জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব--(২৮)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব--(২৮)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও দর্শন


সুইচ ফরাসি দার্শনিকে Jean Jacques Rousseau (খ্রিঃ ১৭১২-১৭৭৮)-র মতে মানুষ তার নিজস্ব প্রকৃতির নিয়মেই ভালো ও নিষ্পাপ। সমাজই তাকে খারাপ করে তোলে। সমাজ গঠনের আগে মানুষ ছিল সুখী আনন্দপ্রিয় এবং স্বাধীনচেতা। ব্যক্তিসম্পত্তির অধিকার কায়েম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে হয়ে উঠল স্বাধীনতা সুখ আনন্দপ্রিয়তা হারিয়ে স্বার্থপর লোভী ব্যক্তি। রুশোর প্রত্যয়, "Man was born free but he is everywhere in chains." তার বিশ্বাস, সিভিল সোসাইটি যদি সত্যিই সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত থেকে মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে এবং সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে, তবে মানুষ তার স্বাধীনতাস্পৃহাকে বাড়িয়ে তুলতে উদ্যোগী হতে পারে। মানুষ এই সাহায্য পেলে তাকে আর নিজের প্রকৃতিগত স্বাধীনতাস্পৃহার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে থাকতে হয় না। তখন সে রাজনৈতিক স্বাধীনতাও লাভ করে উদ্যোগী হতে পারে, যা তার কাছে আত্মনিয়ন্ত্রণের কারণ হয়ে ওঠে এবং সে তখন অনেকটাই "General will" দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও রুশোর মতামত মানুষের স্বাধীনতা বা স্বাধীন সত্তার ওপর অপরিসীম গুরুত্ব পেয়েছিল। 


  ফরাসি বিপ্লবের (খ্রিঃ ১৭৮৭-১৭৯৯) মধ্যবর্তী সময়ে খ্রিঃ ১৮৯৩ যে Committee of public safety তৈরি হয়েছিল তার উদ্দেশ্য ছিল, ফ্রান্সে যে "Region of Terror" চলছিল তা প্রতিহত করা। এর পিছনে ছিল Jacobins (Jacobin Club) নামে রাজনৈতিক দল (খ্রিঃ ১৭৮৯)। এই রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য ছিল, চরমপন্থী হয়ে নিপীড়ন অত্যাচার করা। এই রাজনৈতিক দলটি ফরাসি বিপ্লবেরই দলভুক্ত। ফরাসি বিপ্লবের সুফলগুলিকে রক্ষা করার জন্যেই অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে খর্ব করা বা দলিত করার উদ্দেশ্য ছিল এই দলের। যদিও ১৭৯২ খ্রিঃ-এ রাজতন্ত্রকে বিনাশ বা উৎখাত করার জন্য এই দল সরাসরি যুক্ত ছিল না। এই দল পরে নাম পরিবর্তন করে  এবং Society of the Jacobins, Friends of Liberty and Equality নামে প্রসিদ্ধি পায়। ১৭৯৩ খ্রিঃ এই ক্লাবের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮,০০০ এবং পরে সদস্যসংখ্যা ৫০,০০০ হয়। এই জ্যাকবিনরা  Region of Terror" সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে এর তুলনা করা যায় কি? পরবর্তীকালে এই ক্লাবকে বেআইনি ঘোষণা করে দমন করা হয়, যদিও কিছু সংখ্যায় এই ক্লাব ১৮০০ শতাব্দি পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল। 


  প্রতিটি আন্দোলন বা বিপ্লবের পেছনে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ প্রকট হয়ে ওঠে তার অন্যতম উদাহরণ ফরাসি বিপ্লব। এই ফরাসি বিপ্লবকে ইন্ধন জুগিয়েছিল French And Indian War (খ্রিঃ ১৭৬৩) এবং American Revolution or United States War of Independence (খ্রিঃ ১৭৭৫-১৭৮৩)। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও অধিকার নিয়ে ১৭৫৪-১৭৬৩ খ্রিঃ পর্যন্ত French and Indian War চলেছিল, যা Seven year's war নামে আজও প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।এর আগেও ব্রিটিশদের আধিপত্য বিস্তারের কারণে যে যুদ্ধগুলো ঘটেছিল তারও সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কম ছিল না। King Williams War (খ্রিঃ ১৬৮৯-৯৭);Queen Annes' war (খ্রিঃ ১৭০২-১৭১৩); King George's war (খ্রিঃ ১৭৪৪-১৭৪৮) তার উদাহরণ। উত্তর আমেরিকার ওহিও নদীর (Ohio River) উপত্যকার অংশবিশেষ ব্রিটিশ অথবা ফরাসিদের অংশ- এই বিবাদ থেকে French Indian War শুরু হয়েছিল । এছাড়াও বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, উত্তর আমেরিকায় কোন জাতীয় সংস্কৃতি প্রাধান্য পাবে? এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশের আধিপত্য থাকলেও ফরাসিদের বাণিজ্যিক লেনদেন বিপুলভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। ফরাসিরা ১৭৫৪ খ্রিঃ ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধে পরাজিত করে শুধু নয়, কর্নেল জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে যুদ্ধবাজ Colonial Militia দের ও দমন করা হয়। খ্রিঃ ১৭৬৩ চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্স উত্তর আমেরিকার আধিপত্য ব্রিটিশদের হাতে ছেড়ে দেয়। 
এই যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়, বহু লোকক্ষয় এবং বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছিল এবং তারা ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিল। অন্যদিকে ব্রিটেন থেকে বিতাড়িত ও ভাগ্যান্বেষণের খোঁজে তেরোটি উপনিবেশ উত্তর আমেরিকার গড়ে উঠেছিল, যা পরে United States of America নাম নেয়, ব্রিটিশ শক্তি এই উপনিবেশগুলির উপর আধিপত্য কায়েম করতে নানা রকমের কর চাপাতে থাকলে উত্তেজিত অধিবাসীগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং ব্রিটেন তাদের দমন করতে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ফ্রান্স উপনিবেশগুলির আন্দোলনে সহায়তা জুগিয়েছিল। ফলে ব্রিটিশ শক্তি আমেরিকার কাছে পরাভূত হয়। ৪ জুলাই ১৭৭৬ খ্রিঃ আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ব্রিটেনকে তা মেনে নিতে হয়। 


  রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে, মানুষের অধিকার খর্ব করতে রাষ্ট্রশক্তি বারবার মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলেছে যুগে যুগে। কারণ মানুষ কখনও বিনা প্রতিবাদে কিছুই মেনে নেয়নি এবং তার অধিকার ও স্বাধীনতাকে খর্ব হতে দেয়নি। এই স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করতে জীবন পর্যন্ত বাজি রেখেছে কখনও এককভাবে, কখন ও সম্মিলিত ভাবে। উগ্র জাতীয়তাবাদ একনায়কতন্ত্রী রাজনৈতিক মতবাদের (Facism) উত্থান ঘটতে দেখা গেছে ইউরোপে। খ্রিঃ ১৯২০ এবং ১৯৩০ খ্রিঃ যে ফ্যাসিজম মাথা চাড়া দিয়েছিল তার পিছনে ছিল ভয়, এই ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারবোধ জাগরণের কারণে। ( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments