জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-৯/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত


চয়নের বাড়ির কাছে এসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না প্রভা। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। চারদিক লোকে লোকারণ্য। দরজা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ। থিকথিকে ভিড় উপচে ছড়িয়ে গেছে রাস্তায়। ধূপের ধোঁয়ায় বাতাস ভারি হয়ে গেছে। টাকাঅলা থেকে নিঃস্ব,কে নেই সেখানে ! ডাক্তার,উকিল,মাস্টার থেকে শুরু করে দূরের কোনও দোকানদার পর্যন্ত এসে হাজির। ভিড়টাকে সামাল দিতে তালুকদারবাবু হিমশিম খাচ্ছিলেন। শুধু তালুকদার একাই নন,চয়নের অনেকদিনের বন্ধু সব্যসাচী, তমোঘ্ন বাইরেটাকে কন্ট্রোল করছেন। কোনওরকমে ভেতরে ঢুকে দরজার চৌকাঠ ডিঙোতেই সারা শরীরটা কেঁপে গেল প্রভার। দেখলেন,সযত্নে শোয়ানো হয়েছে চয়নকে। নিথর দেহটাকে ঢাকা দেওয়া আছে সাদা কাপড়। কাপড়ের ওপর গাঁদা আর রজনীগন্ধার একাধিক মালা। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ঐশী বাবার পায়ের কাছে বসে আছে। চয়নের স্পন্দনহীন বুকের ওপর মাথা রেখে নির্বাক বৈশাখী স্তব্ধ,পাথরের মতো। বৈশাখীর পাশে ঋষভ। বাইশ বছরের ছেলেটার চোখ নিষ্পলক। কন্ঠ বাকরূদ্ধ। আশেপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই। রয়েছে পিনাক,পিনাক ও ঋষভের এক বন্ধু আয়ুষ্মান,পিনাকের মা অর্থাৎ মিসেস তালুকদার এবং আরও কয়েকজন। সবার মুখই থমথমে। চয়নের সংসারটা যে ভেসে গেল! মেয়ের লেখাপড়াটা এখনও শেষ হয়নি,সবে চাকরি পেেয়েছে ছেলে। এটা কি যাবার সময়? ঐশীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল বুল্টি। হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েটার মাথায় হাত রাখল। কী সান্ত্বনা দিতে পারবে সে? এ যন্ত্রণার কোনও সান্ত্বনা হয় কি? কান্নাজড়ানো স্বরে বুল্টি শুধু ফুঁপিয়ে উঠল ঐশীকে বুকে টেনে। শেষবার চয়নের সাথে বুল্টির দেখা হয় মাস দুই আড়াই আগে। শ্যামলের সাথে ও সেদিন দুপুরবেলা নিউটাউনে এক পৈতে বাড়ির অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল। রাস্তায় হঠাৎই দেখা। "জামাইকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে একবার যাস বুল্টি। বহুদিন যাসনি। মেেয়েটাও এখানে থাকেনা।ঋষভ চাকরি করে বাইরে। কাজের চাপে আমি সারাদিন বাড়ির বাইরে। অত বড় বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। কাকিমাকে মাঝেমধ্যে তো দু চারটা দিনের জন্য রেখে দিয়ে যেতে পারিস। তোর বউদিরও তাহলে দুটো কথা বলার সঙ্গী হয়। কাকিমাও তো বাড়িতে একা থাকে। ঘরে তালাচাবি দিয়ে দুটো দিন এখানে এসে থাকতে পারেনা?" দেশের অয়নদার মধ্যে এ আন্তরিকতা কখনও দেখতে পায়নি বুল্টি। ঐশী বুল্টিকে চেনে। হয়তো দেখা হয়েছে কম। ঐশীর মনে আছে,তাদের গৃহপ্রবেশের সময় এই পিসি এসেছিল। খুব ভাল মানুষ। আপন করতে জানে। সেবার মায়ের সাথে হাতে হাতে কত কাজ যে করেছিল। তখন ঐশী আরও ছোট। তবু মনে আছে। তারপরেও আর একবার বোধহয় দেখেছিল এই পিসিকে। বাবা একটা দামি কথা বলত মাঝে মাঝে। "কলকাতায় আমি দেশের গন্ধ পাই। এখানে আর কেউ না থাকুক,সুরেশকাকা আছে। কাকিমা আছে। বুল্টি আছে। জন্মভূমির শিকড়ে গেঁথে থাকা এই মানুষগুলো আমার বাবার আপন ভাই না হয়ে খুড়তুতো ভাইয়ের পরিবার হয়ে থাকতে পারে,তবু তো নাড়ীর টান! দেশের মানুষ! কত বড় আবেগ!" এ পিসির স্নেহ ঐশী যতটুকুই পেয়ে থাক,তবু যেন মনে হয় অনেক। অনেকখানি পাওয়া। আপন দুটো পিসিকে ও এখনও ভাল করে দেখেইনি। স্নেহ পাওয়া তো দূর। মাথায় মমতার হাত পেয়ে ঐশী কাঁদতে কাঁদতে বুল্টির বুকে আছড়ে পড়ল। 
     দু'তিনজন এসে আবার ঢুকল ভেতরে। নিথর চয়নের বুকের ওপর রজনীগন্ধার মালা দিল ওরা। তারপর বেরিয়ে গেল। ঋষভ যেখানটাতে বসে আছে,তার অদূরে দাঁড়িয়ে আছে সুখেন। খবর পাওয়ার সাথে সাথেই সুখেনের বাড়ি থেকে এসেছেন বৈশাখীর বৃদ্ধ বাবা,অর্থাৎঋষভের মামাদাদু। এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এসব দেখে। ভেতরে একটা রুমে এখন শুয়ে আছেন তিনি।
     প্রভা বৈশাখীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। "বউমা,দেশ থেকে এখনও কেউ আসেনি?" চয়নের ঐ পাথরের মতো শরীরটার দিকে তিনি তাকাতে পারছেন না। কেমন করে তাকাবেন? কোমরের ঘুনসি পর্যন্ত যাকে পরিয়ে দিয়েছেন বারবার ! এইটুকুনি চয়নকে সরসীবালার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছেন কতবার। কতবার যে শূন্যে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়েছেন! সব মনে পড়ছে আজ। চয়নের শিশুকালের দুষ্টুমি থেকে বড়কালের দায়িত্ব। বুল্টির বিয়েটা পর্যন্ত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছে ছেলেটা। শ্যামলের মতো ছেলেকে সহজে মেনে নিতে পারেননি সুরেশ। কলকাতায় দীর্ঘদিনের বাস। মেয়ের জন্য নানা লোকের কাছে কথাও পাড়ছিলেন তিনি। বুল্টির তর সইল না। নিজে বাছল শ্যামলকে। সেদিন সুরেশকে চয়নই বুঝিয়েছিল। "মেনে না নিয়েই বা লাভ কী! মেয়ে তোমার। ওকে তো আর অবজ্ঞা করতে পারো না। যা হোক কিছু তো একটা কাজ করে শ্যামল। বাবা মার কাছে হাত পাতা নেই। নিজের রোজগারেই সব। আজকাল ওটাই ক'জন করে? সব ঠিক হয়ে যাবে কাকা। তুমি বুল্টিকে মেনে নাও। সদগোপের ছেলে। অন্যায় তো কিছু নেই। আর বোকোনা বুল্টিকে।

 দ্যাখো,ও কাঁদছে।" একেবারে ছেলের মতো সেদিন কথা বলেছিল চয়ন। সুরেশ তাই মাঝেমাঝেই প্রভাকে বলতেন,"বুল্টিকে দেখার জন্য এ কলকাতা শহরে আমার ছেলে আছে। পেটে ধরলেই কি ছেলে হয় প্রভা? গিরিদার ছোট ছেলের মনটা যে এত ভাল,জানতাম না। আমি যখন থাকব না,জামাই ছেলে মেয়েকে নিয়ে তোমার দিব্যি কেটে যাবে। ভাই ভাইপোরা না দেখুক,চয়ন তো আছে!" সুরেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সেই ভূমিকারই যেন সম্পূর্ণতা টেনে দিয়ে গেছে চয়ন। সন্তানহারা হলেন প্রভা।
     কাকিমার দিকে সজল চোখে চেয়ে বৈশাখী বলল,"ওরা রাস্তায় আসছে। ফোন করেছিল।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments