শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত
পর্ব-১১
সুদর্শন নন্দী
১৮৮৩, ২১শে জুলাই । ৺খেলাৎ ঘোষের বাটীতে শুভাগমন হয়েছে ঠাকুরের। ঠাকুর সর্বধর্ম-সমন্বয়ের কথা বলছেন এক বৈষ্ণবভক্ত ও অন্যান্য ভক্তদের।
শ্রীরামকৃষ্ণ উপমা দিয়ে শুরু করলেন। সর্বধর্ম-সমন্বয় বোঝাতে শোনালেন পুকুরে জলের উপমা। বললেন— আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল — এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লা, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে — একঘাটের লোক বলছে জল, আর-একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর-একঘাটের লোক বলছে পানি — হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, — কিন্তু বস্তু এক। মত — পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, — ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।
পরের দিন। ব্রহ্ম কি সে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঠাকুর এবার উপমা দেবেন চার বন্ধুর পাঁচিলে ওঠা নিয়ে। আর আমরা তো জানি যে ঠাকুরের উপমা অনুধাবন করলেই ঐশ্বরিক বিষয় জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায়। ঠাকুর বললেন, ব্রহ্ম কি, তা মুখে বলা যায় না। যার হয় সে খবর দিতে পারে না। একটা কথা আছে, কালাপানিতে জাহাজ গেলে আর ফিরে না। চার বন্ধু ভ্রমণ করতে করতে পাঁচিলে ঘেরা একটা জায়গা দেখতে পেলে। খুব উঁচু পাঁচিল। ভিতরে কি আছে দেখবার জন্য সকলে বড় উৎসুক হল। পাঁচিল বেয়ে একজন উঠল। উঁকি মেরে যা দেখলে, তাতে অবাক হয়ে ‘হা হা হা হা’ বলে ভিতরে পড়ে গেল। আর কোন খবর দিল না। যে-ই উঠে সে-ই ‘হা হা হা হা’ করে পড়ে যায়। তখন খবর আর কে দেবে?”
১৮৮৩, ১৯শে অগস্ট। সচ্চিদানন্দলাভের উপায়, জ্ঞানী ও ভক্তদের প্রভেদ এসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঠাকুর বললেন, জ্ঞানীর ভিতর একটানা গঙ্গা বহিতে থাকে। তার পক্ষে সব স্বপ্নবৎ। সে সর্বদা স্ব-স্বরূপে থাকে। ভক্তের ভিতর একটানা নয়, জোয়ার-ভাটা হয়। হাসে-কাঁদে, নাচে গায়। ভক্ত তাঁর সঙ্গে বিলাস করতে ভালবাসে — কখন সাঁতার দেয়, কখন ডুবে, কখন উঠে — যেমন জলের ভিতর বরফ ‘টাপুর-টুপুর’ ‘টাপুর-টুপুর’ করে।”
পরের দিন ১৮৮৩, ২০শে অগস্ট। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে। ব্রহ্মদর্শনের লক্ষণ ,ধ্যানযোগ এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
মণিমোহন পরব্রহ্ম কি তাই সর্বদা চিন্তা করেন। ঠাকুর তাকে লক্ষ্য করে বললেন — ব্রহ্ম আকাশবৎ। ব্রহ্মের ভিতর বিকার নাই। যেমন অগ্নির কোন রঙই নাই। তবে শক্তিতে তিনি নানা হয়েছেন। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ — এই তিনগুণ শক্তিরই গুণ। আগুনে যদি সাদা রঙ ফেলে দাও সাদা দেখাবে। যদি লাল রঙ ফেলে দাও লাল দেখাবে। যদি কালো রঙ ফেলে দাও তবে আগুন কালো দেখাবে। ব্রহ্ম — সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিনগুণের অতীত। তিনি যে কি, মুখে বলা যায় না। তিনি বাক্যের অতীত। নেতি নেতি করে করে যা বাকি থাকে, আর যেখানে আনন্দ সেই ব্রহ্ম।
এবার বিষয়টি সহজবোধ্য করতে ভক্তদের একটি গল্প বললেন ঠাকুর।
একটি মেয়ের স্বামী এসেছে; অন্য অন্য সমবয়স্ক ছোকরাদের সাথে বাইরের ঘরে বসেছে। এদিকে ওই মেয়েটি ও তার সমবয়স্কা মেয়েরা জানালা দিয়ে দেখছে। তারা বরটিকে চেনে না — ওই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করছে, ওইটি কি তোর বর? তখন সে একটু হেসে বলছে, না। আর একজনকে দেখিয়ে বলছে, ওইটি কি তোর বর? সে আবার বলছে, না। আবার একজনকে দেখিয়ে বলছে, ওইটি কি তোর বর? সে আবার বলছে, না। শেষে তার স্বামীকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করলে, ওইটি তোর বর? তখন সে হাঁও বললে না, নাও বললে না — কেবল একটু ফিক্ করে হেসে চুপ করে রইল। তখন সমবয়স্কারা বুঝলে যে, ওইটিই তার স্বামী। যেখানে ঠিক ব্রহ্মজ্ঞান সেখানে চুপ।
এ যেন চিরদিন মনে থাকার মতোই উপমা।
১৮৮৩, ২২শে সেপ্টম্বর। ঠাকুর ব্রহ্ম ও শক্তির অভেদত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন। উপমা দিলেন সাপ আর দুধের। ভক্তদের বোঝানোর জন্য, ঈশ্বর লাভের জন্য, আধ্যাত্মিক উত্তরণের জন্য ঠাকুর শুকনো কথার উপর শুধু ভরসা রাখতেন না।উপমার সাহায্যে সহজ সরলভাবে ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে দিতেন ঈশ্বরীয় কথনের সারবস্তু।
ঠাকুর বললেন-ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। লঙ্কা থেকে ফিরে আসবার পর হনুমান রামকে স্তব করছেন; বলছেন, হে রাম, তুমিই পরব্রহ্ম, আর সীতা তোমার শক্তি। কিন্তু তোমরা দুজনে অভেদ। যেমন সর্প ও তার তির্যকগতি — সাপের মতো গতি ভাবতে গেলেই সাপকে ভাবতে হবে; আর সাপকে ভাবলেই সাপের গতি ভাবতে হয়। দুগ্ধ ভাবলেই দুধের বর্ণ ভাবতে হয়, ধবলত্ব। দুধের মতো সাদা অর্থাৎ ধবলত্ব ভাবতে গেলেই দুধকে ভাবতে হয়। জলের হিমশক্তি ভাবলেই জলকে ভাবতে হয়, আবার জলকে ভাবলেই জলের হিমশক্তিকে ভাবতে হয়।
এই আদ্যাশক্তি বা মহামায়া ব্রহ্মকে আবরণ করে রেখেছে। আবরণ গেলেই ‘যা ছিলুম’, ‘তাই হলুম’। ‘আমিই তুমি’ ‘তুমিই আমি’!
১৮৮৩, ২৬শে সেপ্টম্বর। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুদের ো অন্যনানু ভক্তদের সাথে কথা বলছেন।
ঈশ্বরকে কি জানা যায়? ঠাকুর উত্তর দিতে টেনে আনলেন বিড়াল ছানার উপমা। বললেন— তাঁকে কে জানবে? আমি জানবার চেষ্টাও করি না! আমি কেবল মা বলে ডাকি! মা যা করেন। তাঁর ইচ্ছা হয় জানাবেন, না ইচ্ছা হয়, নাই বা জানাবেন। আমার বিড়াল ছাঁর স্বভাব। বিড়াল ছাঁ কেবল মিউ মিউ করে ডাকে। তারপর মা যেখানে রাখে — কখনও হেঁসেলে রাখছে, কখনও বাবুদের বিছানায়। ছোটছেলে মাকে চায়। মার কত ঐশ্বর্য সে জানে না! জানতে চায়ও না। সে জানে, আমার মা আছে, আমার ভাবনা কি? চাকরানীর ছেলেও জানে, আমার মা আছে। বাবুর ছেলের সঙ্গে যদি ঝগড়া হয়, তা বলে, “আমি মাকে বলে দেব! আমার মা আছে!” আমারও সন্তানভাব।
১৮৮৩, ২৬শে নভেম্বর। ঠাকুর গৃহস্থের প্রতি উপদেশ দিচ্ছেন। জনক রাজার উপমা টানলেন।
সমবেত ব্রাহ্মভক্তগণকে সম্বোধন করে তিনি বলছেন, “নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করা কঠিন। প্রতাপ বলেছিল, মহাশয়, আমাদের জনক রাজার মত। জনক নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করেছিলেন, আমরাও তাই করব। আমি বললুম, মনে করলেই কি জনক রাজা হওয়া যায়! জনক রাজা কত তপস্যা করে জ্ঞানলাভ করেছিলেন, হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে অনেক বৎসর ঘোরতর তপস্যা করে তবে সংসারে ফিরে গিছলেন।
তবে সংসারীর কি উপায় নাই? — হাঁ অবশ্য আছে। দিন কতক নির্জনে সাধন করতে হয়। তবে ভক্তিলাভ হয়, জ্ঞানলাভ হয়; তারপর গিয়ে সংসার কর, দোষ নাই। যখন নির্জনে সাধন করবে, সংসার থেকে একেবারে তফাতে যাবে। তখন যেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা, ভাই, ভগিনী, আত্মীয়-কুটুম্ব কেহ কাছে না থাকে। নির্জনে সাধনের সময় ভাববে, আমার কেউ নাই; ঈশ্বরই আমার সর্বস্ব। আর কেঁদে কেঁদে তাঁর কাছে জ্ঞান-ভক্তির জন্য প্রার্থনা করবে।......
হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে হাতে আঠা লাগে না। চোর চোর যদি খেল বুড়ি ছুঁয়ে ফেললে আর ভয় নাই। একবার পরশমণিকে ছুঁয়ে সোনা হও, সোনা হবার পর হাজার বৎসর যদি মাটিতে পোঁতা থাক, মাটি থেকে তোলবার সময় সেই সোনাই থাকবে।
বিষয়টি ভক্তদের কাছে জলের মতো বোঝাতে উপমা গিলেন জল আর দুধের। এমন উপমা কখনো ভোলার নয়। আজীবন হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। বললেন-মনটি দুধের মতো। সেই মনকে যদি সংসার-জলে রাখ, তাহলে দুধেজলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন তোলা হল, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না — সংসার-জলের উপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে।
এই উপমা শোনার পর সংসারীদের আর বিমর্ষ বা সন্দেশের অবকাশ থাকে না যে তারা কিভাবে ইশ্বরের কোলে নিজেদের সপে দিতে।
(ক্রমশঃ)
0 Comments