জ্বলদর্চি

ছায়া ছায়া অন্ধকার-৭/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/শিশির পাল

উপন্যাস 

ছায়া ছায়া অন্ধকার 
শিশির পাল 

অলংকরণ : সায়নী পাল 


পর্ব-৭ 

এত বড় ঘটনার পর সব কেমন থম মেরে গেছে। আমিও আর আশ্রমে নিয়মিত যাই না। আমার জীবন তো সেই কবে থেকেই শূন্যতাকে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে। আমার জীবন যেখানে সবচেয়ে বেশি জড়ায় সেখানেই শুরু হয় শূন্যতার। কেন এই অবিচার বারবার আমার সঙ্গেই হয়, আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু নদীর মতো জীবনও বহতা। আপন খেয়ালে বয়ে যায়। আর স্থবিরতা তো মৃত্যুরই রূপক! সুতরাং এগিয়ে যেতেই হয়। যেতে হবে আমাকেও। কষ্ট আছে। দুঃখ আছে। থাকবেও। এবং এই সব ব্যথাদীর্ণ উপাদানই আসলে জীবনের অনিবার্য সঙ্গী। পরিবর্তন এবং পরিমার্জন দিয়েই জীবনের গান লেখা হয়। এই পরিবর্তনকে ঠিকভাবে চালনা করার জন্যই তো আমাদের শিক্ষা, আমাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আমরা সযত্নে রাখি। একেই বলে চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট। 

শান্তি আশ্রমের প্রতি আমাদের দায়িত্ব বরাবরই একটু বেশি। তাই স্বরূপানন্দজি চলে যাবার পরও বাইরের থেকে দেখা বা মাঝে মাঝে গিয়ে আশ্রমের দেখভাল করা, এসব করতেই হয়।কোনও বাধ্যতায় নয়। স্বতঃস্ফূর্ততায় করি। আশ্রমের প্রধান ঘরের চাবি এখন আমার কাছেই থাকে। আর ডুপ্লিকেট একগোছা রাখা থাকে আকাশের কাছে। স্বরূপানন্দজি যখন প্রথম এসেছিলেন এখানে, তখনই তাঁর ছায়াসঙ্গী পিন্টু ছিল। ভালো বাংলা বলতে পারত না বলেই শুনেছি। হিন্দিভাষী ছিল। অবশ্য এখন ভাল বাংলা বলতে পারে। তবে ভাষার টানে বোঝা যায় ও বাংলার নয়। নেপালীদের মতো চ্যাপ্টা নাক। সবসময় স্বরূপানন্দজির সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকত। ওর ব্যাপারে আমরা আর বেশি কিছু জানতাম না। ওকেই সর্বক্ষণের জন্য, এই আশ্রমের কেয়ারটেকার হিসেবে রেখেছে পঞ্চায়েত থেকে। সর্বসম্মতিক্রমে। আসলে শান্তি আশ্রম তো আর সাধারণ আশ্রম নয়। এ যেন ঠিক রাজপ্রাসাদ। স্থাপত্যের চূড়ান্ত নিদর্শন এই প্রাসাদের প্রতিটি উপাদানে। বড় লম্বা টানা বিন্ডিং। কারুকার্য করা আসবাব। শোবার ঘর,ডাইনিং হল, ড্রয়িংরুম সব দেখার মতো। এ তল্লাটে এমন প্রাসাদ আর দুটো নেই। আমি আজ অব্দি এত সুন্দর, নিখুঁত এবং বড় বাড়ি দেখিনি। ইতিহাসে পড়েছি। স্বরূপানন্দজি আসার পর এইসব তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন। কোথা থেকে, কী ভাবে রাতারাতি যেন সব গড়ে উঠেছিল। এলাকার লোক বুঝতেই পারেনি। প্রশ্ন যে বাতাসে বাতাসে ঘোরেনি তা নয়। তবে কেউ বেশি ভেতর অব্দি পৌঁছাতেই পারেনি। আমিও জানিনা খুব বেশি কিছু। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে, এখন এই প্রাসাদ পড়ে আছে। অনাদরে। শুধু লাইব্রেরিটা আমি নিয়মিত ব্যবহার করি। এখন আবার নাটকের দলটা আস্তে আস্তে ছন্দে ফিরছে। আমরা এখনও শান্তি আশ্রমের জন্য যা করি তা আনন্দে করি। অভ্যাসে করি। সঙ্গে তো থানা পুলিশ আছে। বছরভর। তাদের অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এরই মধ্যে বিমান পরের বারের জন্য চন্দ্রপুর পঞ্চায়েতের প্রধান হয়েছে। অসীম কৃষকসভার আঞ্চলিক সভাপতি। মলয়ও সঙ্গে আছে। কমল পার্টির সঙ্গেই থাকে। সবাই মিলে পার্টিটা গুছিয়েই করছে এখন। এলাকার উন্নয়ন নজরে পড়তে শুরু করেছে। 

তবে স্বরূপানন্দজি চলে যাবার পর সবাই সব কিছু দেখে, ভেবে বলেছে, আশ্রমটা বাঁচাতে হবে। যে ভাবেই হোক।
এটাই হোক আমাদের প্রধান কাজ। প্রধান ব্রত। আমদের সবার চাওয়া তো তাই! 


ঘটনার উপর ভর করে বয়ে যায় গতিশীল সময়। কয়েকবছর পেরিয়ে গেল। স্বরূপানন্দজি হত্যার কোনও কিনারা হল না এখনও। আকাশ বদলি হয়ে এসেছে এই চন্দ্রপুর গ্রামীণ হাসপাতালেই। এতে আমাদের ভালোই হয়েছে। আশ্রমেরও ভাল হয়েছে। এলাকারও ভাল হয়েছে। এরই মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। 

আমরা বিকেলের দিকে আশ্রমে গিয়েছি। নিত্যদিনের যাওয়ার মতোই। কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে আশ্রমের ভেতরে ঢুকতে যাব, দেখি অনেক লোকজনের ভিড়। অনেক অনেক ভক্ত বসে আছে। ঘোরাফেরা করছে। বাইরে একটা দামি চারচাকার গাড়িও আছে। চেনা পরিবেশ, চেনা আশ্রমটা হঠাৎ উধাও। সেই নিঃস্বতা, থমথমে ভাব, লোকশূন্য আশ্রম আজ নতুন রূপে আমাদের চোখে ধরা দিচ্ছে। 

চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এক সুন্দরী অল্পবয়স্কা সাদা পোশাকের সন্ন্যাসিনী এসে বসেছেন আরাম কেদারায়। তাঁকে ঘিরে অনেক লোক। ভক্ত। তিনি শোনাচ্ছেন তাঁর জ্ঞানের কথা।নিজস্ব বাণী। আমি কেয়ারটেকার পিন্টুকে ডেকে কথা বললাম।
'কে এসেছেন? এত লোকের ভিড় কেন? কোথা থেকে এসেছেন এই মহিলা?'
পিন্টু অসহায়ের মতো বলে, 'তা তো জানি না। তবে বললেন অনেক দূর থেকে এসেছি। এখন থাকবে কিছুদিন এখানেই।'
'থাকবেন! সে তো আমরা ঠিক করব। উনি চাইলেই হবে নাকি।' 

আমি মলয়,বিমান,অসীম আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ডাকার ব্যবস্থা করলাম। সবাই এল। আলোচনায় ঠিক হল, যেহেতু আশ্রম পুরোপুরি খালি পড়ে আছে এবং এই বিবাগী সন্ন্যাসিনী থাকতে চাইছেন, সুতরাং ওঁকে থাকার মতো একটা ছোট ঘর ছেড়ে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই মূল বিল্ডিংয়ে থাকতে দেওয়া হবে না। একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় হল। 

এই ক'দিনে আশ্রমটা আস্তে আস্তে করে পাল্টাতে শুরু করেছে। দিনভর কিছু লোকজনের ভিড় থাকে। ভক্তদের ভিড়। চারদিকে খবর হয়েছে নতুন সন্ন্যাসিনী এসেছেন। আকস্মিকতা ধীর গতিতে মিশে গেল স্বাভাবিকতায়। 

#
সন্ধ্যায় বসে আছি লাইব্রেরিতে। একটু পরই নাট্যগোষ্ঠীর সবাই আসবে একে একে। কয়েকদিন ধরে একটা উপন্যাস পড়ছি। রহস্য উপন্যাস। অগাথা ক্রিস্টির বই। আমার গোয়েন্দা গল্প, রহস্য গল্পের বা উপন্যাসের উপর বিরাট নেশা।মিশে যাই চরিত্রের সঙ্গে। 

বাইরের দরজা খোলা ছিল। হঠাৎ খেয়াল হল আমার টেবিলের উল্টো দিকে এসে বসেছেন সন্ন্যাসিনী। আমি পড়া থামাইনি। একবার দেখেই চোখ নামিয়ে নিয়েছি। আবারও পড়ছি। সন্ন্যাসিনী আমাকে অনুসরণ করছেন। বুঝতে অসুবিধা হল না।
'আপনি রহস্য রোমাঞ্চ ভালোবাসেন? গোয়েন্দাগল্প?' লাইব্রেরীর স্তব্ধতাকে ভেঙে দিলেন সন্ন্যাসিনী। আমি বললাম, 'আপনি জানলেন কী করে?'
'জানি না তো! আন্দাজ করলাম। আপনার হাতের বইটা দেখে।'
আমি হাসি দিয়ে ভেতরের বিস্ময়কে ঢাকি। বাইরে শব্দ না করে হাসার চেষ্টা করলাম। 'পড়ি। ভালো লাগে। গোয়েন্দাগিরি করিও মাঝে মাঝে। বাস্তবে।'
একটু তীক্ষ্ণ করে তাকালেন সন্ন্যাসিনী। তাঁর নিস্পলক চাওয়ার কাছে চোখ রাখা কষ্টকর। তাঁর চোখে হাজার প্রশ্নের মালা। এখনই অন্য কোনও প্রশ্ন করে বসবেন। আমি অপেক্ষা করি। সন্ন্যাসিনীর চেহারায় অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে। নিটোল যৌবন ধারণ করে আছেন। বয়স তো আমাদের চেয়ে কোনোভাবেই বেশি নয়। কিন্তু এই অল্প বয়সে বিবাগী হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে, এখনও কেউ জানে না। আমার জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে। করি না। 
'আপনার ইচ্ছে হয় না জানতে, আমি আসলে কে,কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি? একবারও তো জিজ্ঞাসা করেননি?'
সন্ন্যাসিনী কি চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন? আমার ভেতরের আকুলতাকে নিজেই টেনে আনছেন। আমি বললাম, 'বেশ তো বলুন। আমি তো এখনও গোয়েন্দাগিরি শুরু করিনি!' বলেই হা হা করে হাসলাম। সন্ন্যাসিনীও হাসি মেলালেন। মুখে বললেন, 'খুব তাড়াতাড়ি জানাব। একমাত্ৰ আপনাকেই জানাব।' তারপর খুব ছোট একটা বিরতি নিয়ে হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, 'আচ্ছা, আপনার বন্ধু, ডাক্তারবাবু, আজ আসেননি কেন?'
বেশ অবাক করে কথাটা বললেন সন্ন্যাসিনী। আকাশকে কেন খুঁজছেন! ভেতরে ভাবলেও, মুখে বললাম, 'আজ ও আসবে না।'

একটু নীরবতা। কেউ কথা বলি না। হঠাৎ সন্ন্যাসিনী উঠলেন।বললেন, 'আপনারা বড্ড ভালোবাসেন এই শান্তি আশ্রমকে!এমনই পাশে থাকুন। সঙ্গে থাকুন এই আশ্রমের। এই গরিবের জায়গায় এই আশ্রম একটা আশীর্বাদ। আমরা নতুন করে জনসেবার কথা ভাবব। অনেক আলোচনা আছে আপনাদের সঙ্গে। আমি সবার সঙ্গে বসতে চাই একদিন। 

আমি সম্মতি জানাই। ঘাড় নাড়াই। কথাগুলো বলে আমার আর কোনো উত্তরের আশা না করে বেরিয়ে গেলেন লাইব্রেরী থেকে। আমি একটু অবাক হয়ে ওঁর চলে যাওয়াকে দেখি। ওঁর চলে যাওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল। উপন্যাসে ডুবতে পারছি না আর।

Post a Comment

0 Comments