নোনাচাতর' ও নানা বইপত্র নিয়ে প্রতিটি বইমেলা, লিটল ম্যাগাজিন মেলায় হাজির তিনি। এই মোবাইল সর্ব্বস্ব যুগে পত্রিকা ও বইয়ের ক্রেতা খুঁজতে তাঁর ত্যাগ এবং তিতিক্ষা সত্যিই নজরকাড়া। 

পত্রিকা সম্পাদক রাজকুমার পণ্ডা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালে খেজুরী ১ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম কামারদায়। মাত্র দু বছর বয়সে প্রয়াত হন বাবা হরিহর পণ্ডা। মা সরোজিনী পণ্ডার স্নেহের আঁচলেই কষ্টেসৃষ্টে মানুষ হওয়া এবং বড় হওয়া। বাবার প্রয়াণে পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। তখন মামার বাড়ি পটাশপুরের মঙ্গলামাড়ো এলাকার বড়হাঠ গ্রামে দাদু দিদারা নিয়ে চলে আসে তাঁদের। রাজকুমারের ছেলেবেলা কাটে মামা বাড়িতে। যে মামাবাড়ি তাঁর সাহিত্যচর্চার বীজ বপন করে দিয়েছিল।

দাদু গোপাল উত্থাসনী ছিলেন সংস্কৃতিবান মানুষ। তিনি নিজে গান লিখে সুর দিয়ে গান গাইতেন। দাদুর পাশে থেকে থেকে তৈরি হল প্রাথমিক ধারণা। এদিকে মামা দেবনারায়ণ উত্থাসিনির কিনে আনা বিভিন্ন রচনাবলী পড়তেন পড়াশোনার ফাঁকে। একটা পৃথক আবহ তৈরি হয়ে যায় মামাবাড়ির ঘেরাটোপে। ফলে তখন থেকেই ছোট্টো রাজকুমারের মগজে লেখালেখির আঁকিবুকি ভূত ঢুকে যায় বলা চলে। 

মঙ্গলামাড়োয় মামার বাড়ি থেকে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করে এসে প্রি ইউ তে ভর্তি হলেন পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে অপারগ। তারপর কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজে ভর্তি হলেন। এখানে কলেজে পড়ার সময় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় কাঁথি থেকে প্রকাশিত 'সাপ্তাহিক নীহার' পত্রিকাতে। মামাবাড়িতে থাকাকালীন যে সাহিত্যরসের বীজ বপন হয়েছিল, সেটাই প্রাথমিকভাবে অঙ্কুরোদগম হল কাঁথিতে এসে 'নীহার' পত্রিকার হাত ধরে। 
নোনাচাতর পত্রিকা তুলে দিচ্ছেন রাজকুমার পণ্ডা

ব্যাস, দম পেয়ে গেলেন লেখালেখিতে। নতুন উদ্যমে শুরু করলেন কালি কলমের কারিকুরি। ১৯৬৭ সালে 'সংক্রান্তি' নামে একটি ছোট পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করলেন। কলেজে পড়ার সময় লেখালেখির সূত্রে জেলা এবং জেলার বাইরের বহু কবি লেখকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও আলাপ হয়। তাঁর সম্পাদিত 'সংক্রান্তি' পত্রিকায় সেসময় ষাট দশকের বহু কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। 

কলেজে পড়ার সময় কবিতা লেখার পাশাপাশি গল্প লেখার আগ্রহ বাড়ে তাঁর। নামে ছোট পত্রিকা হলেও 'সংক্রান্তি'র ব্যাপ্তি ছিল সুদূরপ্রসারী। এই সুবাদে মেদিনীপুর সহ কলকাতার অনেক কবি লেখকের সঙ্গে আলাপ হয়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হতে থাকে নিয়মিত। 
লিটল ম্যাগাজিন স্টলে বইপত্র নিয়ে কবি সম্পাদক রাজকুমার পণ্ডা

সাহিত্যচর্চাকে সঙ্গী করে পড়াশোনাও চালিয়ে গিয়েছেন নিজের মতো করে। ১৯৭০ সালে বিএ এবং ১৯৭৪ সালে বি এড পাশ করেন। কিন্তু এরপরে স্কুলে চাকরি করার কোনও ইচ্ছা ছিলনা। তাই নদীয়ার একটি স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে সুযোগ পেয়েও যাননি। আসলে তখন মাথায় সাংবাদিকতা করার খেঁড়ো ভূত যেন তাড়িয়ে বেড়াত। এই পেশাটাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন সর্বাগ্রে। 

১৯৭৬-৭৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার 'ভূমিলক্ষ্মী'র পাতায় নিয়েমিত ফিচার লিখতে শুরু করেন। যা ছিল তাঁর স্বপ্নপূরণের একটি ধাপ। মেদিনীপুরের নানা বিষয় তুলে ধরতেন সেসময়। তখন এতো প্রযুক্তির সুযোগ সুবিধা ছিলনা। তবুও তিনি পায়ে হেঁটেই খবর এবং তথ্য সংগ্রহ করতেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি সেসময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা 'পরিবর্তন' এর সাথে যোগাযোগ ঘটে। এখানে তিনি প্রথম যে লেখাটি লিখেছেন তা ছিল 'হলদিয়া'কে নিয়ে। পাশে ছিলেন রতনতনু ঘাঁটি এবং বঙ্কিম ব্রহ্মচারী। 


সেই শুরু। এরপরে পরিবর্তনের পাতায় তাঁর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা 'ধনধান্যে' সহ কলকাতার নানা ছোট বড় পত্রিকাতেও তাঁর কলম সচল ছিল নিয়মিত। সেগুলির মধ্যে বর্তমান, দিনকাল, আলোকপাত উল্লেখযোগ্য। আরও অন্যান্য অনেক কাগজে লেখার পাশাপাশি 'যুগান্তর' পত্রিকার সাপ্তাহিক 'অমৃত' পত্রিকায় নিয়মিত গল্প প্রকাশিত হত। সেসময় এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। 

লেখালেখির কাজে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। যেখানে সুযোগ পেতেন, সেখানেই লিখতেন। আর বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে কাজ করতেন আয়ের জন্য। ফলে সেইসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক চিত্ত সিংহের 'সুজনী' নামে একটি প্রকাশনীতে কাজ করতে শুরু করেন। অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও নানা কাজে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন জনতা দলের বাংলায় প্রকাশিত 'যুগের ডাক' পত্রিকা দেখভালের দায়িত্ব নিতে হয় এজন্য। তখন  এ রাজ্যের সর্বত্র ভয়ঙ্কর বন্যায় কলকাতা সহ সারা রাজ্য ডুবে যায়। ভয়াবহ পরিস্থিতি হয় মেদিনীপুরের বুকেও। 


পরবর্তীকালে কাঁথি থেকে প্রকাশিত প্রথমে 'বেলাভূমি' এবং পরে নাম পরিবর্তন করে 'তীরভূমি' পত্রিকার সঙ্গে লেখালেখির জন্য যুক্ত হয়ে পড়েন। মেদিনীপুর শহর থেকে প্রকাশিত তাপস মাইতির সম্পাদনায় 'দৈনিক দেশকাল' পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কিছুদিন। আসলে এই পত্রিকা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তখন। হলদিয়া থেকে লক্ষণ শেঠের তত্বাবধানে প্রথমে 'বর্ণপরিচয়' এবং পরে 'আপনজন' পত্রিকাতে যুক্ত হয়েছিলেন লেখালেখির জন্য। সম্পাদনা করতেন জেলার বিশিষ্ট কবি, বিধায়িকা এবং মহিলা নেত্রী তমালিকা পণ্ডাশেঠ। তাঁর সাথে এখানেও যুক্ত ছিলেন রতনতনু ঘাঁটি।

অবশেষে ফিরে আসেন কাঁথিতে। ১৯৮৬-৮৭ সালে কলকাতার উইলিয়াম কেরি স্টাডি এন্ড রিসার্চ সেন্টারের উদ্যোগে মেদিনীপুরের মৎস্যজীবীদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। শুরু হল নতুন জীবন, নতুন লক্ষ্য, নতুন উদ্যোগ। একটা ভিন্ন ধারার আন্দোলনের সাথে ব্যাপৃত হয়ে উঠলেন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক রাজকুমার পণ্ডা। ১৯৯০ সালে গঠিত হয় কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতি। এই সমিতির প্রথমে ১২ টি মৎস্যখটি থাকলেও পরে ৫ টি ব্লকের আরও ৪২ টি মৎস্যখটি যুক্ত হয়। ১৯৯৪ সালে মৎস্যজীবীদের সর্বভারতীয় সংগঠন ন্যাশনাল ফিস ওয়ার্কার্স ফোরামের ইউনিয়নের সঙ্গে সংযোগ ঘটে তাঁর। ১৯৯৫ সালে দুই সংগঠনের যৌথ সংগ্রামে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ক্ষেত্রে  বিদেশী জাহাজের আনাগোনা বন্ধের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম মৎস্য বনধ পালিত হয় কাঁথিতে। নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। 

তিনি বুঝলেন, জেলার মৎস্যখটিগুলির উন্নয়ন সর্বাগ্রে দরকার। তাই এরপরেই মৎস্যখটিগুলির উন্নয়ন, সঞ্চয় ও ত্রাণ প্রকল্পের দাবীতে, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে, নদী সমুদ্রের দূষণ প্রতিরোধে 'জল বাঁচাও তট বাঁচাও' ডাক দিয়ে কখনও দীঘা - সোমেশ্বর নগর, কখনও হলদিয়া - দীঘা গনজাগরণ কর্মসূচী গ্রহণ ছিল তাঁর অন্যতম কর্মসূচি এবং উল্লেখযোগ্য কাজ। হরিপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতিবাদে নানা কর্মসূচী গ্রহণও ছিল তাঁর কাজের অন্যতম একটি দিক। 

২০০১ সালে মৎস্যজীবীদের খবরাখবর নিয়ে নিজেই প্রকাশনা শুরু করেন 'নোনাচাতর' পত্রিকা। এই পত্রিকার সম্পাদক করেন পুত্র শমীক পণ্ডাকে। দুই মেদিনীপুর ও দুই চব্বিশ পরগণার মৎস্যজীবীদের যাবতীয় খবরাখবর প্রকাশিত হয় এতে। শুধু মৎস্যজীবীদের জীবন যন্ত্রনা আর তাঁদের অভাব বঞ্চনার নির্যাস ফুটে ওঠে নোনাচাতরের পাতায়। প্রতিবছর পত্রিকার উৎসব সংখ্যাগুলিও প্রকাশিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়। যা পাঠকসমাজে বারবার সমাদৃত হয়েছে। এতে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন থিমের লেখা। মেলা, মন্দির মসজিদ, নারী, লোকসংস্কৃতি, নৌকা উৎসব, গঙ্গা আরাধনা, পঞ্চাশ বছরের কবিতা, মাছেদের সাতকাহন, শতবছরের অ্যালবাম, নদী সংস্কৃতি, মেদিনীপুরের শৈবতীর্থ ও গাজনের গান সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। বলতে গেলে, নানাভাবে মেদিনীপুরের গর্বের বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন নিজস্ব ক্ষমতার অলিন্দে থেকে। 
প্রকাশিত বই

তাঁর কাজের সীমাহীন ব্যপ্তি অবাক করার মতো। সারাজীবন লিখে গিয়েছেন আঁদালে কাঁদালে লুকিয়ে থাকা নানা মনিমুক্তো। নব্বই এর দশকে রাজকুমার পণ্ডার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে জনজাতি জীবন। প্রকাশিত হয়েছে 'বোধনে আছি বিসর্জনে আছি' নামে কবিতার বই। গল্পের বই 'সুন্দর অমলাকান্ত' তাঁর হাত ধরে প্রাণ পেয়েছে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'বাংলার মৎস্যজীবীদের জীবন কথা'। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'মেদিনীপুরের নদী সংস্কৃতি'। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষকে সামনে রেখে ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'ভারতের মুক্তি সংগ্রামে কবিতা গান' নামক বই। তাঁর হাতে গড়া 'নোনাচাতর' পত্রিকার 'নৌকা উৎসব' সংখ্যা পুরস্কৃত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ক্ষুদ্র পত্র পত্রিকা ও সংস্থা থেকে। 

ইতিমধ্যে গল্প লিখেছেন তিন শতাধিক। বিভিন্ন সংস্থা ও পত্র পত্রিকা থেকে পেয়েছেন নানা সম্মাননা। তিনি পেয়েছেন উপত্যকা সম্মান, কাঁথি প্রেস ক্লাব সম্মান, ডিস্ট্রিক্ট জার্নালিস্ট ক্লাব সম্মান, কাঁথি বইমেলা সম্মাননা, তমলুক বইমেলা সম্মাননা, উত্তাপ সাহিত্য সম্মান, বেনুকা সাহিত্য সম্মান, বর্ষিয়ান লেখক সম্মান, দীঘলপত্র সম্মান সহ আরও নানা সম্মাননা। সম্প্রতি ২০২৪ সালে জেলার বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী 'ডাঃ রাসবিহারী পাল' স্মারক সম্মান পেয়েছেন তিনি। 'নোনাচাতর' পত্রিকার পক্ষ থেকেও সমাজের বেশ কয়েকজনকে দেওয়া হয়েছে 'শিব সম্মান'। 

এখনও এই বয়সে লেখার সঙ্গে যুক্ত আছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'টি। চূড়ান্ত আর্থিক সমস্যা রয়েছে। সেসব থাকলেও পরোয়া করেননা। তবুও নিয়মিত 'নোনাচাতর' প্রকাশিত হচ্ছে। ছোটদের নিয়ে বই করতে চান। ২০২৫ সালে 'নোনাচাতর' পত্রিকার উদ্যোগে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। মৎস্যজীবীদের মুখপাত্র সাংবাদিক রাজকুমার পণ্ডা হাসিমুখে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান মৎস্যখটি থেকে লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে। বইমেলার মঞ্চ থেকে ছাপাখানার এঁদো ঘরে। তাঁর কাছে আজ উপকূলের ঝাউগাছ, নৌকা, লগি, জাল, মাছ, জোয়ার, ভাটা, খটিই লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। কোনওরকম বাহুল্য ছাড়াই নীরবে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন একা একা।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments