জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-৬/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার 

শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল


পর্ব :: ৬ 

প্রতিদিনের অভ্যাসে স্বরূপানন্দজি আনন্দমেলায় মর্নিং ওয়াকে গেলেন। তার মন আজ চঞ্চল। গতকাল যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তার চেয়েও বড় কথা, এমন নৃশংস ভাবে চিড়িয়াখানার ময়ূর আর হরিণকে কে মারল? কেনই বা হত্যা করল? মারার কায়দাটা একেবারে আদিম মানুষদের মতো। তীর দিয়ে শরীরের এমন জায়গায়, অভ্রান্ত মেরেছে যে, ময়ূর বা হরিণ টের পাওয়ার আগেই মারা গেছে। কারোর চোখেও পড়েনি ব্যাপারটা।পশুপাখি তো কারোর কোনও ক্ষতি করেছে বলে মনে হয় না। এর মাধ্যমে কি কোনও বার্তা দিতে চাইছে আততায়ী? 

পাহাড়ের কোলে, আনন্দমেলা যাবার পথে ঝর্ণাতলায় একটু দাঁড়ালেন স্বরূপানন্দজি। ঝর্ণার পাশেই একটা বিশালাকার বহু পুরনো বটগাছ আছে। গাছের নিচে পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া পশু পাখি। গাছের কাণ্ডে, ঝুরিতে লাল শালুর টুকরো বাঁধা। তেল সিঁদুরের দাগ লেগে আছে গাছের কাণ্ডে, নিচু প্রশাখায়। গ্রামের দেবতা গরাম আর বড়াম থাকে এই গাছের তলায়। নিশ্চয়ই কেউ নিয়মিত পুজো করে। এত দিন যাতায়াত করছেন এই পথ দিয়ে কিন্ত কখনোই এত নিখুঁত ভাবে দেখেননি এই গাছের তলা, ঝর্ণা, আর গরাম বড়াম। 

থমকে দাঁড়িয়ে আছেন স্বরূপানন্দজি। সকালের রোদের আভায়, গৈরিক আকাশে পাহাড়ের কোলে সূর্য ওঠার প্রস্তুতি চোখে পড়ে। এই ভোরের আলোয় স্বরূপানন্দজিকেও তাঁর গৈরিক পোশাকে অন্যরকম লাগে। কী মনে হল তাঁর, আজ আর গেলেন না আনন্দমেলায়। এখানেই সূর্য প্রণাম সারলেন। তারপর ফিরে এলেন শান্তি আশ্রমে। আনন্দমেলা না যাওয়ার অর্থ অনেক গভীর। এলাকার মানুষ সবাই বুঝতে পারেন স্বরূপানন্দজি নিশ্চয়ই কোনও সংকটে পড়েছেন। 

আমাদের তড়িঘড়ি ডাকলেন। গত সন্ধ্যায় একপ্রস্থ আলোচনার পর আমরা তেমন কিছুই সূত্র বের করতে পারিনি। আজ আবার অসীম মলয় আমি সবাই এলাম।অনেক আলোচনার পর থানায় গিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির নামে ডায়েরি করা হল। পুলিশকে বিশেষ অনুরোধ করলাম যাতে এই ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা হয়। 

আরও কিছুদিন কাটল। ময়ূর হত্যাকারীর কোনও হদিস পাওয়া গেল না। এই না পাওয়ার যন্ত্রণা আসলে অনেক কিছুর ইঙ্গিত করে। এবং আমরা যে ভয় করতাম, আন্দাজ করতাম বড় কোনও দুর্ঘটনার, সেটাই ঘটল। 

এতবড় সর্বনাশ মেনে নেওয়ার জন্য আশ্রম, কুসুমপুর,চন্দ্রপুর এই পুরো এলাকার কেউই প্রস্তুত ছিল না। এই ঘটনা অভাবনীয়। কোথাও যেন দুই দুই চার সমীকরণ মিলে যাচ্ছিল। 

ময়ূরকে যে ভাবে তীর মারা হয়েছে, যে কায়দায় হরিণকে হত্যা করা হয়েছে, সেই একই কায়দায় আজকেও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে প্রশিক্ষিত আততায়ী। ভোরের আলো ফোটার আগেই গাছের আড়াল থেকে অভ্রান্ত তীর চালিয়েছে অজ্ঞাতনামা খুনি। 

আনন্দমেলা যাবার জন্য শান্তি আশ্রম থেকে বেরিয়েছিলেন স্বরূপানন্দজি। সঙ্গে নিত্যদিনের মতো দুজন সঙ্গীও ছিল।তাদের প্রত্যক্ষ বিবরণ থেকেই এইসব ঘটনার কথা ছড়িয়ে যাচ্ছে লোকালয়ে। সঙ্গে থাকা দু'জন ভয়ে সাহস পায়নি আততায়ীর পেছনে ধাওয়া করার। সে অবলীলায় জঙ্গলে হাওয়া হয়ে গেছে। হত্যাকারী নিখুঁত ছিল তার লক্ষ্যে। কোনোরকম ভাবে স্বরূপানন্দজি হেঁটে শান্তি আশ্রমের কাছাকাছি এসেছিলেন। সঙ্গীদের কাঁধে ভর করে। তারপর লুটিয়ে পড়ে যান মাটিতে। এটাই শেষ পতন। আর ওঠেননি। এমনকি ডাক্তারের আসার অপেক্ষা বা হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় সুযোগ উনি দিয়ে যাননি। 

পুলিশ এসে সব দেখে সুয়োমোটো কেস করেছে। তাদেরই নির্দেশ মতো পোস্টমর্টেমও করা হয়েছে শহরের হাসপাতাল থেকে।

কালী মন্দিরের সামনে তাঁর পালঙ্কে শায়িত আছেন নিথর স্বরূপানন্দজি। পাশে আলুথালু বসে আছেন রূপসীদেবী।আস্তে আস্তে ভিড় করছে ভক্তদল। যত সময় যাচ্ছে দূরান্ত থেকে আসছে অসংখ্য ভক্তরা। পুরো আশ্রম জুড়ে এক নীরব মহামিছিলে সামিল হাজার হাজার মানুষ। 

এতসব ঘটনার ঘনঘটায় আমিও দিশেহারা। কেউ কিছুই বলতে পারছে না। সারা জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকেই পাওয়া যায়নি। কদিন আগের হরিণ হত্যা আসলে মহড়া ছিল। স্বরূপানন্দজির কাছে বার্তা ছিল আগাম পরিণতির। 

কিন্তু কেন ঘটল এই এত বড় সর্বনাশ! স্বরূপানন্দজিরও তাহলে শত্রু ছিল। ভালো কাজ করার স্বীকৃতি কি তাহলে এটাই? জানিনা এই হত্যার রহস্য কী। সমকাল এর উত্তর দিতে অসমর্থ। উত্তর দেবে হয়তো আগামী সময়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments