জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে /পর্ব-১/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে 
পর্ব-১

রোশেনারা খান


অ্যাই বেবি, এটা কার নাম রে?  স্কুল যাচ্ছিলাম,  আবুকাকা  পথ আটকে প্রশ্ন  করলেন।    আমি ওনার  হাত থেকে  কাগজটা  নিয়ে দেখি,  ওটা আজ আমাদের স্কুলে যে মেয়েদের  'ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই'  নাটক  হবে  তারই  অনুষ্ঠানসূচী।    ছাপার অক্ষরে নিজের  নাম  দেখে  খুশিতে  ডগমগ হয়ে বলি,  এটা  তো  আমার  নাম !  কথাটা শুনেই  আবুকাকা  খেঁকিয়ে  উঠে বললেন,  খুব ভাল,  মুসলমানের  মেয়ে  হয়ে অভিনয় করছিস ?    স্কুলে পড়িস বলে যা খুশি করে  বেড়াবি ?  বংশের নাম  ডোবাবি?  যাচ্ছি  বড়দাকে ( বংশের বড় বলে গ্রামের সবাই  বাবাকে  বড়দা  বলতেন) জিজ্ঞেস করব,  মেয়েকে  নিয়ে  কী  ভেবেছেন ?  আমার আলো ঝলমলে  মুখে  কালি ঢেলে দিয়ে উনি  হন হন  করে বাড়ির  দিকে  হাঁটা দিলেন।    আমি  কিছুক্ষণ  বোবা হয়ে  দাঁড়িয়ে রইলাম।    ভেবে  পেলাম  না  নাটকে  অভিনয়  করে  আমি  কী  অপরাধ  করেছি ?  দাঁড়িয়ে  আছিস  কেন ?  স্কুলে  যাবি না ?  আমাদের  স্কুলের  পিওন  মহিনদার  প্রশ্নে  সম্বিৎ  ফেরে,    হ্যাঁ , যাচ্ছি  তো।    এই  বলে আমিও  স্কুলের দিকে পা বাড়ালাম।    ভেবে  পেলামনা  নাটকে  অভিনয়  করে  আমি কী  অপরাধ  করেছি ?    তবে এটুকু  বুঝলাম  আবুকাকা  কিছু  একটা  গণ্ডগোল  পাকাবেই। 

            সেদিন বাবা স্টেজের পাশেই সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আমাকে বাড়ি  নিয়ে যাওয়ার জন্য।  আমার অভিনয় শেষ হতেই আমাকে বাড়ি নিয়ে চলে আসেন।  কারণটা বুঝতে বাকি থাকেনা।  পরে জানলাম আবুকাকা  বাবাকে বাড়ি বয়ে  রীতিমত শাসিয়ে গেছেন।  বলেছেন, তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করুন।  আপনাদের মেয়ের জন্য পাড়ার সব মেয়ের বদনাম হোক, তা নিশ্চয় চান না?  মেয়েকে  পড়তে পাঠিয়েছেন?  নাকি নাটক করতে  পাঠিয়েছেন? ওর বিয়ে কী করে দেবেন ভেবেছেন?  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব  মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করুন।  না হলে  একাঘরে হয়ে থাকতে হবে।  আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য এই জ্ঞাতি কাকারা কেন জানিনা ভীষণই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।  আমার পড়াশোনার কোনও গুরুত্বই ছিলনা তাঁদের কাছে।  একদিন ক্লাসে আছি, আমাকে জানলা দিয়ে আলিকাকা  ডাকলেন, অ্যাই বেবি শোন।  আমি এই ভেবে বাইরে গেলাম, হয়ত  বাড়ি থেকে কোনও খবর  পাঠিয়েছে।  বাইরে বেরতেই কাকা আমাকে কিছু না বলে, আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে একজন লোককে বললেন, এইযে পাত্রী।  আমি এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ক্লাসে  ফিরে এলাম।  ভীষণ বিরক্ত হলাম, রাগও হল।  কিন্তু এরকম ঘটনা চলতেই লাগল।  বাবা-মা কেউ কিছু বলতে পারতেন না।  তার কারণ বাবার না ছিল গলার  জোর, না ছিল অর্থের জোর।  বাবা সেই কারণেই হয়ত আমকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেননি।  তাই  অনেকটা বাধ্য হয়েই  এইসব মাতব্বরদের কথা শুনতে হত।  তাছাড়া  বাবা-মাও ভাবতেন,  ওরা তো উপকার করারই চেষ্টা করছে।  কন্যাদায়  থেকে মুক্ত তো হতেই হবে।  ভেবে পেতাম না কন্যাকে কেন 'দায়' বলা হয়?  কেন ছেলেদের স্কুলে পাঠানো হয়  আর মেয়েদের দিয়ে ঘরেরকাজ করানো  হয়!     
              
    সেই ষাটের দশকে আমি ছাড়া কোনও মুসলিম মেয়ে হাইস্কুলে পড়ত না।  মায়ের কাছে শুনেছি, ছোট ঠাকুরদার ছোট মেয়ে ডলিপিসিকে হাইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল।  কিন্থু দাদারা কেউ বোনকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যেতে চাইত না।  তাই শেষপর্যন্ত পিসির স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।  পরবর্তী কালে পিসিকেই এর মুল্য চোকাতে হয়।  ডলিপিসির বিয়ে হয়েছিল মেদিনীপুর শহরে এক চাকুরীজীবী পাত্রের সঙ্গে।  এরজন্য ঠাকুরদাকে প্রচুর টাকা, গহনা যৌতুক  দিতে হয়েছিল।  তবুও পিসিকে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতন সহ্য করতে হত। বিধবা শাশুড়ি একা নন, পিসির থেকে বড় অবিবাহিতা দুই ভাগ্নীও(ননদের মেয়ে)  নানাভাবে পিসির  ওপর নির্যাতন  চালাতেন।  সংসারের কর্তৃত্ব ছিল তাঁদের হাতেই।  বিয়ের সময় ঠাকুরদা ওঁদের চাহিদা মত সব গহনা দিয়েছিলেন। তবুও  ঝুমকোর ওপরে বড় ফুল ছিল না বলে আবার একজোড়া কানপাশা বানিয়ে দিতে হয়ে ছিল ভাগ্নীরা খোঁটা দিতেন বলে।  পিসিকে ভাল করে পেটভরে খেতে দিত না।  কাকারা মেদিনীপুর কলেজে পড়তেন, বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে শাশুড়ি বলতেন,  'বাহারকা আদমি আয়া'। চাকুরিরত অবস্থায় পিসেমশাই মারা গেলে, শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায়  চাকুরিটা পিসির বড়ছেলেকে দেওয়া হয়।  ছেলে চাকুরি  পাওয়ার পর বিয়ে করে  অন্যত্র বাড়ি করে চলে যায়।

    বিয়ের উপদ্রব চলতেই লাগল।  মা আমার বিষয়ে খুব  সাবধানী ছিলেন।  পড়ে গিয়ে যদি হাত-পা ভেঙ্গে যায় বা ছড়ে যায়?  তাই বাড়ির বাইরে খেলতে যেতে দিতেন না (তবুও হাত ভেঙ্গেছিলাম, সে কাহিনীতে পরে আসব)।  উঠোনে এক্কাদোক্কা আর চিলেকোঠায় পুতুল খেলতাম।  এক বিকেলে সঙ্গীদের নিয়ে পুতুল খেলছিলাম।  মা ডাকাতে নেমে আসি।  চুল আঁচড়ে একটা ভাল ফ্রক পরিয়ে দিয়ে মা বললেন, বৈঠকখানায় এক ভদ্রলোক  তোর বাবার সঙ্গে  গল্প করছেন,  দেখা করে আয়।  যা জিজ্ঞেস করবেন, তার ঠিক ঠাক জবাব দিবি।

আমি গিয়ে দেখলাম একজন কালো মোটামত লোক বাবার সঙ্গে গল্প করছেন।  বাবা  আমাকে ইশারায় সালাম করতে বললেন।  দুজনকে সালাম করে উঠে  দাঁড়াতেই ভদ্রলোক কিছু জিজ্ঞেস না করে, কাগজে আমার নামঠিকানা লিখে দিতে বললেন।  আমি তাই  করলাম।  কী হল সেদিন কিছু বুঝলাম না।  টের পেলাম পরদিন সকালে।  ভদ্রলোকের ছেলে আমাকে দেখতে আসবে।  তাই সকাল থেকে রান্নার তোড়জোড় চলছে।  ইতিমধ্যে ছেলের বিষয়ে যা জানার আমি তা জেনে গেছি।  মনে মনে ঠিক করলাম, ওর সামনে আমি যাব না।  লেখাপড়া জানেনা, ওকি আমার বর হবে?  আমার বর অফিস যাবে, আমি  তারজন্য রান্না করে রাখব, বিকেলে সেজেগুজে অপেক্ষা করব,  রবিবার বেড়াতে যাব,  সিনেমা দেখব।  এ তো কিছুই পারবে না!  আসলে বই পড়ার ভীষণ নেশা ছিল।  ছোটদের বই, বড়দের বই, এসব বুঝতাম না।  যা নাগালে পেতাম, তাই গোগ্রাসে গিলতাম।  মেজকাকাদের বাড়িতে নিয়মিত সিনেমা পত্রিকা আসত।  লুকিয়ে সেইসব বই পড়ে শহুরে সুখী জীবনের একটা ছবি মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গেছল।  সেখানে গ্রামের  অল্প  শিক্ষিত পাত্রকে পছন্দ হবে কেন? টাকা থাকলেই বিয়ে করতে হবে?

      আমি জেদ ধরে বসে রইলাম, কিছুতেই যাবনা।  অনেকেই বোঝাতে এলেন্‌, তোকে বিয়ে করতে হবেনা।  লোক বাড়িতে এসেছে, একবার শুধু দেখা দিয়ে আয়।  বাবা ফিরলে কিছু একটা হতে পারে ধরে  নিয়েই একটা ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে খিল আটকে দিলাম।  আমার কাকাদের পছন্দের পাত্রটি দুপুরের খাওয়া সেরে বাড়ি ফিরে গেল।  আমি তখনও দরজা খুলিনি।  এক সময় মা এসে দরজা খুলতে বললেন। আমি খুলছিনা দেখে মা জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন।  কিছু একটা হয়েছে ভেবে তাড়াতাড়ি দরজার খিল খুলতেই মা একটা হাত ধরে টানতে টানতে নর্দমার কাছে নিয়ে গিয়ে আমার গলায় আঙ্গুল ভরে বমি করানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।  -কী খেয়েছিস বল? মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মায়ের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে।  আমি বললাম- কিছু খাইনি! মা কিছু ফল দেখিয়ে  বললেন, এগুলো  কোথা থেকে এলো? এখানে লতানো গাছে একধরনের বিষাক্ত ফল হয়, দেখতে অনেকটা এই রকম।  মা ভেবেছে আমি বিষ খেয়েছি।  মায়ের সেই ভয়াতুর ও অসহায় মুখ আজও ভুলতে পারিনি।  এদিকে আমার এই আচরণ ওই কাকাদের খেপিয়ে তোলে। আবুকাকা  বাড়ি এসে মাকে শোনালেন আপনারা  খুব ভুল করলেন, বেশি লেখাপড়া জানেনা তাতে তো বেবিরই সুবিধা হত।  সংসারে সবার উপরে ছড়ি ঘোরাতে পারত।  সেই বয়সেই কিছুটা হলেও বুঝেছিলাম, গরিব বাবা মায়ের কাছে ‘কন্যাদায়’ কী ভয়ঙ্কর জিনিস। 
(ক্রমশ) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ শুরু। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete