জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৭/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৭

শ্যামল জানা


সাররিয়েলিজম্, মার্শেল দুশাম্প ও তাঁর অভিনবত্ব, ও অভিনব ক্যাটালগ

নিউ ইয়র্ক-এ ১৯৪২ সালে যে অভিনব প্রদর্শনীটি হয়েছিল— “ফার্স্ট পেপারর্স অফ সাররিয়েলিজম্”, তার ক্যাটালগটিও করেছিলেন মার্শেল দুশাম্প৷ এবং যথারীতি সেই ক্যটালগটিও ছিল প্রদর্শনীর মতোই অভিনব৷ তার আলোচনা আমরা আগের পর্বে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করেছি৷ এর ঠিক পাঁচ বছরের মাথায় আরও একটি অভিনব চিত্র-প্রদর্শনী করেছিলেন সাররিয়েলিস্টরা৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই ছিল তাঁদের প্রথম প্রদর্শনী৷ বিস্ময়ের ব্যাপার— তার যে ক্যাটালগটি হয়েছিল, তার অভিনবত্ব প্রদর্শনীকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল৷ এবং সেই সময়ে ওই ক্যাটালগটি নিয়ে প্রচণ্ড হইচই পড়ে গেছিল৷ আর, যথারীতি এটিও মার্শেল দুশাম্প-এর মগজপ্রসূত৷

১৯৪৭ সালের জুলাই ও আগস্ট, এই দু-মাস জুড়ে প্যারিস-এর ‘গ্যালারি মঘ’-এ এই প্রদর্শনীটি হয়েছিল৷ প্রদর্শনীর নামটি ছিল একই, যে নামে ওঁরা সাধারণত প্রদর্শনী করে থাকেন৷ “ইন্টারন্যাশনাল সাররিয়েলিস্ট এগজিবিশন”৷ মূলত পৌরাণিক বিষয়কে কেন্দ্র করে এই প্রদর্শনীটি হয়েছিল৷ যথারীতি মার্শেল দুশাম্প ও আন্দ্রে ব্রেতোঁ মিলে প্রদর্শনীটি পরিচালনা করেছিলেন৷ আর, এর পোস্টারটি করেছিলেন হোয়ান মিরো(ছবি-১)৷



 এই প্রদর্শনীটির অদ্ভুত বিশেষত্ব হল— মঘ গ্যালারি এই একটা প্রদর্শনীই প্যারিসের দু জায়গায় করেছিল৷ রাতারাতি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় একটা গোটা প্রদর্শনীকে, সামগ্রিকভাবে কোনো গুণমান ক্ষুণ্ণ না করে, তুলে নিয়ে যাওয়া সাধারণভাবে প্রায় অসম্ভব৷ কিন্তু তাকে সম্ভব করেছিলেন একজনই৷ তিনি হলেন— অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান শিল্পী ফ্রেডরিক কেইসলের৷ মঘ গ্যালারির নিজস্ব প্রদর্শনীকক্ষ থেকে মাঝপথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাতারাতি সম্পূর্ণ প্রদর্শনীটিকে যেখানে তুলে নিয়ে যাওয়া হল, সেই ঘরটির একটি রহস্যময় ভুতুড়ে ঘর ছিল! যে ঘরটি ছিল আক্ষরিক অর্থে একেবারে গোলকধাঁধা৷ শুধু তাইই নয়, সেই গোলকধাঁধা ঘরের সাধারণ পরিবেশকে আরও সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়ার জন্য, গা ছমছমে ভুতুড়ে ব্যাপারটা আনার জন্য, আলাদা অর্কেস্ট্রার সাহায্যে নানা ধরনের আওয়াজ করা হত৷ যেন আধ্যাত্মিকতার সাহায্যে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা৷ কারণ, সাররিয়েলিস্টদের আসল উদ্দেশ্য ছিল যে, সদ্যসমাপ্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক স্থায়ীভাবে ফরাসি সমাজের মানুষের অবচেতন মনে চেপে বসেছিল, তাকে, তাদের অজান্তেই ওই অবচেতন থেকে মুক্ত করে, স্বাভাবিক মানসিকতায় ফিরিয়ে আনা৷

এবারে আসব মার্শেল দুশাম্প-এর মগজপ্রসূত সেই ঐতিহাসিক ক্যটালগটির কথায়৷ যেটি চিত্রশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে চমকপ্রদ হিসেবে চিহ্নিত৷ অফিসিয়ালি এই প্রদর্শনীর ক্যাটালগটিকে তাঁরা চিহ্নিত করেছিলেন— ফরাসি ভাষায় "Surrealisme en 1947" portfolio হিসেবে ৷ আর, পিছন প্রচ্ছদে(Back Cover) যে ক্যাপশন ব্যবহার করা হয়েছিল ফরাসি ভাষায়— "Prière de toucher"৷ তাকে বাংলা করলে দাঁড়ায় “ছুঁয়ে দ্যাখো”৷ এই "Prière de toucher" বা ইংরাজিতে “Please Touch”-ই ইয়োরোপ তথা সারা বিশ্বে ক্যটালগটির নাম হিসেবে অমর হয়ে আছে৷ একজন যুবতী নারীর স্তন ঠিক যেরকম হয়, মার্শেল দুশাম্প হুবহু সেরকম একটি স্তন কৃত্রিমভাবে তৈরি করলেন থ্রি-ডাইমেনশনালি৷ ঠিক যেরকম মাপ, যেরকম দেখতে, যেরকম রঙ, স্পর্শ করলে যেরকম লাগে, হুবহু সেরকমই৷ আর, তাকে আটকে দিলেন ক্যাটালগের প্রচ্ছদে(Front cover)৷ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করলেন একটি উজ্জ্বল কালো এক টুকরো ভেলভেট৷ আর, পিছন-প্রচ্ছদে(Back cover) লিখে দিলেন— "Prière de toucher"৷ অর্থাৎ “ছুঁয়ে দ্যাখো”(ছবি-২,৩)৷


 এই অভিনব বিষয়টি মার্শেল দুশাম্প-এর মাথায় এসেছিল তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে৷ এক সময় প্যারিস-এ তিনি এবং জন্মসূত্রে ইতালিয়ান এক পেন্টার, নাম “এনরিকো দোন্যাতি” মিলে কৃত্রিম স্তন তৈরি করতেন৷ যা হত আসল স্তনের সঙ্গে হুবহু এক রকম৷ মাপ, স্পর্শানুভূতি, রঙ, সবই৷ আর, হুবহু একইরকম যাতে দেখতে হয়, তার জন্য তাঁরা প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদাভাবে পেন্টিং করতেন৷ এই অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে তিনি আবার দোন্যাতিকে খুঁজে বার করলেন৷ আদৌ মনে আছে কিনা, এই সন্দেহ নিয়েই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন৷ দোন্যাতি তখন নিউ-ইয়র্ক সিটিতে থাকতেন৷ দীর্ঘদিন পর দুজনে আবার যখন মুখোমুখি হলেন, দোন্যাতি সমস্ত সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে মার্শেলকে জানালেন, তাঁর সব মনে আছে৷ জানালেন— I remarked that I had never thought I would get tired of handling so many breasts.৷ তখনই দুশাম্প জানালেন— Maybe that’s the whole idea.৷ দোন্যাতি তখন আশ্বাস দিলেন যে, তিনি বিষয়টিতে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন, কারণ তিনি তখনও ওই ট্রেডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ ততদিনে বিষয়টি আরও আধুনিক হয়েছে৷ আমেরিকার বাজারে তখন অত্যন্ত দামী এক ধরনের নতুন ব্রেসিয়ার এসেছিল৷ নাম ছিল— ফলসিস৷ যার ভেতরটা তৈরি হত কৃত্রিম ফোম-রাবার দিয়ে৷ যেটি পরলে, স্তনকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বড় দেখাত৷ সেই সময়ের অভিজাত শ্রেণীর মহিলারা ওটি ব্যবহার করতেন৷ নিউ-ইয়র্ক সিটির ব্রুকলিন শহরে এই “ফলসিস” তৈরির একটি কোম্পানি ছিল৷ দোন্যাতি তাদের গোডাউন থেকে পাইকারি দরে ৯৯৯টি ওই রকম রেডিমেড “ফলসিস” কিনলেন৷

এবার ওই ফোম-রাবারের সাহায্যে তাঁরা যখন তৈরি শুরু করলেন, তাঁরা কোনো মনগড়া কিছু করলেন না, বা কোনো ঝুঁকি নিলেন না৷ ওই একটিমাত্র স্তনের জন্যও মডেল ব্যবহার করলেন৷ জানলে বিস্মিত হতে হয় যে, ওই মডেল যিনি হয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন, মার্শেল দুষাম্প-এরই তৎকালীন প্রেমিকা মারিয়া মার্টিন৷ তাঁরই স্তনকে অনুসরণ করে বা তাঁরই স্তনের অবিকল প্রতিরূপ(Replica)তৈরি করে ক্যটালগে ব্যবহার করা হয়েছিল৷ প্রথমে একটি উজ্জ্বল কালো ভেলভেটের ওপরে ওই স্তনকে জোরালো আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল৷ তারপর, ক্যাটালগটি যে কার্ডবোর্ড স্লিপ-কভার দিয়ে বাঁধানো হয়েছিল, তার মাঝখানে ওটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল(ছবি-২)৷ আর, ওরই অনুষঙ্গে পিছন-প্রচ্ছদে নীল বর্ডার দিয়ে, ভেতরে লিখে দেওয়া হয়েছিল— ছুঁয়ে দ্যাখো৷

আপাতভাবে মনে হতে পারে, মার্শেল দুশাম্প-এর এই আইডিয়াটি নোংরা দুষ্টুবুদ্ধি ছাড়া আর কিছু নয়৷ যেন সস্তার যৌন-উত্তেজনার সাহায্যে এই ক্যটালগকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অতিরিক্ত আকর্ষিত করার উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে৷ ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ তা নয়৷ এটি অত্যন্ত সৎ ও গভীর উদ্দেশ্য নিয়ে করা৷ একে বলা হয় সিম্বলিক অ্যাটিটিউড৷ এর সাহায্যে একটি গভীর অনুভবের কথা, যা সাধারণত বোঝানো যায় না, তাকে বোঝানো সম্ভব হয়৷

আসলে, এত দিনের প্রাচীনপন্থী জগদ্দল পাথরটাকে ভাঙার উদ্দেশ্য নিয়েই এটি করা৷ যে, তখন ঐতিহ্যগতভাবে যে কোনো প্রদর্শনীতে, স্থায়ী আর্ট গ্যালারিতে, মিউজিয়াম-এ, খুব কড়াকড়িভাবে প্রদর্শিত শিল্পবস্তুর থেকে নির্দিষ্ট একটি দূরত্বে দর্শকদের রাখা হত৷ তার থেকে বেশি কাছে যেতে দেওয়া হত না৷ পাছে, তাদের হাত লেগে ওই সব প্রদর্শিত শিল্পবস্তুগুলির কোনো ক্ষতি হয়, এই ভেবে৷ সাররিয়েলিস্টরা মনে করতেন, এটি একটি চরম ফ্যালাসি৷ যে, এতে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি প্রদর্শনী করছি, সেই উদ্দেশ্যটিই সম্পূর্ণ ব্যাহত হচ্ছে৷ যেন, যে মানুষ চোখে দেখতে পায় না, সে দেখতে পাওয়ার জন্য চশমা করালো, কিন্তু ভেঙে যাওয়ার ভয়ে তাকে আলমারিতে তুলে রাখল! একটি পেন্টিং, বা একটি স্কাল্পচার, বা একটি ইনস্টলেশন, বা যে কোনো সৃষ্টিশীল কিছু হোক না কেন, তাকে মনের গভীরে অনুভব করতে হলে, আত্মীকরণ করতে হলে, তার কাছে যেতে হবে, স্পর্শ করতে হবে, যাতে পূর্ণ পর্যবেক্ষণ হতে পারে৷ না হলে, অন্তর দিয়ে অনুভব করা, বা গভীর উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না কোনো মতেই৷ একজন পুরুষ, তার মনের নারীটির সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠ হয়, তার স্তন স্পর্শ করার মাধ্যমে তার যে সুখানুভূতি বা প্লেজার হয়, হতে পারে তা যৌনতা, কিন্তু তা অতি পবিত্র, অতি স্বর্গীয়, যা আত্মার গভীরে জন্মায়৷ একটি সৃষ্টিশীল শিল্পবস্তুও তাই৷ তাকে স্পর্শ না করলে, সৃষ্টির গভীরে যে প্লেজার থাকে, তাকে উপলব্ধি করা যায় না৷ সাররিয়েলিস্টরা এটাই বোঝাতে চাইলেন৷ খুব স্পষ্ট করে বোঝালেন— যে, এই ক্যাটালগের ভেতরে আমাদের শিল্পবস্তুর যে ছবিগুলি আছে, বা অন্যান্য যে বিষয়গুলি আছে, তাতে প্রবেশ করার আগে এই প্রচ্ছদটি স্পর্শ করো৷ তাতে তোমরে যে সুখানুভূতি হবে, তার সাহায্যে ভেতরের ছবিগুলি দ্যাখো৷
এই ক্যাটালগটির মাপ ছিল— ৯ইঞ্চি X ৭.২৫ইঞ্চি৷ গ্যালারি মঘ-এর পক্ষ থেকে ছাপা হয়েছিল মোট ৯৯৯টি ক্যাটালগ৷ যার মধ্যে স্পেশাল ছিল ৪৯টি৷ স্পেশাল অর্থে তাঁরা নির্দিষ্ট করে ওই ক্যটালগগুলিতে আলাদা করে একটি নম্বর দিয়েছিলেন(I–XLIX)৷ এই ক্যটালগগুলি স্পেশাল ছিল এই কারণে, যে এগুলিতে মার্শেল দুষাম্প ও আন্দ্রে ব্রেতোঁর নিজ হাতে সই করা ছিল৷ তৎকালীন নেতৃস্থানীয় সাররিয়েলিস্টদের ২৪টি ওরিজিনাল আর্ট ওয়ার্ক-এর প্রিন্ট ক্যাটালগের ভেতরে দেওয়া হয়েছিল৷ এর মধ্যে পাঁচটি ছিল রঙিন পাথরছাপ(Colour lithographs)৷ শিল্পীরা হলেন— ভিক্টর ব্রাউনের, ম্যাক্স এর্নস্ট, জ্যাকুইস হেরল্ড, উইলফ্রেদো ল্যাম ও হোয়ান মিরো৷ পাঁচটি ছিল ধাতুপাত তক্ষণছাপ(Etchings)৷ যার মধ্যে একটি ছিল রঙিন৷ শিল্পীরা হলেন— হান্স বেলমের, মার্শেল জিন, মারিয়া মার্টিনস, ইভেস ট্যাঙ্গে এবং ডরোথিয়া ট্যান্নিং৷ হান্স আর্প-এর দুটি কাঠ-খোদাই(Woodcuts)ছিল৷ বারোটি সাদাকালো পাথরছাপ(Lithographs)ছিল৷ শিল্পীরা হলেন— সের্গে ব্রিগননি, আলেকজান্ডার ক্যালদের, ব্রুনো ক্যাপাচ্চি, এলিজাবেথ ভ্যান ড্যামে, জুলিও দে দিয়েগো, এনরিকো দোন্যাতি, ডেভিড হেয়ার, জ্যাকুইলাইন ল্যাম্বা, রবার্তো মাট্টা, কেয়ে সাগা, ইভেস ট্যাঙ্গে এবং টয়েন(মেরি সারমিনোভা)প্রমুখ৷
এই ব্রিলিয়্যান্ট ও দুঃসাহসিক “ছুঁয়ে দ্যাখো” ক্যাটালগটি তৎকালীন ইয়োরোপ-এর রুচি ও সৌন্দর্যবোধে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল৷ বলা যায় সে প্রভাব এখনো মুছে যায়নি৷ এই ক্যাটালগটির কথা প্রায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ ফলে, প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাটালগটি কেনার জন্য অনুরোধ আসত৷ এরকমই, এক বছর বাদে ১৯৪৮ সালে সুইৎজারল্যান্ডের জেনেভা-তে এক কপি ক্যাটালগ পাঠাতে হয়েছিল৷ কিন্তু সেটি বাজেয়াপ্ত করেছিল তৎকালীন প্রকিওর জেনারেল অফ দ্য কনফেডারেশন৷ তবে, বিষয়বস্তুর কারণে নয়৷ শুধুমাত্র এর প্রচ্ছদটি ব্যাভিচারাক্রান্ত বলে৷ আপনি বা আমি এখনো হয়তো কিনতে পারব৷ তবে খরচ করতে হবে মাত্র সাড়ে তিন লাখ ভারতীয় টাকা৷          (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments