জ্বলদর্চি

পাতি মানুষের পাঁচালি-৯/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাতি মানুষের পাঁচালি::৯
--------------------------------------
এক পুলিশের কথা
---------------------------
সাধারণত পরিবারের লােকেরা (স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে) তাদের পুলিশ বর,  বা বাবাকে অসৎ, ঘুষখাের বলে না। বলে উনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যাক্তি, মাটির মানুষ। তারক ব্যানার্জীর কৃতিত্ব হল এই যে তাকে সাধারণ মানুষও সৎ কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার বলে জানে। 'বলে' নয় অবশ্য, বলত। পঞ্চান্ন বছর বয়স পর্যন্ত। তার পর কিছু একটা ঘটেছিল। কী ঘটেছিল তা নিয়েই এই গল্প। তারকের চাকরি পাওয়ার আখ্যান বেশ চমকপ্রদ। বাবা হিরু চৌকিদারের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের  মাছিগ্রামে চৌকিদারি করত সে। তখন তার বয়স এগারাে কি বারাে। সেই বয়সেই রাত জেগে কাজ করা তার কাছে কোনাে ব্যাপারই ছিল না। বাবার সঙ্গে কতবার ছিঁচকে চোর ধরেছে সে।  যদিও বাবা ছিঁচকে চোর ধরতেন না, তাড়িয়ে দিতেন! বাবা বলতেন, তারা পেটের দায়ে সামান্য চুরি করতে আসে, কারও ক্ষতি করে না! কিন্তু থানার বড়বাবু রণেন সেনের বাড়ি ডাকাতি করতে আসা গদাধরকে দৌড়ে সে যেভাবে বামাল সমেত ধরে ফেলেছিল ষােলাে বছর বয়সে, তা ভাবতে এখনও তার নিজেরই রােমাঞ্চ হয়। সে যুগে দারােগার সুপারিশে সরাসরি চাকরি পাওয়া যেত তার অধীনস্থ থানায়। তারক ডাকাত ধরে ফেলার ফলে দারােগা রণেন সেন কর্ণসুবর্ণ থানায় তাকে ‘অফিস বয়’-এর চাকরি করে দিয়েছিলেন। পরে নিজ গুণে সে চাকরি পাকা হয়ে তারক কনেস্টবল হিসেবে  কাজ শুরু করেন তার থেকে তিন বছর বাদে। চাকরি পাকা হওয়াতে সাধারণ মানুষের সাধারণত খুব আনন্দ হয়, তারকের ক্ষেত্রে ওসব কিন্তু হয়নি। কেবল মনে আছে উনিশ বছর বয়সে তিনি পুরনাে বান্ধবী গিতাকে বিয়ে করে ফেলেছিলেন এবং তারকের যখন সাতাশ বছর বয়স তখন তাঁর চার ছেলে, এক মেয়ে সমেত বিরাট সংসার হয়ে গেছিল। লােকে বলে এ ছিল তাঁর চাকরি পাওয়ার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ।
এমনিতে তারকের বউ গিতা বেশ গােছানি ও সংসারি ছিলেন। সেকালে পুলিশের চাকরিতে মাইনে অত্যন্ত কম ছিল। পুলিশ তুমি যতই কর, মাইনে তােমার একশাে বারাে!—জাতীয়, আরকি! কিন্তু সেই স্বল্প আয়ােজনে ছেলেমেয়েদের মানুষ করে ছােটখাটো সাধে আহ্লাদ পূরণ করে সুখের সংসার গড়ে তুলতে পেরেছিলেন গিতা।  মাছিগ্রাম জায়গাটা অপরাধ এবং উত্তেজনাপ্রবণ । গ্রামবাসীরা সবাই জমিদারের বংশধর। এখন অর্থিক প্রাচুর্য নেই, কিন্তু সেই জমিদারি মেজাজটা এখনও রয়ে গেছে।
বংশানুক্রমে যাঁরা জমিদার ছিলেন তাঁদের বংশানুক্রমিক  প্রজারা এখনো দেবতাজ্ঞানে পুজো করে  তাঁদের, যদিও আজ  অনেকেক্ষেত্রেই রাজার থেকে প্রজা সচ্ছল বেশি । গ্রামে চোরডাকাত পড়ে না কোনােদিন। এর পিছনেও একটা গল্প আছে। এখন থেকে বিশ বছর আগে একবার দশজনের ডাকাতদল ছােড়া আর বন্দুক নিয়ে নানু মশাই-এর বাড়ি চড়াও হয়েছিল। তারপর আর ফিরে যায়নি কেউ-ই। হাঁসুয়া দিয়ে গর্বিত জমিদারবংশীয়রা প্রত্যেকের মাথা কেটে পুলিশ আসা পর্যন্ত মাঠের পাশে বড় বড় বাঁশের খুঁটি দিয়ে সেগুলি টাঙিয়ে রেখেছিল। এ গল্প এত আতঙ্ক ছড়িয়েছিল চোর ডাকাত মহলে যে, তারা ওদিক ঘেঁষাই বন্ধ করে দিয়েছিল ভয়ে। অসংখ্য গোষ্ঠিতে বিভক্ত মাছিগ্রামের জমিদারকুল প্রায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে নিজেদের মধ্যে বিবাদে লিপ্ত থাকত। এর থেকে খুনােখুনিও হয়ে যেত অনেক সময়। এসব ক্ষেত্রে ঠান্ডামাথায় উপরমহল পর্যন্ত না গিয়ে বাস্তব বুদ্ধির জোরে নিখুঁতভাবে বিবাদগুলাে মিটিয়ে দিতেন তারক। যার কারণে তিনি প্রিয়পাত্র ছিলেন সব মহলে। একবার কঠিন জ্বরে পড়েছিলেন তিনি। এক মাস প্রায় জ্বর ছাড়ে না। হাতে কানাকড়ি অর্থ নেই চিকিৎসার জন্য। তখন গ্রামের সব তথাকথিত চণ্ডাল মানুষ মিলে চাঁদা তুলে তাঁর চিকিৎসা করে তাঁকে সারিয়ে তুলেছিল। এ ব্যাপারে তারকের কৃজ্ঞতার অন্ত ছিল না।
সেবার এক আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের দল পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে মাছিগ্রাম থানার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। থানার বড়বাবু অনেক টাকার রফা করেছিলেন দলটার সঙ্গে—ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে। সে সময় তারক বেঁকে বসার কারণে বড়বাবুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এবং তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়ে দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হন। তাঁর চাকরি যায়নি সে যাত্রা, তবে তিন বছর সাসপেন্ডেড ছিলেন তিনি। তখন থেকেই তারক বড়বাবুর কুনজরে ছিলেন, এবং তিনি ছুতােনাতায় তারককে অপদস্থ করার চেষ্টা করতেন, কিন্তু জনরােষের ভয়ে এর বেশি কিছু করতে সাহস করতেন না তাঁর বিরুদ্ধে। তারকও ভয় পেতেন না কোনােকিছুকে। অন্যায় দেখলেই  তর্ক করে  যেতেন বড়বাবুর মুখের উপর। এরপর এক সময় বড়বাবু সুন্দরবনে ট্রান্সফার হয়ে যান। তারককে সটান তিনচার ধাপ এগিয়ে বড়বাবুর পদে উন্নীত করে দেওয়া হয় উপর মহলের সুনজরে থাকার কারণে।

বড়বাবু হয়েই তারক কতকগুলি বিষয় চালু করেছিলেন তাঁর নিজের এলাকাতে। প্রথমত সিনেমা হলে ব্ল্যাক একেবারে বন্ধ। ব্ল্যাকারদের গ্রামে গ্রামরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসাবে মােতায়েন করেছিলেন তিনি। পঞ্চায়েত ও সাধারণ মানুষের সহায়তায়  তাদের মাস মাইনের ব্যবস্থা হতাে। চুরি, গুণ্ডামি, ছ্যাঁচরামি করে যারা ধরা পড়ত তাদেরকে অত্যাচার মারধাের করা হতো না। কী কারণে তারা এসব কাজ করেছে, তাদের মানসিকতা কেমন এসব যাচাই করে সেই মােতাবেক তাদের কাউন্সেলিং করা হতো। প্রথমবার অপরাধ করে ধরা পড়লে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলেও পরবর্তী অপরাধ দেখলে কঠিন কেস  থেকে রেহাই পেত না সে। সকাল, বিকাল দুবেলা প্যারেড করতে হতো থানার সব কর্মীকে। ঘুমােতে যাওয়ার আগে গেস্টরুমে সবাই মিলে বসে আড্ডা মারত আর গােটাদিনের কাজের পর্যালােচনা হতো। বছরে একবার করে, সাধারণত কালিপুজোর সময় তিন রাত্রি যাত্রার আসর বসত কালিমণ্ডপ চত্তরে। পুরােটাই বড়ােবাবুর উদ্যোগে। দূরদুরান্ত থেকে মানুষ তা দেখতে আসত। গ্রীষ্মকালে স্থানীয় গ্রামগুলিকে নিয়ে বসত জমাটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আসর। ফাইনালে প্রধান অতিথি হিসাবে কলকাতার বড় ক্লাবের কোনাে নামী ফুটবলার আসতেন।

ব্যাক্তিগত জীবনে তারক ছিলেন খুব ধর্মভীরু, আস্তিক। ভােরবেলায় উঠে স্নান ও পুজো সেরে কাজে বেরােতেন তিনি। গােটা দিনে অন্তত একবার করে তাঁর এলাকার সব গ্রামগুলিতে চক্কর দিয়ে খবরাখবর নেওয়াটা বাধ্যতামূলক ছিল তাঁর কাছে।

সাংসারিক জীবন খুব সুখের ছিল তাঁর। একমাত্র মেয়ে লক্ষী সবার বড়। বাকি চারজন ছেলে কার্তিক, গনেশ, গৌর ও নিতাই। গৌর, নিতাই যমজ। প্রত্যেক বাবা-মায়ের খুব ন্যাওটা। পড়াশােনায় মােটামুটি ভালাে। সরল জীবন যাপন। চাহিদা নেই। সাধারণ প্রান্তিক মানুষেরা সমীহ করত তারককে এবং বড়রা স্নেহ। এসবের যােগ্যও ছিলেন তারক। গ্রামের মানুষের ভালােবাসার সুবাদে চাল, ডাল, তেল, নুন, সব্জি অথবা এসবের অভাব হতো না তাঁর। তাদের ভালােবাসার এ দান মাথা পেতে নিতেন তারক।
এর মধ্যে একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে তারকের জীবনে। এক গরমকালে কাঁঠাল, দুধ আর রুটি এক সঙ্গে মাখিয়ে খেয়ে কলেরা হয়ে মারা গেলেন তারকের বউ গিতা। কই মাছের জান ছিল তাঁর। মরার আগে অনেক সময় দিয়েছিলেন। প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে জেলা হাসপাতাল, সেখান থেকে নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ এসব করেও কিছু হল না।
সময় হয়ে গেছিল বােধহয়। সে সময় কলকাতায় দু একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ রােগের খুব ভালাে চিকিৎসা ছিল । কিন্তু তার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব ছিল না তারকের পক্ষে। মাননীয় মানুষের কাছে হাত পাততে পারেননি লজ্জায়। তবে এ ব্যাপারটা নিয়ে গ্রামের মানুষদের তীব্র অপরাধবােধ ও তাঁর গভীর অনুশােচনা হয়েছিল। কিন্তু তখন তাে আর করার নেই কিছু!
গিতা মারা যান যখন, তখন লক্ষী ক্লাস টেনে পড়ে। বাকিরা আরো ছােট। এতজন নাবালক, নাবালিকাকে নিয়ে নাভিশ্বাস তারকের। একদিকে এক হাতে তাদের মানুষ করা, অন্যদিকে সরকারি কাজের চাপ। এ সময় বড় মেয়ে লক্ষ্মী যদি নিপুন হাতে সংসারের হাল ধরত তাহলে যে কী হতো তা ঈশ্বরই জানেন।

এ ঘটনার মাস তিনেক পর থেকে ধার্মিক তারক কেমন যেন পাল্টে যেতে শুরু করলেন। ইতিহাসে পড়েছি চন্ডাশােকে ধর্মাশােকে পরিণত হয়েছিলেন অনুশােচনায়, অথচ স্ত্রীর মৃত্যুর পর সৎ তারক আস্তে আস্তে অসৎ হতে শুরু করলেন।

প্রথম অনিয়মের শুরু হল ট্রাফিক নিয়মভাঙা গাড়িগুলির ক্ষেত্র দিয়ে। এগুলিতে কেস দিয়ে যে পয়সাকড়ি আদায় হতাে তা সরকারি ঘরে জমা পড়ত এতদিন। হঠাৎ করে সরকারের সে আয় কমতে শুরু করায় ওপর থেকে গােপনে খবর নিয়ে দেখা গেল কম টাকাপয়সার বিনিময়ে ডিল করে তারক তাদের চুপচাপ ছেড়ে দিচ্ছেন। প্রথমবার তাঁকে ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারে ডেকে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয় ভালাে অতীত রেকর্ডের জন্য, কিন্তু তাঁর অজান্তেই তাঁর পিছনে একজন গুপ্তচর লাগিয়ে দেওয়া হয় প্রতিটি খুটিনাটি বিষয় ও গতিবিধি খেয়াল রাখার জন্য।

কথায় বলর রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ রক্ত ছাড়া থাকতে পারে না। তারকের দশাও হলো তাই। আস্তে আস্তে ঘুষখাের অসৎ পুলিশ হিসাবে কুখ্যাতি ছড়াতে শুরু করল তাঁর। চোর ডাকতে চুরি ডাকাতি করে পার পেয়ে যায়। ছেলে ছােকরারা আবাধে মেয়েদের টোন টিটকারি করে। অর্ধেক ফ্ল্যাট নির্মাণ করে নির্মাণকারী অতি সহজে হিসেবে তাকে সম্পূর্ণ হিসেবে লিখিয়ে নিতে পারে থানা ও প্রশাসনের যােগসাজোশে। এতদিন পর্যন্ত ঘুষ খেতে অভ্যস্ত সে সব অফিসারেরা তারকের সততার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন, তাঁরা তারকের এ হেন পরিবর্তনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আবার অবৈধ টাকার বখরায় লাল হতে শুরু করল অফিসার এবং সাধারণ পুলিশ কর্মীরা।

শুধুমাত্র আর্থিক বেনিয়মই নয়। অতি দ্রুত চারিত্রিক স্খলনও শুরু হল তারকের। প্রথম প্রথম নিষিদ্ধ পল্লিতে যেতেন। তার পর বিধিনিষেধের আগল খুলে যাওয়াতে বাড়িতেই আনাগােনা শুরু হলো পেশার মেয়েমানুষদের। যে বাবা এতদিন ভগবানের আসনে ছিল তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি অবিশ্বাস , অশ্রদ্ধা ও ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠতে থাকলেন ক্রমে ক্রমে। মদ খাওয়া শুরু হল এরপর। এক একদিন এমন হত যে বেহেড মাতাল তারককে রাস্তায় ধার থেকে ধরে ধরে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেত রাস্তার মানুষ অথবা অধস্তন কর্মচারীরা। আমাদের সমাজটা উপর থেকে বােঝা না গেলেও ভিতরটা ঘুণে ঘুণে ভঙ্গুর কাঠের মতাে। একটু চাপেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। সমাজে মাঝে মাঝে কিছু মহাপুরুষের অবির্ভাব হয় যারা যুগেযুগে সমাজের খােলনলচে পাল্টে ধ্বংস আর অবক্ষয়ের হাত থেকে তাকে রক্ষা করে। তারকের যুগের কোনাে মহাপুরুষের সন্ধান ভবিষ্যৎ ইতিহাসবিদ যদি করেন তাহলে অন্ধকার হাতড়ে কার নাম উঠে আসবে তা বলতে পারি না তবে যে সমাজসংস্কারের পতাকা বাহক হিসেবে তাঁর যে পরিচিতি ছিল, সে পরিচিতি তিনি নিজের দোষে খুইয়ে তাঁর প্রিয়জনদের যে অসহ্য যন্ত্রণার কারণ হয়েছিলেন তিনি , সে কথা নিশ্চয়ই জানা যাবে।  বিশ্বাসের অবমাননা যে সব মানুষদের দ্বারা ঘটে ইতিহাসে তারা মিরজাফর বলে খ্যাত হয়। তারক হেন একটা মানুষকে সেরকম একটা পঙ্কিল আসনে বসাতে মানুষের খুব কষ্ট হয়েছিল সন্দেই নেই কিন্তু এছাড়া কোনাে পথও ছিল না তাদের কাছে। তারককে যৌন রােগে ধরল এর পর। মাত্রাধিক মদ খাওয়ার কারণে লিভারের বারােটা বেজেছিল এর আগেই। মাঝে মাঝেই অফিস ছুটি নিয়ে শহরে ছুটতে হতো তার চিকিৎসা করাতে। সে মানুষটার স্ত্রী অর্থাভাবে মারা গেছিলেন তিনি যখন মােটা সােনার চেন গলায় দিয়ে দামি পােশাক পরে শহরের বেসরকারি হাসপাতালে নিজের গাড়ি থেকে নামতেন তখন তাঁকে দেখে মানুষের শ্রদ্ধা হওয়ার থেকে ঘৃণা আর অনুকম্পা হতো বেশি।  এ ভাবে কাটল আরও পাঁচ বছর। সে সময় আর শরীরের কারণে  তিনি তাঁর বাড়ি থেকে বিশেষ বেরােতে পারেন না।

জমানাে ছুটি শেষ। মেডিক্যাল, ই.এল সবই প্রায় নিঃশেষিত। এর পর আস্তে আস্তে মাইনে কাটা শুরু হবে। নিরুপায় ও বেপরােয়া তারক তাঁর অনিয়মের সাম্রাজ্যে অধিকার কায়েম রাখার জন্য পয়সা দিয়ে ভাড়াটে গুণ্ডা পুষলেন। তারা দিনে, রাতে, সময়ে অসময়ে নানা অছিলায় পয়সাওয়ালা লােকেদের থেকে তোলা তুলে এনে তারককে দেয় এবং হিস্যা পায়, বিনিময়ে।

উপর মহলে ভালাে যােগাযােগের ফলে তার গুণ্ডারা দু এক বার লকআপে গেলেও তাদের সহজেই সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে আবার পুরনাে কাজে জুড়ে দিত তারক।

এরপরেই ঘটল সেই চরম ভয়ংকর ঘটনাটা। দিনটা ছিল পনেরই আগস্ট। সকাল থেকে মেঘলা, তার সঙ্গে ঝােড়াে হাওয়া ও টিপটিপ বৃষ্টি। মাছিগ্রাম সংলগ্ন রেলওয়ে স্টেশনে ওয়াগন ব্রেকারদের একটা দল আগে থেকে খবর পেয়ে মালগাড়ির কোনাে একটা বগি থেকে মূল্যবান ধাতব প্লেট চুরি করছিল। সামনে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষদের থেকে তাদের প্রােটেক্ট করছিল তারকের গুণ্ডারা। বেলা চারটে নাগাদ পুরাে প্রক্রিয়ার সমাধা হল। সে দলে সাতজন, আর এদিকে তারক ও তার দুই গুণ্ডা। বিরাট অঙ্কের টাকার ব্যাপারটা মনে মনে হিসাব করে তারক তাদের কাছ থেকে সটান অর্ধেক হিস্যা দাবি করে বসল। এর থেকে তর্কাতর্কি, কথা কাটাকাটি এবং শেষে গােলাগুলি। এক ওয়াগন ব্রেকারের গুলি এসে সােজা লাগল তারকের বুকের বাম দিকে এবং তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হল তাঁর। অকুল সংসার সমুদ্রে পড়ে রইল তার অসহায় ছেলেমেয়েরা।

ভগবানের একচোখামিও মাঝে মাঝে বড় অদ্ভুত ঠেকে। যতদিন তারক সৎ ভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন ততদিন ভগবান তাঁকে দুঃখ, দারিদ্র হতাশা ছাড়া কিছু দেননি। কিন্তু যখন তিনি জীবনের স্বাদ পাওয়ার জন্য অসৎ হতে শুরু করলেন, তিনি অতি সন্তর্পণে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে তারপর শান্তি পেলেন।
আমি ইতিহাসবেত্তা নাই। তবুও মনে হয় এ তাে নতুন কিছু নয়। ইতিহাসের প্রধান সড়কগুলির আশপাশে যে সব অপরিসর অন্ধকার রাস্তাগুলি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে তার উপরে কখন কী নিষ্করুন ঘটনা মানুষের চোখের অগােচরে ঘটতে চলেছে তা কেই বা খবর রাখে ! কারই বা চোখ ভারী হয়! ঘটনাক্রমে তারক আমার বন্ধু ছিল। তাঁর জীবনের অধ্যায় অতীত হওয়ার পর তার প্রসঙ্গের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর জনসমক্ষে দিতে হয়েছিল আমাকে! কখনও সহিষ্ণুতার সঙ্গে বুঝিয়েছিলাম কখনও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল আমার। কিন্তু দিনের শেষে সবসময় একটা কথাই মনে হতো —এরকম মাটির মানুষটির সঙ্গে এমনটি না ঘটলেই ভালাে হতো বােধহয়। কতকিছুই তাে ঘটে, যা না ঘটার  কামনা করে মানুষ মনে প্রাণে। তবু ঘটে তাে! ঘটনার উপর মানুষের হাত নেই কোনাে। আইলা, সুনামি, লায়লা, আমফান, হুদহুদের মতাে আরও কত দুর্ঘটনা ঘটে  কত মানুষের জীবনে। সাধ্য কি মানুষ তা আটকায়!


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments