জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী -৯/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৪০


মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী ― ০৯

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ― ০২ 

সুগভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে, পাহাড়ের সানুদেশের সে কি অপরূপ শোভা! খালি পাহাড়ের চূড়া আর চিরহরিৎ অরণ্যের সমারোহ। দুই পাহাড়ের মাঝে চোখ জুড়ানো সবুজের উপত্যকা। সে-অরণ্যে সবুজের চাদর বিছিয়ে রেখেছে কেউ। সবুজের সমুদ্রে মাথার ওপরে পেঁজা তুলা মেঘ খেলা করে। খবরী মেঘ খবর বয়ে নিয়ে বেড়ায় এক পাহাড় চূড়া থেকে আরেক চূড়ায়। সে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যমালা! হৃদয় জুড়িয়ে যায়। কখনও পাতলা, আবার কোথাও ঘন অরণ্যের ভেতরে মাঝে মধ্যে মাথা ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে শ্বেতশুভ্র শৈলশিরা। সকালের রক্তিম আভায় কিংবা বৈকালিক অস্তমিত সূর্যের আলোকচ্ছটায় তামাটে বর্ণ ধারণ করে দূরের বরফ জমা হিমালয়ের সুউচ্চ টিলাগুলি। আকাশে এক অদ্ভূত ধরণের নীল রঙ ফুটেছে। সে মন হারানোর দেশে মেঘেদের নিত্য খুনসুটি। হানাহানি। যখন-তখন ভিজিয়ে দেয় পর্বতের কোল।
      

       দুর্গম অথচ সুন্দর পর্বতশীর্ষগুলির মাঝের ঢালু মালভূমি অঞ্চলে কিংবা পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট গ্রামগুলি। গ্রামে সাকুল্যে হয়তো পঁচিশ-তিরিশ ঘর মানুষের বাস। বাজার হাট বেশ দূরে; দশ-বারো ক্রোশ পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যেতে হয়। দুর্গম পার্বত্য রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে শহরে। অতি বর্ষায় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাহাড়ে ধস নামে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পথঘাট। পার্বত্য অঞ্চলের কর্মঠ মানুষগুলোর জীবন তখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাদের দুঃখ দুর্দশার নবতম সংযোজন বোধহয় প্লাস্টিক দূষণ, যা তাদের অজ্ঞাতবসরে অনবরত নিরবচ্ছিন্ন ঘটে চলেছে। এ সমস্যা সমগ্র বিশ্বের। পৃথিবীর কোণায় কোণায় জমে আছে প্লাস্টিকের জঞ্জাল। সুগভীর সমুদ্রের তলদেশ হোক কিংবা সুউচ্চ হিমালয়ের শীর্ষ, সব জায়গায় প্লাস্টিকের রমরমা। এর ব্যতিক্রম হয়নি নৈনিতাল সহ কুমায়ুন রেঞ্জের বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চল।
       কুমায়ুন রেঞ্জের এ হেন পাহাড়ের সানুদেশে বিভিন্ন জায়গায় সেজন্য নিয়মিত ব্যবধানে বসছে ক্যাম্প। শৈল এলাকার মানুষকে সচেতন করার আকুল প্রয়াস। ক্যাম্পে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন বৈজ্ঞানিক নন্দগোপাল বাবু নিজে। প্লাস্টিক সচেতনতার উদ্দেশ্যে শহর নৈনিতাল, শহরতলির বাজার এলাকা, মফস্বলের রাস্তাঘাট ও পার্বত্য গ্রামগুলিতে অনুষ্ঠিত হত পথনাটক, কম্পিটিশন, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, পেইন্টিং প্রতিযোগিতা আর মাইকিং। এত সব করার একটাই লক্ষ্য― নৈনিতাল এবং লাগোয়া অঞ্চলের প্লাস্টিক দূরীকরণ। হিমালয়কে প্লাস্টিক দূষণ থেকে রক্ষা করা সমীচীন।
       বাড়ির দৈনন্দিন ব্যবহার্য অথচ পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পদার্থের যথেচ্ছ ব্যবহারে রাশ টানা। সেগুলির যথাযথ রিসাইক্লিং-এর বন্দোবস্ত করে প্লাস্টিক মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন বৈজ্ঞানিক। এ তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার, উদ্যোগ। এক্ষেত্রে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সম্ভাবনা তাঁর মাথায়। প্লাস্টিক থেকে গ্রাফিন তৈরি হলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, অন্যদিকে তেমনি পরিবেশ থেকে প্লাস্টিক নির্মুল সহজতর হবে। তা, গোটা প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে কীভাবে সম্পন্ন করা যাবে?
        

       প্রতিটা এলাকায় পৌরসভার বসানো একাধিক ডাস্টবিন রয়েছে গলির মোড়ে মোড়ে। যেখানে যত প্লাস্টিক জঞ্জাল আছে― ব্যবহার্য, অব্যবহার্য কিংবা পরিত্যক্ত, সব সংগ্রহ করে নাগরিকরা যেন নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে রাখে। সেখান থেকে ডাঁই করে রাখা প্লাস্টিকগুলি পৌরসভার গাড়ি করে অনায়াসে পৌঁছে যাবে ন্যানো-সেন্টারে। অথবা কোনও সচেতন নাগরিক চাইলে প্লাস্টিক সরাসরি পৌঁছে দিতে পারেন ন্যানো-সেন্টারে। এটা কোনও ব্যক্তি বিশেষের একক কাজ নয়; বরং সমগ্র সমাজের সমষ্টিগত কাজ, পরিবেশ প্লাস্টিক মুক্ত রাখার প্রতিজ্ঞা। ন্যানো-সেন্টারের স্টুডেন্ট-টিচারদের সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি নৈনিতাল পৌরসভা এবং আরও তিন-চারটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন (NGO) যুক্ত রয়েছে এই মহান কর্মযজ্ঞে। একযোগে যুগপৎ সচেতনতা শিবির আয়োজনের প্রচেষ্টা চলছে বহুদিন যাবৎ।

(দুই)
কখনও কখনও শিবির চলেছে টানা তিন দিন ধরে। প্রত্যন্ত গ্রামে অথবা মফস্বল শহরে ঘুরে ঘুরে প্রচার চালাচ্ছে রিসার্চ স্টুডেন্ট আর এন. জি. ও. সদস্য বন্ধুরা। তাদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গতে ন্যানো-সেন্টারের প্রফেসর নন্দবাবু ও তাঁর পুরো ফ্যামিলি― পত্নী কলিদেবী, পুত্র, কন্যা। অপরিমিত উপায়ে যথেচ্ছ প্লাস্টিক ব্যবহার একদিন সমূহ বিপদ ডেকে আনবে। আর সে-দিনটা বেশি দূরে নয়, অদূর ভবিষ্যতে অপেক্ষা করে রয়েছে। সেজন্যে সময় থাকতে যত্রতত্র প্লাস্টিকের অপরিকল্পিত নিক্ষেপে রাশ টানতে হবে। তা না-হলে নিজের সুন্দর শহর-গ্রাম-সোসাইটিতে একদিন নেমে আসবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সে-বিপর্যয়ে স্বভাবতই প্রকৃতি সঙ্গ দেবে না মানুষের। নদীপথে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের জঞ্জাল নদীর স্বাভাবিক গতি অবরুদ্ধ করবে। সামান্য বৃষ্টিতে বণ্যার মতো কঠিন দুর্বিষহ পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। 
       বারংবার প্রচারে অভূতপূর্ব সাড়া মিলল ক্যাম্পগুলোয়। রীতিমত জঞ্জাল সংগ্রহের ধুম পড়ে গেল শহরে, গ্রামাঞ্চলে। জঙ্গল, পাহাড়, খরস্রোতা নদী, সমাজ, পরিবেশের পবিত্রতা রক্ষায় নন্দবাবুর এ প্রচেষ্টা তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। আর সম্মাননা। ২০১৭ সালে উত্তরাখণ্ডের গভর্নর ড. কে. কে. পল স্যারের হাত থেকে বেস্ট সায়েন্টিফিক কাজের সুবাদে গভর্নর মেডেল পেলেন তিনি। এতেই থেমে থাকল না তাঁর কাজ। দিনকে দিন চ্যালেঞ্জ বাড়তে থাকল। সামাজিক সচেতনতার বার্তা প্রচারের পাশাপাশি সমানতালে চলল বৈজ্ঞানিক গবেষণা। ধীরে ধীরে এত বেশি প্লাস্টিক আসতে শুরু করল যে, গ্রাফিন বানানোর জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল আরও বড় উন্নত মেশিন বানানোর। কিন্তু কোথায় মিলবে তেমন যন্ত্র? 
       ব্যাঙ্গালোরের একটি কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত। কোম্পানির সঙ্গে মধ্যস্থতা করে প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে রাখে বন্ধু সঞ্জয়, ড. সঞ্জয় সরকার। ব্যাঙ্গালোরের অপর এক কোম্পানির মস্ত বড় কর্তাব্যক্তি তিনি। মিটিং-এর যাবতীয় ছক তাঁরই কষা। পাকা বন্দোবস্ত। নন্দবাবুর পরিকল্পনা মতো ওই কোম্পানির সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা বিপুল অর্থ ব্যয় করে তৈরি হল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক মেশিন। নাম 'স্বয়ম্ভু'। সম্পূর্ণ নাম 'স্বয়ম্ভু ওয়েস্ট রিসাইকেল মেশিন ২০২১' (Sayambhu Waste Recycle Machine 2021)। সংক্ষেপে, 'Sayambhu WRM 2021'। ন্যানো-সেন্টারে এ হেন যন্ত্র ইনস্টল করতে মূল্যবান দুটো বছর চলে গেল। এক্ষেত্রে কারণটা যত না টেকনিক্যাল; তার চাইতে অনেক বেশি সামাজিক ও পরিবেশগত পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব। পরিবেশগত কারণের দোহাই দিয়ে অনেকেই ভ্রু কোঁচকাল― এ মেশিন পরিবেশে দূষণ ঘটাবে কি-না! যদিও কী হবে বা না-হবে, একশো শতাংশ নিশ্চিত নয় কোনও পক্ষ। স্বাভাবিক ভাবেই একটা ঝুঁকির ব্যাপার থেকে যায়। কারণ কেউ নিঃসন্দেহ নয়। তা, এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সাফল্যের শতকরা হার নিয়ে সকলের মুখ চোখে সামান্য সংশয়। সবাইকে আশ্বস্ত করলেন নন্দবাবু। দীর্ঘ টালবাহানা শেষে লাল ফিতার ফাঁস সামান্য আলগা হল। মেশিন কেনার দুবছর পর বসল যন্ত্র। সেটা ২০১৮ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। এবার কাজ করার পালা।
     

       মেশিন কী, বৈজ্ঞানিকের কথা মত, ঠিকমতো কাজ করতে পারবে? প্লাস্টিককে দারুণ তাপে গরম করলে যে টক্সিন গ্যাস নির্গত হবে, তা পরিবেশে মিশে দূষণ ঘটাবে না তো? না-কি উৎপন্ন গ্যাস বায়ুতে মিশে মানব জাতির বিনাশের কারণ হবে? কীভাবে কাজ করবে মেশিন?
       প্রথম প্রথম অনেকে হয়তো নাক সিঁটকেছে, বিদ্রুপাত্মক হাসাহাসি করেছে। ব্যঙ্গাত্মক শ্লেষ মাখা শব্দগুলো তাঁর দিকে ধেয়ে এসেছে, ক্রমশ তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভীড় করেছে। কারও কারও অভিব্যক্তি তাঁর নিকট খুব বেদনার। তারা বলেছেন― সাহু স্যার তো হাওয়ায় কাজ করেন। এত বিরূপ মন্তব্য শুনে শুনে তিনি বেমালুম নির্বিকার! গা সওয়া হয়ে গেছে তাঁর। নিরবে নিরিবিলিতে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে চলেছেন তিনি। অবশ্য এর বাইরে অনেক প্রফেসরও আছেন, যারা সাহস জুগিয়ে চলেছেন নিয়মিত। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ধরেছেন। যেমন তৎকালীন এইচ. ও. ডি. প্রফেসর এস. কে. মেহতা স্যার। রসায়নের বর্তমান বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর এ. বি. মেলকানি স্যারও পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা যুগিয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

       ইতিমধ্যে মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ থেকে একটি আবদার আসে। সেটা ২০১৯ সালে। স্বয়ম্ভু WRM 2021-এর মতো একটি যন্ত্র বানানো, এক টন থেকে দুই টন যার ক্যাপাসিটি। নৈনিতাল এলাকায় এ হেন যন্ত্র বসানোর উত্তম প্রস্তাব আসে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। নৈনিতালে যত জঞ্জাল প্লাস্টিক থাকবে, সবংশে নির্মূল হবে। গ্রাফিন আবিষ্কারে একদিকে যেমন ইকোনমিক গ্রোথ হবে, অন্যদিকে রাস্তাঘাট ঝাঁ চকচকে থাকবে। প্লাস্টিক দূষণের বিন্দুমাত্র চিহ্ন থাকবে না।

(তিন)
       'You never fail until you stop trying' ― প্রচেষ্টা করা ছেড়ে না-দিলে আপনি কখনও ব্যর্থ নন।
― এই আপ্ত বাক্যটুকুই সম্বল। এটাই ল্যাবের নীতিবাক্য (moto)। পি. আর. এস. ন্যানো-সায়েন্স এবং ন্যানো-টেকনোলজি সেন্টার ( Nanoscience & Nanotechnology Centre) প্রমাণ করেছে― চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই। খালি নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হবে। পাঁচ বছর আগে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সমাজের শুভ করবার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ন্যানো ল্যাবের বাস্তব সম্মত প্রয়াস বিশেষ নজর কাড়ে।
      
      
 গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব-উষ্ণায়ন― আজ নিছক এক শব্দবন্ধ নয়। আধুনিক গতি-সর্বস্ব সমাজের সবচাইতে বড় শত্রু। ফি-বছর যে হারে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে; তা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। তা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এত বাড়ছে কেন? মানুষের দৈনন্দিন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-ভোগ-বিলাস বৃদ্ধি এর প্রকৃত কারণ। সেজন্য বাড়ছে দূষণ। গাড়ি, কলকারখানা, পাওয়ার-প্ল্যান্ট আর বাড়ি থেকে বেড়ে চলেছে বায়ু দূষক গ্যাসের নির্গমন। প্রাকৃতিক তৈল, কয়লা, ন্যাচারাল গ্যাসের মত জীবাশ্ম জ্বালানি, গ্যাসোলিন আর প্লাস্টিকের জঞ্জাল পুড়ে উৎপন্ন হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্রীন হাউস গ্যাস। সেগুলো সরাসরি বাতাসে মিশছে। বায়ু দুষিত হচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। বিশ্ব-উষ্ণায়ন যার অবশ্যম্ভাবী ফল। 

       গবেষণার তথ্য বলছে― প্লাস্টিক উৎপাদন আর দহনে ৮৫০ মিলিয়ন টনের বেশি গ্রীন হাউস গ্যাস বাতাসে মিশেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই পরিমাণ বেড়ে হবে দুই দশমিক আট বিলিয়ন টনের মতো। সবচেয়ে খারাপ খবর হল― প্রতি বছর কমপক্ষে প্রায় আট মিলিয়ন প্লাস্টিক সমুদ্রে মিশছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা বেড়ে হবে দ্বিগুণ। পৃথিবীর গভীরতম স্থান মারিয়ানা খাদ (Mariana Trench); সমুদ্র তল থেকে গভীরতা প্রায় এগারো কিলোমিটার। সেই দুর্গম স্থানেও প্লাস্টিক জমা হচ্ছে। সমুদ্রই পরিবেশের বৃহত্তম ন্যাচারাল কার্বনের শ্রেষ্ঠ শোষক। এ হেন সমুদ্রে প্লাস্টিকের অন্তর্ভুক্তি সামুদ্রিক পরিবেশের কার্বন ব্যালেন্সে বিঘ্ন ঘটাবে। এ যে সাংঘাতিক বিপদের সংকেত! তেমন বিপদ সামুদ্রিক প্রাণীকুলের গলা টিপে ধরবে। কারণ প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্র সহজে নষ্ট হতে চায় না। ভাঙন ধরতে বছরের পর বছর কাবার হয়ে যায়। যখন সৌরালোক আর প্রচণ্ড উত্তাপে প্লাস্টিকের ভাঙন ঘটে; প্রচুর মিথেন ও ইথিলিন উৎপন্ন হয়। শক্তিশালী সবুজ ঘর গ্যাসের জ্বালায় জলবায়ু পরিবর্তন তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বিশ্ব-উষ্ণায়ন বাড়ে; চক্র সম্পূর্ণ হয়।

       ন্যানো-সেন্টার ল্যাব এ হেন প্লাস্টিক নির্মূলকরণের স্বপ্নে বিভোর। বৈজ্ঞানিক ড. নন্দগোপাল সাহু আর তাঁর রিসার্চ স্টুডেন্টরা এক বিশেষ রিঅ্যাকটর যন্ত্র বানিয়ে ল্যাবরেটরি স্কেলে প্রথম শুরু করেছিলেন গবেষণা। বাস্তবে বৃহৎ আকারে তা সম্ভব হচ্ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন বড় যন্ত্র, বড় প্রোজেক্ট। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ (Ministry of Environment, Forest & Climate Change) থেকে ২০১৬ সালে একটি রিসার্চ প্রোজেক্ট মিলল। প্রোজেক্টের নাম 'Envirinmentally Sustainable Smart Synthesis of Carbon Nanomaterial along with the Production of High Value Added Fuel and Additives for the Concrete Mixture from Waste Plastic, a hazardous waste around the Himalayan Region'।
       
     
  সমাজের কল্যাণে ন্যানো-ল্যাব বিপুল ব্যয়ে উদ্ভাবন করে 'স্বয়ম্ভু ডব্লিউ. আর. এম. ২০২১' (Swayambhu WRM 2021) মেশিন। 'স্বয়ম্ভু' একটি সংষ্কৃত শব্দ; যার অর্থ― এই মেশিন একটি স্ব-ইচ্ছাকৃত এবং স্বয়ংচালিত যন্ত্র (Self-sufficient)। দু'বছর পর, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে স্বয়ম্ভু যন্ত্র ইনস্টল করা হয় ন্যানো-সায়েন্স এবং ন্যানো-টেকনোলজি সেন্টারে। প্রথমে এর ক্ষমতা ছিল একশ কেজি। পরে অনুরোধ আসে যন্ত্রের ক্ষমতা বাড়ানোর। তা, কীভাবে কাজ করে এই বিস্ময় মেশিন?
       Swayambhu WRM 2021 একটি অনুপম প্লাস্টিক জঞ্জাল রিসাইক্লিং মেশিন। বৈজ্ঞানিক নন্দগোপাল বাবুর মতে― বাকি সব জঞ্জালের চেয়ে প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থের এনার্জি ভ্যালু অপেক্ষাকৃত বেশি। স্বয়ম্ভু যন্ত্রে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে জঞ্জাল প্লাস্টিক থেকে ১২-১৫% গ্রাফিনের কাঁচামাল এবং ২৫-৪০% অপরিশোধিত তৈল পাওয়া যায়। এখন, গ্রাফিন ও ক্রুড ওয়েল―এ দুইয়ের মধ্যে একটি খুব ব্যয়বহুল ও অন্যটি বহুল প্রচলিত বানিজ্যিক পণ্য। আবার বর্জ্য পদার্থ হিসাবে যে গ্যাস উৎপন্ন হয় যন্ত্রে, সেগুলি পুনর্ব্যবহার করেই মেশিন তার দরকারি জ্বালানি খরচ মেটায়। এখানেই এ যন্ত্রের বিশেষত্ব। সেজন্যই এর নাম 'স্বয়ম্ভু'। এতদিন পর্যন্ত পরিবেশ থেকে প্লাস্টিক মুক্ত করার নির্দিষ্ট প্ল্যান সরকারের ছিল না। ন্যানো-সেন্টারের কল্যাণে প্লাস্টিক মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার স্পষ্ট নির্ভরযোগ্য দিশার হদিস পেল সরকার।

       নৈনিতালে প্লাস্টিক দূষণ রোধে একটি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে― প্লাস্টিক থেকে গ্রাফিন পেতে প্লাস্টিককে স্বয়ম্ভু যন্ত্রে নিক্ষেপ করার পূর্বে কুড়ি টন থেকে তিরিশ টন ক্যাপাসিটির একটি 'সেগ্রিগেশান ইউনিট' (Segregation Unit)-এর মধ্যে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়। এর সাহায্যে শুধু যে বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক থেকে নন-বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক সহজে পৃথক হয়ে যায়, তা নয়; যেকোনও সলিড জঞ্জাল পদার্থ পৃথক করারও বন্দোবস্ত থাকবে। তা, সেগ্রিগেশান ইউনিট থেকে নন-বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক আলাদা করে এক টন ক্যাপাসিটি বিশিষ্ট স্বয়ম্ভু যন্ত্রে চলে যাবে। অপরদিকে, বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক গিয়ে পড়বে এক টন ক্যাপাসিটির বায়ো-কম্পোস্ট চেম্বারে।

(চার)
       নির্মল আর সবুজ ভারত! আজ্ঞে হ্যাঁ, 'ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন ইন্ডিয়া' (Clean and Green India) গড়ার লক্ষ্যে তাঁর 'স্বয়ম্ভু' মেশিন অলঙ্ঘনীয় মাইলস্টোন তৈরি করে চলেছে জাতীয় ও রাজ্য―উভয় স্তরে। তাঁর আবিষ্কৃত গ্রাফিন কাজে লাগিয়ে তৈরি হচ্ছে সুপার-ক্যাপাসিটর, ওয়াটার পিউরিফিকেশন টেকনোলজি, সোলার সেল, ড্রাগ ডেলিভারি, পলিমার ন্যানো-কম্পোজিট ইত্যাদি আধুনিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। 

       দারুণ খুশির খবর। তাঁর কষ্টার্জিত গবেষণা বয়ে আনল আনন্দের সংবাদ। গ্রাফিন আবিষ্কারের সৌজন্যে মিলে গেল জাতীয় খেতাব। সেটা ২০১৮ সাল। সেবার তিনি পেলেন 8-th National Awards for Technology Innovation from Ministry of Chemicals and Fertilizers, Department of Chemicals and Petrochemicals, Govt. of India, 2018। সেদিন ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়ামে উপরাষ্ট্রপতি মাননীয় শ্রী এম. বেঙ্কাইয়া নাইডু মহাশয়-এর হাত থেকে জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করার দিন। এ হেন পুরস্কার প্রাপ্তির দিনে মেজদা শ্রী অসিত কুমার সাহুকে চেন্নাই ডেকে পাঠালেন বৈজ্ঞানিক। বিশেষ কাজে বাড়িতে আটকে গেলেন মেজদা। আসতে পারলেন না।

       আবার ২০১৯ সাল। উত্তরাখণ্ড সরকার দিল স্বীকৃতি। সে'বছর 'উত্তরাখণ্ড রত্ন অ্যাওয়ার্ড' সম্মানে ভূষিত হলেন তিনি। ২০২০ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (Fellow of Royal Society of Chemistry বা সংক্ষেপে, FRSC) নির্বাচিত হন। অতিসম্প্রতি, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ তারিখে শিক্ষক দিবসে পেলেন 'Excellent in Research of the Year Award 2021'। সম্মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রী পুস্কর সিং ধামি স্যার এই পুরস্কারটি শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের হাতে তুলে দেন।
       
       
যেকোনও স্বীকৃতি ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে তোলে, অনুপ্রেরণা জোগায়। এতসব অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি তাঁর গবেষণায় জেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গবেষণার কাজে দ্বিগুণ উৎসাহ সঞ্চার করেছে। সেজন্য নিজের লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুতি ঘটেনি তাঁর। তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ডের বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল নৈনিতালকে 'গ্রীন সিটি'তে রূপান্তরিত করার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। সে-কাজে তিনি সফল। অবশ্য, তাঁর সে-প্রয়াস এখনও জারি আছে। ইতিপূর্বে কেন্দ্র সরকারের থেকে দ্বিতীয় দফায় সাড়ে তিন কোটি টাকার প্রোজেক্ট মঞ্জুর হয়েছে।

       সে-প্রোজেক্টে চালু রয়েছে প্লাস্টিক বিরোধী জাগরণ― Plastic Awareness Program। অতিসাম্প্রতিক কালে নৈনিতাল শহর জুড়ে 'মেগা ক্লিন আপ' (Mega Clean Up) প্রোগ্রাম চলেছিল অর্ধেক পক্ষকাল; ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর'২০২১। মেগা ক্লিন আপ প্রোগ্রামে পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। যুগপৎ এত মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় প্লাস্টিকের জঞ্জাল দূরীকরণে অংশ নেওয়ার ঘটনা উত্তরাখণ্ডের ইতিহাসে এই প্রথম। ছবি আঁকা, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার মতো আকর্ষণীয় ইভেন্টের বিষয়বস্তু ছিল প্লাস্টিক দূষণ। প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষুদে ক্ষুদে প্রতিযোগীদের প্লাস্টিক বর্জনে উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাদের মধ্যে সামাজিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না স্থানীয় উদ্যোক্তাদের। অল্প বয়স থেকে বিদ্যার্থীরা পরিবেশের পবিত্রতা রক্ষায় সচেষ্ট হয়ে উঠুক―এই ছিল আশা। প্লাস্টিক মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে একজন যুবা'র ক্ষুদ্র অথচ প্রশংসনীয় অংশগ্রহণ তথা উদ্যোগ বাকি সমগ্র জীবনে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।

       পরিশেষে, রত্নগর্ভা মেদিনীপুরের মাটিতে ড. নন্দগোপাল সাহু'র ন্যায় বৈজ্ঞানিকের উত্থান মেদিনীপুরবাসী হিসাবে গর্ব করার মতো বিষয় বৈকি। তাঁর আপাত সাধারণ ছাত্র জীবনের পশ্চাতে এক উদীয়মান বৈজ্ঞানিকের যে সুপ্ত বীজ লুক্কায়িত ছিল, উপযুক্ত পরিবেশে তার বিকাশ সত্যিই অনুপ্রাণিত করে। বর্তমানের দিকভ্রষ্ট যুবসমাজকে আলাদা করে সাফল্যের পথ দেখায়। এ হেন প্রিয় বৈজ্ঞানিকের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। এগিয়ে চলুক তাঁর সাফল্যের অশ্বমেধ-ঘোড়া। আবিষ্কারের উজ্জ্বল নক্ষত্রছটায় তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন লক্ষ-নিযুত-কোটি মানুষের হৃদয় মাঝে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. নন্দগোপাল সাহু স্যার। আপনার শ্রীচরণে আমার শতকোটি প্রণাম। আগামী অক্টোবর মাসের তিন তারিখে শুভ জন্মদিনে আপনাকে আগাম গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ নমস্কার জানাই। (সমাপ্ত)

তথ্য-ঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সেজদা শ্রী ননিগোপাল সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বন্ধুস্থানীয় দাদা শিক্ষক শ্রী দেবাশীষ মান্না

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments