জ্বলদর্চি

জয় কৃষক আন্দোলনের জয় সংঘবদ্ধতার/ গৌতম বাড়ই

জয় কৃষক আন্দোলনের জয় সংঘবদ্ধতার 

গৌতম বাড়ই 


তিন কৃষিবিল 

আজ পৃথিবীর সংগ্রামী জনগণের কাছে একটি চিরস্মরণীয় দিন হয়ে থাকল, ভারতবর্ষের তো বটেই।আজ যেমন শিখ ধর্মগুরু নানকের জন্মদিন, তেমনি ঐতিহাসিকভাবে আজ  চরম বিতর্কিত অমানবিক স্বাধীন ভারতবর্ষের, কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী 'তিন কৃষি বিল' প্রত্যাহারের কথা প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা ই- মিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র দেশবাসীকে জানানো। লেখার শুরুতেই মন্দাক্রান্তা সেনের সদ্য প্রকাশিত একটি কবিতার উল্লেখ না করে থাকতে পারলাম না ----- 

অভিনন্দন / মন্দাক্রান্তা সেন 

বুকের ভেতর জেগেছে নতুন স্পন্দন
লড়াকু কৃষক, তোমাদের অভিনন্দন
মৃত্যুর পণে লড়ে গেছ মাটি কামড়ে
শাসক, কী দিবি যত মৃত্যুর দাম রে 

সফল হয়েছে লড়াকু চাষির যুদ্ধ
ক্রূর শাসকের গতিপথ অবরুদ্ধ
সারা দেশ কবে শিখবে এমন সংগ্রাম
মুক্ত করবে যতেক শহর আর গ্রাম 

কৃষকের কাছে শিখে নাও সেই জিতটি
মুক্ত কৃষক গণতন্ত্রের ভিত্তি
মুক্ত শ্রমিক, মুক্ত আমি ও তোমরা
আমাদের বুকে লড়াই-এর প্রাণভোমরা 

এস এস এস আজ ছিঁড়ে ফেলো যত বন্ধন
বিজয়ী কৃষক, বিপ্লবী অভিনন্দন ! 

  অসাধারণ এক কবিতার উপহার, কৃষকদের লড়াই আর তার জয়কে স্মরণ করতে। আমরা সাময়িক ভুলে থাকি ঠিকই, তবে ফিরে- ফিরে যাই এই মন্দাক্রান্তা কবিদের কাছেই। বুঝি আপনজনেরা বুকখুলে দাঁড়িয়ে আছে। 

  ইতিহাসের একবার ছোট পুনরাবৃত্তি না করলে হয় না আর তার নিরিখে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানও প্রাসঙ্গিক। একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখি, মাত্র একবছর আগেকার। ২৯-শে নভেম্বর, ২০২০ সর্বভারতীয় সংবাদপত্রের পাতাগুলি থেকে যে খবর দেখে পিলে চমকে দিয়েছিল শক্তিশালী শাসক দলকে। শাসকের ভক্তরা এতদিন পরাক্রমশালী ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে এসেছেন, জানা নেই জন্ম আর মৃত্যুর মতন পৃথিবীতে কেউ অনিবার্য নয়, পতন বলে একটি শব্দ আছে। অত বড় ৩০০ বছরের মোঘল সাম্রাজ্যেরও কালের নিয়মে পতন হয়েছিল । সেদিনের খবরগুলি ছিল---- 

  দিল্লিতে ঢোকার অপেক্ষায় সিংঘু সীমান্তে হাজার হাজার কৃষক। গত প্রায় তিন-চারদিন ধরে ভারতের রাজধানী দিল্লির উত্তরপ্রান্তে এক বিশাল এলাকা কার্যত পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে আসা হাজার হাজার কৃষকের কব্জায়। 

  নিজেদের ট্রাক্টর ও ট্রলিতে বেশ কয়েক মাসের রেশন  নিয়ে, খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে শীতের রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিয়েই তারা রওনা দিয়েছিলেন দিল্লির পথে - আর এখন রাজধানীর 'লাইফলাইন' জাতীয় সড়ক ৪৪ কার্যত তাদেরই দখলে। 

  দিল্লির বুকে অবস্থানরত এই হাজার হাজার কৃষক কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া আগাম আলোচনার প্রস্তাবও এদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন। 

  সম্প্রতি পার্লামেন্টে পাস হওয়া তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তারা তুমুল আন্দোলন শুরু করছেন।পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে আসা এই অসংখ্য কৃষক দিল্লিতে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখায় রাজধানীর একটা বিস্তীর্ণ অংশে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আরও বহু কৃষক দিল্লিতে ঢোকার চেষ্টায় সীমান্তে অপেক্ষা করছেন। 

  সেদিনের সেই আন্দোলনের ঢেউ অন্যকিছুর ইঙ্গিত করেছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাম আন্দোলন ও সমর্থক এবং বামছাত্র ইউনিয়নের নেতানেত্রীদের দেখা গেলেও , যে কৃষক আন্দোলনের ওপর ভর করে, জমি আন্দোলনের ওপর ভর করে তৃণমূল সরকারের পশ্চিমবঙ্গের মসনদ দখল, তাদের কিন্তু সেভাবে এই আন্দোলনে পাওয়া যায়নি। বরঞ্চ গণআন্দোলনের ভিত্তিভূমি এই পশ্চিমবঙ্গ আজ দমনপীড়নে আন্দোলনবিহীন। আজ এখানে বড় মাপের আন্দোলন হয় না। বামেরাও দীর্ঘদিন ক্ষমতার অলিন্দে থেকে সংগ্রাম ভুলে গিয়েছে, নইলে একজন সামান্য ছিঁচকে চোর আর পকেটমারের বুকে পুলিশ তার পায়ের বুট ঘষেও পার পেয়ে যায়। আমরা এখন চিন্তাশূন্য ভোঁতামাথা, আমরা বিকিয়ে যাওয়া বিবেক। আমাদের ঢেউ ওঠে যত ভিক্ষের দুয়ারে আর আমরা গাই-- এই বেশ ভালো আছি। আজকের সংগ্রামী জয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবে এটুকু না বললে নয়। ফিরে আসি তিন কৃষিবিলে।


  শিখ ধর্মগুরু গুরু নানকের জন্মজয়ন্তীতে এক ঐতিহাসিক বিরাট সিদ্ধান্ত মোদি সরকারের। প্রায় এক বছরের কৃষক আন্দোলনের পর সিদ্ধন্ত বদল করল কেন্দ্রীয় সরকার,  তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজী। বিতর্কিত এই তিনটি কৃষি আইন প্রকাশ্যে আসার পর থেকে দেশ জুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয়  কৃষি আইনের বিরোধিতা করে দেশ জুড়ে কৃষকরা বিক্ষোভে সামিল হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও তাদের এই আন্দোলন জারি রেখেছেন কৃষকরা , চলতি বছরের প্রায় শেষ কিনারায় এসে পৌঁছেছে সকলে এবং আগামি বছর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। এরই মাঝে হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রী।  এদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ক্ষমা চেয়ে বলেন, 'হয়ত আমাদেরও কিছু ত্রুটি ছিল। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল। আমাদের দুঃখ যে কৃষি আইনের সুফলের কথা কিছু কৃষককে আমরা বোঝাতে পারিনি। তবে এখন সময়টা কাউকে দোষারোপ করার নয়। আসুন, সব আবার নতুন করে শুরু করা যাক।'


কী ছিল এই বিতর্কিত কৃষি আইনে? কেন এই সংঘবদ্ধ আন্দোলন? 

* ফারমার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট- ২০২০: এই আইন অনুসারে, বেসরকারি সংস্থা বা কোনো বড় ব্যবসায়ী চাইলে সরাসরি চাষির কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য কিনতে পারেন যার পিছনে সরকারের যুক্তি (Govt's Logic) ছিল এতে কৃষকরা বাজারের সর্বোচ্চ মূল্য পাবেন, অন্যদিকে কৃষকদের দাবি (Farmer's logic) ছিল এতে আদতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়িক সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। 

* ফারমার্স এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসিওরান্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস ((এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) অ্যাক্ট- ২০২০: এই আইন অনুসারে, বেসরকারি সংস্থা চাইলে কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সেখানে কৃষিজ পণ্য ফলাতে পারবেন না। যার পিছনে সরকারের যুক্তি (Govt's Logic) ছিল এর ফলে দেশীয় কৃষিজ পণ্যের চাহিদা বাড়বে, অন্যদিকে কৃষকদের দাবি (Farmer's logic) ছিল এর ফলে তাঁদের জমির উপর থেকে তাঁদের অধিকার হারাবে।  

* এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (সংশোধিত) বা অত্যাবশ্যক পণ্য আইন: এই আইন অনুসারে, চাল, ডাল, গম ইত্যাদি অত্যাবশকীয় পণ্য সামগ্রী মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বলে কিছু থাকবে না যার পিছনে সরকারের যুক্তি (Govt's Logic)  ছিল যে এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, অন্যদিকে কৃষকদের দাবি (Farmer's logic) ছিল এর ফলে অত্যাবশকীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চলে যাবে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে।  

  যদিও এর পিছনে রাজনৈতিক সমীকরণ দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বাইশের নির্বাচনের আগেই এহেন সিদ্ধান্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। তারপরেই ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের (Indian Farmer's Union) নেতা রাকেশ টিকাইত (Rakesh Tikait) জানিয়েছেন যে, 'আন্দোলন এখনই থামবে না। সংসদে কৃষি আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। 

  প্রধানমন্ত্রীর এ হেন জনগণের সামনে প্রত্যাহার ঘোষণা, আশা করছি অবশ্যই সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে প্রত্যাহৃত হবে। তবে রাজনীতির বেনোজলে ঢুকে কিছু ছদ্মবেশী আন্দোলনের আগাপাছতলায় না থেকেও মাছ ধরতে চাইবেন। সাধু সাবধান এখানে। এরাই মানুষের হৃদপিন্ডটা বেকেঁচুড়ে দিয়ে যায়। 

  অভিনন্দন রইলো সংগ্রামরত ভারতের সমস্ত কৃষকদের জন্য আর শ্রদ্ধায় মাথানত করি আমাদের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে খোলা আকাশের নিচে রোদ বৃষ্টি ঝড় জল গায়ে মাখা পরিশ্রমরত এবং আন্দোলন চলাকালীন মৃত অসংখ্য কৃষকদের জন্য। যাদের প্রাণের বিনিময়ে আজকের এই জয়। অমর রহে স্বাধীন ভারতের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন।


কৃতজ্ঞতা--- আন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য সমূহ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments