অণু উপন্যাস
অ্যাপের নাম বাবাজী
বাসুদেব গুপ্ত
১ম পর্ব
ধুর কিছুতেই পয়সা হচ্ছে না। আর পয়সা না থাকলে তুমি কেউ না। একটা ফ্যা- ফ্যা-
-ফ্যাতাড়ু?
-ফ্যালনা, ফালতু। ফ দিয়ে শুরু মানেই একটা যাচ্ছেতাই কিছু। ফেল।
থানার পুলিশরা বাড়ীটা দখল করেছিল দু বছর। একমাত্র কমিউনিটি হল। ওদের নতুন পুলিশ লাইন তৈরী হচ্ছিল। যতদিন যাচ্ছে ক্রাইম বেড়েই চলেছে নতুন শহরে। করোনা লকডাউন এসবের মাঝে কখন যে ওরা চলে গেছে। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাল দিয়ে ঘেরা কালো গাড়ীগুলো আর নেই। থেমে গেছে যেতে যেতে শোনা ওয়ারলেসের কথা। আজকাল তেমন আন্দোলন মিছিল আর হয় না। বছরে একটা কি দুটো। পুলিশ ফোর্স হোআইটকলার কাজ বেশি করে। মোবাইল ট্র্যাকিং, কল মনিটরিং, সিসিটিভির ফুটেজ চেক এইসব। থানার পাশে ঘুরঘুর করা গুন্ডা চোর খুনীদের আর দেখা যায় না। যারা আসে তারা গাড়ী থেকে নামে। সুবেশ। মার্জিত হিন্দী ভাষায় কথা বলে। মাঝে মাঝে ইংরেজীর টাকনা।
থানা উঠে গেছে। কিন্তু নীচে ফুটপাথে আধাঝুপড়ি চায়ের স্টল থেকে গেছে। একটা ছোট্ট আউটপোস্ট এখনও আছে। দু একজন আসে। তাদের মেন অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
চায়ের দোকানে একজন দুজন সাহস করে ব’সে । করোনা কমছে। কিন্তু লোকের ভয় তেমন যায় নি। রতু যাচ্ছিল ইস্ত্রীওলার কাছে। দেখলো ম্যারাথনদা বসে আছে। আসল নাম রূপম। ৩৫ এর ধারে কাছে বয়স। কি একটা ম্যারাথন হয়েছিলো কলকাতায় তাতে ও দৌড়িয়েছিল। কিন্তু মাঝ রাস্তায় গলা গেল শুকিয়ে। চা না খেয়ে থাকতে পারেনা। দৌড়তে দৌড়তে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চাওলার সংগে খুচরো নিয়ে ঝগড়া। দৌড় আর শেষ হয় নি। নামটা থেকে গেছে। প্রতি বছর পাড়ার স্পোর্টস করানো এখন ওর বাৎসরিক দায়। সেই সূত্রে রতুকে চেনা। রতু পাড়ার বডি বিল্ডার, এথলিট সব। প্রতি বছর ১০০ মিটারে ফার্স্ট হওয়া বাঁধা।
বসতেই, ‘চা খাবি তো। কথা আছে বোস।‘
রতুর অত কিছু তাড়া নেই। বসল। বসতেই এই দার্শনিক কথা।
-কেন তোমার মোবাইলের দোকানটা আর চলছে না? তারপর মাঝে ইন্টারনেটের লাইন দিচ্ছিলে। তার তো ভালোই ডিমান্ড।
-ধুর। কিস্যু হয় না। সবার সিম হয়ে গেছে। আর মোবাইল রিচার্জ এখন সবাই অনলাইনে করছে। বন্ধ করে দেবো।
ম্যারাথনদার বাবার কিছু টাকা আছে। দোতলা বড় বাড়ী নীচে দোকান। চলে যায় দিব্যি। তাই নানারকম ব্যবসার কথা মাথায় ঘুরতেই থাকে।
-তো কি ভাবছো এখন। নতুন কিছু? শুনেছি বাড়ী বাড়ী গিয়ে চুলকাটার সার্ভিস খুব চলছে। দেখ না হাবিবের মত চুল কাটার একটা কোম্পানী…
ম্যরাথনদার চোখটা কটমট করতে দেখে রতু থতমত খেয়ে যায়। ধীরে ধীরে ম্যারাথনদার চোখটা নরম ও করুণ হয়। বলে,
-শেষে ভটচাজ্জির ছেলেকে দিয়ে তুই চুল কাটাবি! যাক শোন একটা জিনিষ মাথায় এসেছে। সারাক্ষণ টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে। তুই বিট কয়েনের নাম শুনেছিস?
রতু শুনে মোটেই অবাক হলো না। টি টোয়েন্টি দেখতে দেখতে রোজ এই নামটা শুনে শুনে কান পচে গেছে। শুধু কি বিটকয়েন। আরও হাজারো কয়েন। রণবীর সিং মাঝে মাঝেই চেলাদের নিয়ে এসে বসছে আর শুনিয়ে যাচ্ছে ‘কুছতো বদলেগা’। ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে ঠিক কি বদলাবে বোঝা শক্ত। হাতে ধরা জলের বোতলের রং বড়জোর পাল্টাতে পারে।
Bitcoin, Ethereum, Cardano, Polkadot, FileCoin, Helium এমনকি গাঁজা কয়েন আরো কত হাজার রকম। রতু কিছু খবর রাখে। যাকে বলে এখন ডিজিট্যালি শিক্ষিত পাবলিক।
শুনে শুনে রতুরও খুব ইচ্ছে একটা কেনে। কিন্তু এতো যে সে কয়েন না। কোন কোনটার দাম ১০ টাকা আবার কোনটার দাম ৪০ লাখ টাকা। তাও নাকি হাতে দেবে না। জমা থাকবে। গর্বের সঙ্গেই বললো,
-কি ভাবো আমাকে রূপমদা। সব খবর রাখি। কেন, তুমি কি বিটকয়েনের ব্যবসা করবে না কি?
-করতেও পারি। আমার হাতে এই যে বুধের রেখাটা দেখছিস, এটা হলো ব্যবসার লাইন। দেখছিস এটা এসে কেমন বাঁক খেতে খেতে জয়ন করছে লাইফলাইনে? একটা কিছু হবেই হবে এবার। ভাগ্য তো চিরকাল একরকম যায় না। মেরা নম্বর ভি আনেবালা।
রতু মনে মনে হাসি ও সিমপ্যাথী চেপে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
-কিন্তু তার আগে ভালো করে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। এবারে রূপমের রিয়েল দৌড় শুরু হতে চলেছে।
একটা বেজোস বেজোস ভাব করে চায়ে চুমুক দেয় ম্যারাথনদা।
-আচ্ছা ঐ ইকনমিস্ট প্রোফেসর তোদের পাড়ায় থাকে না? কি যেন নাম, বেদান্ত গুহরায়।
-থাকে না, তবে ওনার পৈত্রিক বাড়ী। মাঝে মাঝে আসেন খোলা হাওয়ায় ঘুরে বাস করে যান কদিন আর স্ট্র্যান্ডের ধারে সন্ধেবেলা বেড়ান। কিন্তু উনি তো বিশাল মানুষ। সরকারের পরামর্শদাতা। আমরা তো হরিদাস পাল।
-তোর মত ঘরকুনো ভীতু কি যে বলে ইনিসিয়েটিভহীন লোকের জন্যই বঙ্গবাসীরা আজ বং হয়ে গেছে বুঝলি।
ম্যারাথনদা একচিু বিরক্ত হয়ে চুমুক দিয়ে হুস করে একেবারে শেষ করে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করেন কিছুক্ষণ। যখন চোখ খোলে, তখন একটা দৈবী হাসি হেসে রতুর চোখে চোখ রেখে বলেন,
-বল তো এটা কিসের যুগ?
-মানে কিসের যুগ মানে, করোনার? হিন্দুজাগরণের? ও আচ্ছা তুমি বলছ ক্রিপ্টো মানে বিট কয়েনের?
-কল্পনাশক্তি অত কিপটে কেন? বলি শোন এ যুগ হচ্ছে মিডিয়ার। সারাক্ষণ কোটি কোটি লোক কি করছে? মিডিয়া দেখছে, মিডিয়া শুনছে, মিডিয়া যা খাওয়াচ্ছে তাই খাচ্ছে। মিডিয়াকে কেউ না বলতে পারবে না। দেখিস না খেলার মাঠে একবার ক্যামেরার সামনে এলেই ছেলে বুড়ো যুবতী, সম্ভ্রান্ত সুবেশ ভদ্রলোক সবাই কেমন উচ্ছ্বাসে বিস্ফোরিত হোয়ে যায়?
-তা যায় কিন্ত আমাদের তাতে কি?
-ভাবছি আমরাও যদি মিডিয়া হই? আমি সেই ডকুমেন্টারী তোলার ব্যবসা শুরু করেছিলাম মনে আছে? কারখানায় কেমন করে চানাচুর তৈরী হয় তার ডকুমেন্টারী অনেকের পছন্দও হয়েছিল।
-হ্যাঁ অটোওলা আর প্যাসেন্জারের ঝগড়ার ছবি তুলতে গেলে সব অটোওলা এসে তোমার ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছিল তাও জানি।
-তুই কিছু জানিস না। তারপর আমি অটোওলাদের মিছিলের ছবি তুলে ওদের ইউনিয়ন অফিসে পাঠালে ওরা কত খুশি হয়েছিল জানিস? এখনও ওরা ইউনিয়ন অফিসে টাঙ্গিয়ে রেখেছে।
-তা হলে তো ভালোই। ওরা কি ফ্রিতে তোমাকে চড়ায়?
-অনেক প্যাঁক দিয়েছিস। এবারে শোন। আমি একটা নতুন ইউটিউবে চ্যানেল খুলছি। নাম দিয়েছি খিটকেল পাবলিক বিটকেল সমাচার।
-বাঃ দারুণ নাম। তো খবর না বলে সমাচার কেন?
-সমাচার বললে একটা বেশ সর্বভারতীয় ভাব আসে রে। কথাই তো সব।
-তো বেদান্তবাবু কি করবে এর মধ্যে?
-সিম্পল। ইন্টারভিউ দেবেন। বাংলার অর্থনীতি ও বিটকয়েন বিপ্লব।
-বিপ্লব!
-বাংলা হলে বিপ্লবটা অটোম্যাটিক। মায়ের কৃপা। চল উঠি। চ্যানেলটা চালু করি। আমার ভাইপো কত লোকের চ্যানেল করে দিয়েছে। ইউটিউব এক্সপার্ট।
চায়ের দোকানের ছেলেটা একটা ছেঁড়া কাগজে বিল দেয়। দুটো চা ২০ টাকা।
-এত দাম বাড়িয়েছিস! করোনার সুযোগে যে যা পারছে।
স্টোভে পাম্প দিতে দিতে দোকানের মালিক খিঁচিয়ে ওঠে,
-এক ঘণ্টা বসে তো বিট গাজরের গল্প করে গেলেন। এবার থেকে চেয়ারের ভাড়াটাও বিল করব।
-মানে তুমি আমাদের কথা আড়ি পেতে শুনছিলে?
রতু করোনা বিধি উল্লঙ্ঘন করে হাত ধরে টানে,
-আবার রূপমদা? চা ওলার সংগে! আপনার কি প্রবলেম বলুন তো?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যারাথনদা থেমে গিয়ে বলেন
-চল। কাজ আছে অনেক। বিটগাজর সরি বিটকয়েন আমি ছাড়ছি না। এস্পার নয় ওস্পার।
ক্রমশঃ...
0 Comments