জীবনের শ্রেষ্ঠ দুর্গাপূজা
সুদর্শন নন্দী
আমার দুজন মা। প্রথমজন মা জন্মদাত্রী, দ্বিতীয়জন মা জগদ্ধাত্রী। একজনের সাথে গর্ভের সম্পর্ক, আরেকজনের সাথে গর্বের। জন্মদাত্রী মা আমার জীবনের আলো জ্বালিয়েছেন,জগদ্ধাত্রী মা নিভিয়েছেন আমার জীবনের অন্ধকার। প্রথম মায়ের সাথে আমার আজন্ম সম্পর্ক আর দ্বিতীয় মায়ের সাথে সম্পর্ক আবাল্য। পুজোয় বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর গেলে আজও আমি মল্লরাজাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সেই জগদ্ধাত্রী মা দেবী মৃণ্ময়ীর মন্দির চত্বরে একবার বসি।
সামনের বট গাছের সামনে দাঁড়াই, কথা বলি। দেখি তিনি আজও আমাকে চিনতে পারেন কিনা। আমার বাল্যকাল, কৈশোর, কলেজ সবই এই মল্লরাজাদের রাজধানী, মন্দিরের দেশ বিষ্ণুপুর থেকে, দ্বিতীয় মায়ের আশীর্বাদছায়ায়। জগদ্ধাত্রী মা তথা মৃণ্ময়ী মায়ের সাথে আবার একটা দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক ছিল আমার। আমি দিতাম, পরিবর্তে তিনিও দিতেন। গিভ এন্ড টেক পলিসির মতো। প্রতিবছর আমি মানত করতাম ওটা দেব, এটা দেব ভালো করে পাশ করিয়ে দিও মা। বরাবর কথা রেখেছেন তিনি ;পরীক্ষায় মানত করতাম, যদিও আমার যা দেবার কথা পরীক্ষায় পাশের আনন্দে ভুলে যেতাম তা দিতে । মা হয়তো হাসতেন। ক্ষমা করে দিতেন সন্তানস্নেহে।
কথা দিয়ে কথা রাখি না বলে নিশ্চয়ই ভাবতেন বড় হলে সন্তান আমার কেউকেটা হবে নিশ্চয়ই। অন্যদিকে, জন্মদাত্রী মা বছরের শেষে শুধু জানতে চাইতেন পাশ করেছি কিনা। সারা বছর ধরে প্রতিদিন ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ননস্টপ যে খাটুনি খাটতেন মা, সংসারের ঘানি টানতেন, তা পাথুরে মাটিতে জল দেওয়ার মতো বৃথা গেল কিনা দেখতে চাইতেন তিনি।
আজও দুর্গাপুজোয় গিয়ে ভক্তিভরে দ্বিতীয় মা জগদ্ধাত্রী মৃণ্ময়ী মাকে প্রণাম করি। বিশ্বাসের প্রখর দৃষ্টিতে মৃন্ময়ী মায়ের চিন্ময়ী রূপ আমি দেখতে পাই স্পষ্ট। আমি আসায় তিনি হাসছেন খুশিতে। খানিক হাত মুচড়াতে থাকি। মা বলেন, সংকোচ কিসের। পড়াশুনো চাকরির পাঠ না হয় চুকেই গেছে। বল না কি চাস? আমি বলি, যোগ্যতার অনেক বেশি দিয়েছ মা। ফাঁকি দিয়েও ফাঁকে পড়ি নি কখনো। সাধ্য না থাকলেও সাধ সব মিটিয়েছ তুমি । সাধ,স্বাদ বাদ যায় নি কিছুই। সবই তোমার কৃপায় সতের আনা পূর্ণ। এবার যে চরণাশ্রিত হতে চাই মা। অপ্রত্যাশিত আবদারে মা যেন গোমড়া হয়ে যান। এরপর ঘুরে ঘুরে ঘ্রাণ নিই আশেপাশে সব চত্বরে। সামনেই বট গাছ। আগেই বলেছি, কথা বলি চিরনবীন সেই বন্ধু গাছটির সাথে। বিশ্বস্ত সেই বট আশৈশবের মানে ষাটের দশক থেকে সখা আমার। তাঁর সামনে দাঁড়ালে মনে আসে অতীতের কতো কথা। স্মৃতির সরণি বেয়ে পৌঁছে যাই সেই কিশোর বেলায়। মায়ের মন্দিরের কাছেই গড়দরজা। সন্ধিপুজার কামান দাগা হবে।
ঠেসে বারুদ পুরে মৃণ্ময়ী মন্দিরের অদূরে মুর্চা পাড়ে লাল মোরামের টিলার উপর সেটি বসানো হত। আজও হয়। ছেলেবেলায় প্রতিবার যেতাম সেই কামান দাগা দেখতে। সে কি রোমাঞ্চ! ভবা পাগলার মতো ঘুরতাম একা একা। হঠাৎ চারিদিকে নিস্তব্ধ। তারপর বুম...। কামান দাগল। ঢাক ঢোল কাঁসরের শব্দে ঢেকে যেত পুরো মল্লভূম । আর এই তোপের শব্দ শুনে সারা মল্লভুমের দুরদুরান্তের মন্দির প্রাঙ্গনে সন্ধিক্ষণের বলি হত, হয় আজও। সেই শব্দ আজও আমাকে পৌঁছে দেয় কৈশোরে। অজান্তেই চোখ ছলছল করে। এরই নাম বোধ হয় স্মৃতিবেদনা ! পুজোয় দামী জামা কাপড়ের প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিবছর একটা ভয় থাকত, এবছর কি জামাপ্যান্ট কেনা সম্ভব হবে? না হলে সবাই যে নতুন প্যান্ট পরে পুজোয় ঘুরবে, আমি কি পরব এই কটা দিন? তবে দু-একবার দেরি ছাড়া কম দামের হলেও জামাপ্যান্ট পেয়েছি নতুন। পাঁচ ভাইবোনের সংসার । সংসারের দূর্বল আয়। আয় থেকে ব্যয় বেশি, ফলে নেইও বেশি। তাই বেশির ভাগ বছরে পুজোয় একটি থান থেকে সস্তার মার্কিন কাপড়ের জামার ছিট কিনে দিতেন বাবা। গোপালগঞ্জে আবদুল কাকুর দোকানে মাপ দিয়ে আসতাম ভাইয়েরা। বাবা থানটি সময়ে দিয়ে আসতেন তাকে। বোতামের জায়গায় সরকা’র দড়ি দেওয়া প্যান্ট। এদিকে পুজোর সেই প্যান্ট পরে স্কুলে গেলে ভুগতে হত হীনমন্যতায়। অন্যরা যখন প্যান্টের বোতাম আর হুক আঁটকে প্যান্ট পরত, আমি তখন প্যান্টের দড়িটি কষে বেঁধে স্কুলে যেতাম। ইংরেজি স্যার প্রভাকরবাবু গুণী মানুষ ছিলেন। সেই গুণ আবার পড়ানো থেকে পেটানোয় বেশি ঝোঁক নিত। মারের এক অদ্ভুত কৃষ্টি সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। আদর করে বাবা বাছা বলে তাঁর ডায়াসে নিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম ভাবতাম কোলে চকলেট দেবেন। সে সময় কোলে কোম্পানির বিস্কুট আর চকলেটের রমরমা । কিন্তু সে চকোলেটে বালি। স্যার চাড় দিয়ে প্যান্টের ঘাড় ধরে আমাশার মতো মুচড়ে দিতেন সজোরে। কি আতঙ্কে থাকতাম! প্যান্টের দড়ি কটাস করে ছিঁড়ে গেলেই...।
বাটা’র জুতোর বিজ্ঞাপন মনে আছে এখনও। সেই ধারা আজও অব্যাহত। পুজোয় চাই নতুন জুতো। সে জুতো ছবি হয়ে বিজ্ঞাপনেই থাকত, কদাচ আমাদের পা পর্যন্ত পৌঁছেছে। নাইনে উঠেছি। সেবার আমার পুজো অন্যভাবে অপেক্ষা করছিল । বাবা দুর্গাপুরে স্টেট বাসে কাজ পেয়েছেন কবছর আগে। ডাঃ বিধান রায়ের আশীর্বাদে স্টেট বাস খুলেছে। কতো মানুষ চাকরি পেয়েছেন। বাবাও পেলেন প্রথম ব্যাচে। কম বেতন , অভাব সঙ্গী থাকলেও নুন ভাতের চিন্তাটা দূর হল চাকরি পাবার পর।
একদিন রাতে দুর্গাপুরের গ্যারেজে বাস রেখে ঘর আসবেন বাবা, দেখলেন বাসে একটা পুঁটলি পড়ে রয়েছে। বাবা সেই থলে খুলে হা হয়ে গেলেন। পুরো ব্যাগ সোনার গয়নায় ভর্তি। পাশাপাশি কেউ নেই। সেই ব্যাগ নিয়ে তিনি এলেন । ঘরে নয়, গ্যারেজের অফিসে। সিনিয়র দু চারজনকে অনুরোধ করলেন থানায় যেতে। দুএক জন অনৈতিক প্রস্তাব দিল। বাবা বললেন ভিক্ষা করে খাব, কারো জিনিস নিতে পারব না। খানিকপরেই আটদশ জন শিখ একটি গাড়ি করে গ্যরেজে এসে হাজির। তাঁদের নব বিবাহিত বৌ ঐ সোনার পুঁটলি বাসে ফেলে গেছে। বাবা সেই থলি ফেরত দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এরপর ঐ শিখ পরিবার তাঁদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতেন বাবাকে। পরের বছর ; সামনেই পুজো। মনে আছে সেবছর তাঁরা আমাদের জন্য দিয়েছিলেন জামা প্যান্টের দামী পিস। সেবার পুজোয় সেই কুলীন জামাপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়েছিলাম মা মৃন্ময়ীর সামনে। মা মৃণ্ময়ী চিন্ময়ী রূপ ধরে পাশে এসে বললেন, সততা আর পরিশ্রমের পথ থেকে বিচ্যুৎ হোস না কক্ষনো। জীবনে অন্ধকার নেভাতে বাবার আলোর পথে চলিস।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মা ভবতারিণী সাথে কথা কইতেন। আমার গর্বের দ্বিতীয় তথা জগদ্ধাত্রী মায়ের সেই জীবন নির্মাণের উপদেশ শুনে আমিও কথা কইলাম মায়ের সাথে। মায়ের চরণ ছুঁয়ে কথা দিলাম বাবার চরণচিহ্ন বুকে ধরে রাখব বলে। সেটিই ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দুর্গাপূজা।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments