জ্বলদর্চি

খপ্পর-৬ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস: খপ্পর 
পর্ব: ছয় 
অনিন্দ্য পাল 

চিত্র- জাহ্নবী সেন


সাত

শৈলীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেলে উঠলো দীপু।মাথাটা গরম হয়ে আছে। দীপু বুঝতে পারে না, এই মেয়েটা এত বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও এরকম ক্যালাস কেন।আজ দু'ঘন্টা ধরে মাত্র চারটে অঙ্ক কষেছে। এত কথা বলে, এত কথা বলে, যে মাঝে মধ্যে মনে হয় ঠাস ঠাস করে চড়ায়। কিন্তু গায়ে হাত তোলা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই বকাবকিতেই কাজ চালাতে হয় যদিও শৈলীর দুষ্টামির কাছে তার বকুনির আয়ু মাত্র কয়েক মিনিটের বেশি হয় না। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, আদরে বাঁদর না হলেও পড়াশুনায় তেমন লেগেপড়ে থাকার ব্যাপার নেই। এতেই অবাক হয় দীপু। 
              শৈলীর বাবা খুব বড়লোক না হলেও যথেষ্ট সচ্ছল। মেয়ের লেখাপড়ার জন্য যা দরকার তারচেয়ে বেশীই করে, কিন্তু মেয়ে সে সব কাজে লাগালে তো! প্রতিটা বিষয়ের জন্য গৃহশিক্ষক। তারপরেও কোন একটা কোচিং সেন্টারে মাসে দুটো করে মক টেস্ট দিতে যায়। এত সব করার পর না সে নিজে পড়ে আর না তার পড়ার সময় হাতে থাকে। মাস গেলে অন্ততঃ হাজার পাঁচেক টাকা এই খাতে খরচ হয় রজত কাকুর। অথচ, দীপু নিজের পড়াশুনাটা চালাতে পারলো না আর, আর্থিক অনটনে ডুবন্ত সংসারটা ঘাড়ে এসে পড়লো হঠাৎ। বাবা আগেই ক্যান্সারে মারা  গেল, মা আয়ার কাজ করে সংসারটা চালাচ্ছিল, কিন্তু সংসার আর আয়ার কাজ, এই দু’রকম ধকল শরীর নিতে পারলো না। টিবি ধরা পড়লো। সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সপ্তাহে তিনদিন ওষুধ খেতে যেতে হত। 
      তপু তার আগেই স্নাতক পাশ করে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছে। দীপুর সবে স্নাতকের প্রথমবর্ষ। সেই শুরু টিউশনের। তপুর টিউশন পড়ানোর ধৈর্য ছিল না, কোন রকমে এম এ কমপ্লিট করে, একটা ফিজিওথেরাপির কোর্স করে নিয়েছিল। এখন পার্লারের থেকে, কখনো বিভিন্ন কনট্যাক্ট থেকে বিভিন্ন যায়গায় যায়। তপু একটু বাউণ্ডুলে ধরনের, উপার্জনের বেশীরভাগটাই নিজের হাতখরচ আর চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য খরচ করে। সংসারে তার অবদান কমই। দীপুই এখন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 
         টিউশন থেকে হাজার ছয়েক আয় হয়। গ্রামের দিকে তেমন মাইনে দেয় না কেউ। প্রথম দিকে এমনো হয়েছে তার, দশ জনের একটা ব্যাচ পড়িয়ে মাসে মাত্র তিনশো টাকা উপার্জন হয়েছে। দীপু বুঝেছিল এভাবে চলবে না, আরো কিছু দরকার। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে গেছিল অনেক জায়গায়। সেলস, ডোর-টু-ডোর সেলস। কোন একটা কোম্পানি,  বিজ্ঞাপনে ছিল এম এন সি অর্থাৎ 'মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি', ভারতের সবকটা শহরে নাকি তাদের ব্রাঞ্চ  আছে, এরকম সব গালভরা শব্দ। ইন্টারভিউ যে নিচ্ছিল, তার সিভি দেখে বলেছিল, "তুমি ফিজিক্স অনার্স কমপ্লিট করবে না?" দীপু বলেছিল, "জানি না, সংসারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, তাই উপার্জন দরকার। মা অসুস্থ।" তার কথা শুনে সেই ম্যানেজার চোখ কুঁচকে বলেছিল, "পয়সার জন্যই তো সবাই কাজ করতে আসে, তাই না! যাই হোক, আমিও একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি ছেড়ে এই কোম্পানিতে জয়েন করেছি। এখানে ইচ্ছা করলে তুমি ফাইভ ডিজিটের ইনকাম করতে পারবে, যখন তখন। কয়েক বছর করলেই নিজের বাড়ি, গাড়ি  সবই হবে।" 
           প্রথম ধাপে উৎরে গিয়ে বেশ আনন্দ হয়েছিল দীপুর। ভেবেছিল, বাহ! একটা ভালো কাজ পাওয়া গেল। এবার টিউশনটা ছেড়ে দিতে হবে। একটু পয়সা জমিয়ে আবার পড়াশুনাটা শুরু করতে হবে। অনার্সটা কমপ্লিট করতেই হবে। ইন্টারভিউ এর দ্বিতীয় ধাপে তাকে এক জন সিনিয়রের সঙ্গে পাঠানো হল "ফিল্ড ডেমোন্সট্রেশনে"। তাদের সঙ্গে দেওয়া হল কয়েকটা টামি ট্রিমার এর প্যাকেট। পেটের চর্বি কমাবার যন্ত্র। সেই সিনিয়র, ঝন্টু মন্ডল, তাকে নিয়ে ঘুরলো বিভিন্ন অফিস, কলকাতা মেডিকেল কলেজ। কিন্তু একটাও বিক্রি হয় নি। খুব মুষড়ে পড়েছিল ঝন্টু। তাকে একবার চা, একবার ফুটপাথের বিহারি দোকান থেকে লঙ্কা দিয়ে ছাতু মাখা খাওয়ালো। ঝন্টুকে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল। ঝন্টুর জন্য দীপুর কষ্টই হচ্ছিল। 
           বিকেল চারটে নাগাদ যখন পৌঁছালো, সেই অফিসে, সেখানে তখন আরও জনা পঁচিশেক তার মত ট্রেনি জমা হয়েছে। কারও বিক্রি হয়েছে, কারও হয়নি। ঝন্টু তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে ঢুকেছিল। স্পষ্ট শুনেছিল দীপু, "শুয়োরের বাচ্চা, একটা মালও কাটাতে পারিসনি? কি মারাতে গেলি? ওটাকে যদি লাগাতে না পারিস তোর -- মেরে দেব বোকা--।" দীপু বুঝতে পেরেছিল,  ভুল জায়গায় চলে এসেছে। ফিরে এসে ক্লাস থ্রি র ছোট্টুকে পড়াতে চলে গেছিল। ছোট্টুর মা মুড়ি আর বাদাম দিয়েছিল টিফিন, সঙ্গে চা। 
          এর পর কখনো আশায়, কখনও খেলাচ্ছলে আরো অনেক এরকম ইন্টারভিউ দিয়েছে দীপু। দেখেছে সব ম্যানেজারেরাই বলে তারা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছিল। হাসি পেত। তবে গড়িয়াতে এরকম একটা "এম এন সি ডিরেক্ট সেলিং ম্যাক্সিমাম" নামধারী কোম্পানি আবার একধাপ এগিয়ে ইন্টারভিউতে সিলেক্টেডদের জন্য পরের দিন সন্ধ্যায় পার্টি দিয়েছিল। দীপু একটু আশার আলো দেখেছিল। সেই প্রথম পার্টি। মেয়েরা সর্টস্কার্ট পরে মিউজিকের তালে তালে নাচতে নাচতে তাদের মেল পার্টনারের গাল ছুঁয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তাকে টেনে নিয়েছিল এক মেয়ে। দীপুর হাতটাকে তার কোমরে জড়িয়ে দিয়েছিল মাফলারের মত, তারপর শরীরের সঙ্গে লেপ্টে নিয়েছিল। দীপু কেঁপে উঠেছিল, তার বুকের ভিতর হাজার বছরের বৃহস্পতির ঝড়। কয়েক মিনিট পর মেয়েটা তার পাছায় একটা থাপ্পড় মেরে ব্যাঙ্গের সুরে বলেছিল "বি স্মার্ট ইয়ার!" দীপুর মনে হয়, সে আজও তেমন স্মার্ট হতে পারেনি। 
          তপুর যখন এম এ ফাইনাল শুরু হতে একমাস বাকি, সংসার প্রায় অচল হয়ে উঠলো। দীপু কাটজুনগরে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিল। ছোট্ট একটা অফিস। না, সেখানে সুকুমারদা নিজেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বলেন নি। পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলেছিলেন, "এই কসমেটিক্স আমি বড়বাজার থেকে কিনে আনি, এর গায়ে যে প্রিন্ট প্রাইস আছে, তুমি আমাকে তার সেভেন্টি পারসেন্ট দেবে, বাকিটা তোমার। যেমন ধরো এই ফিনাইলদুটোর প্যাকেটটার প্রিন্টেড প্রাইস একশ টাকা, তুমি সত্তর টাকা আমাকে দেবে, এবার তুমি যদি নব্বই টাকায় বিক্রি করতে পারো, তবে তোমার থাকবে কুড়ি টাকা। আর যদি একশতেই পারো তাহলে তিরিশ তোমার। আমার টাকাটা তুমি রোজ ফিরে এসে দিলেই হবে। এটা তোমার জন্য ছাড়।"
         কসমেটিক্স আর সাবান, শ্যাম্পু , ফিনাইল নিয়ে বেরোত রোজ। সুকুমারদা তাকে একটু অন্য চোখে দেখতো, সেটা বুঝতে পেরেছিল কয়েকদিন পর। সেদিন খুব বৃষ্টির জন্য কাটজুনগরে সেই অফিসঘরেই  বসে ছিল তারা কয়েকজন। দুপুর পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টি থামলো না, দীপুর খুব হতাশ লাগছিল। তপুর পরীক্ষা। চাল শেষ, বেরোবার সময় মা বলে দিয়েছিলো। এই কদিন তেমন কিছু উপার্জনও করতে পারে নি, কোন দিন তিরিশ টাকা, কোনদিন চল্লিশ টাকা। তার মুখ দেখে বোধহয় সুকুমারদা বুঝেছিল কিছু। আড়ালে ডেকে তার হাতে পঞ্চাশটা টাকা গুজে দিয়ে বলেছিল, "পঞ্চাশ বছরের সংসারের ওয়েট কুড়ি বছরের কাঁধে, কাঁধটা শক্ত করে তুলতে হবে, দুমড়ে ভেঙে গেলে কি করে চলবে। এখন অনেক খাড়াই পেরোতে হবে দীপু। এটা রাখ, পরে বেচাকেনা হলে দিয়ে দিস।" সুকুমারদাকে সেদিন একটা প্রণাম করতে ইচ্ছা করেছিল কিন্তু করে উঠতে পারে নি, ততটা স্মার্ট তো ছিল না সে। 
               দীপু প্রায় আটমাস করেছিল ডোর-টু-ডোর সেলিং। ছোটবেলায় দেখা সেই হরেকমাল সাড়ে-ছটাকার হকার হওয়াটা তার ভাগ্য ছিল, এটা মেনে নিতে পারতো না। আরো কষ্ট হত, যখন কোন বাড়ির কড়া নাড়া দিলে ভিখারির মত ব্যবহার করতো। সেদিন তার সঙ্গে ছিল রাজু। জিনিস ও ছিল অনেক রকম। গড়িয়ার ঢালুয়াতে ঢুকেছিল। একটা বাড়িতে ঢুকে "কেউ আছেন, এস এন্টারপ্রাইজ থেকে আসছিলাম" বলতেই বয়স্ক এক লোক অসম্ভব খারাপ খিস্তি দিতে দিতে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। চোখে জল এসে গেছিল সেদিন। রাজু তাকে বুঝিয়েছিল, হকার আর ভিখারির মিল এই একটা জায়গাতে। গালাগাল টা ওভারটাইমের পাওনা। 
  অনেক জায়গায়, বিশেষ করে বস্তিতে ঢুকলে বিক্রি হত, কিন্তু   চুরি হয়ে যেত প্রায়ই। অনেক মেয়ে বৌ একসঙ্গে তার কসমেটিক্স এর ব্যাগের উপর আছড়ে পড়ল, কিন্তু কিনলো মাত্র একজন, অথবা কেউই হয়ত কিনলো না। সেখান থেকে বেরিয়ে আর এক জায়গায় গিয়ে দেখলো, বেশ কয়েকটা আইটেম ততক্ষণে গায়েব। এইরকম একটা বস্তিতে প্রথমদিন কয়েকটা লিপস্টিক  চুরি যাবার পর, জেদ করে যখন দ্বিতীয় দিন গেল, একজনো ঘরের বাইরে বের হয় নি।ঘটনাটা এখনও মনে পড়লে হাসি পায় দীপুর। 
            পাপিয়া কখনো ফেরায় নি তাকে। একমাত্র পাপিয়াই  নিয়ম করে প্রতিমাসে দীপুর থেকে স্নো, পাউডার, ফাউন্ডেশন, শ্যাম্পু, সাবান নিত। বয়সে তার চেয়ে একটু বড় হলেও দীপুদা বলে ডাকতো। খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারতো পাপিয়া। দীপু অপেক্ষায় থাকতো, দশ তারিখের। সেদিন ও গিয়েছিল তেমনি, সেটা ছিল সেপ্টেম্বরের দশ তারিখ।পাপিয়ার বডিটা একটা বাঁশে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশের ডোমেরা। 
           গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল পাপিয়া। পরে শুনেছিল রাজুর কাছে, ওর দাদাই শেষ করে দিয়েছিল ওকে। পেটে বাচ্চা ছিল, পাঁচ মাসের। এর কয়েক দিন পর স্বপ্নে দেখেছিল পাপিয়াকে। বিষন্ন, ক্লান্ত। খুব কষ্ট করে দীপুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, "কই এলে না তো, বলেছিলে একটা খুব ভালো গন্ধের পাউডার আনবে আমার জন্য। আমি কত কষ্টের মধ্যেও তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি। কই এলে না তো।" 


           সেই পাউডারের কৌটোটা দীপুর বইয়ের তাকে এখনো পাপিয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। দীপু কাউকে ওটা মাখতে দেয়নি, দেবেওনা। পাপিয়া আসে, কখনো বিষন্নতা মাখা মুখে চুপচাপ বসে থাকে, বিছানায়। তার পায়ের কাছে। তার চোখ নামিয়ে রাখে অনন্ত পাতালের দিকে, সেই রাতে খুব যন্ত্রণা হয় দীপুর, ঘুম ভাঙে না আবার ঘুম আসেও না। সে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে, বলতে চায় সেই জন্তুটার দু'টো পা কাটা গেছে ট্রেনের চাকায় কিন্তু স্বর আটকে যায়। গলার ভিতরে যেন স্বরতন্ত্রির উপর চেপে বসে থাকে কেউ, চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারে না পাপিয়াকে। আবার কোনও দিন পাপিয়া আসে, যেন কোন কষ্ট নেই, কোন দুঃখ নেই, যেন সে এসেছে শুধু দীপুর জন্য। সুন্দর করে সেজে এসে বসে ঠিক দীপুর মাথার পাশে, পাপিয়ার লম্বা সরু আঙুল গুলো খেলা করে যায় তার চুলের ভিতরে, পাপিয়া সেদিন ছড়িয়ে পড়ে দীপুর সমস্ত সত্তা জুড়ে। 
সেই রাতে দীপু প্লাবিত হয়, সুখে, ভালোবাসায়।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments