জ্বলদর্চি

বইমেলার শ্রেষ্ঠ উপহার /প্রতীপ বোস

বইমেলার শ্রেষ্ঠ উপহার

প্রতীপ বোস

ভালো বই মানেই ক্লান্ত শ্রান্ত মনে নতুন কল্পনার ঝিলিক। আর বইমেলা হল এক মহা আয়োজন। দেশ-বিদেশের বই একছাতার তলায়। সেবারে বইমেলা যখন শুরু হল তখন সদ্য কলেজ ছেড়ে চাকরিতে ঢুকেছি। বন্ধুরাও সব ছিটকে পড়েছে এদিকওদিক। অগত্যা একাই বেরিয়ে পড়লাম, রোববারের শীতমাখা এক দুপুরে। গিয়ে দেখি ভেতরে ঢোকার লাইন সাপের মতো এঁকেবেঁকে দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে। দীর্ঘ অপেক্ষা তবু স্কুলের কচিকাঁচাদের মুখে হাসি। কলেজের ছেলেমেয়েরা তো সর্বদাই নিজেদের মধ্যে কলবল, খলবল করে ফুটছে।  

        ভেতরের বড় সব প্যাভিলিয়নের মধ্যে একটাতে ঢুকে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। বইমেলার এই এক সুবিধা। নিজের ইচ্ছেমতো বইতে হাত দেওয়া যায়। দেখা পাওয়া যায় বিখ্যাত সব সাহিত্যিকদের। আর লিটল ম্যাগাজিনের স্টল তো এক অন্য দুনিয়া। ওখানে আবেগ কথা বলে ওঠে। কবি, লেখক, লেখিকারা নিজেরাই এগিয়ে দেন সদ্য ছাপা বই।

     হঠাৎ করে নজর গেল সব থেকে ওপরের তাকের দিকে। প্রিয় লেখকের উপন্যাসগুলো পাশাপাশি সাজানো। মনেমনে হিসেব কষছিলাম কোনটা আমার সংগ্রহে আছে, কোনটা নেই। খেয়াল করিনি পাশে দাঁড়ানো মেয়েটিকে। বেচারীরও নজর ছিল ঐ তাকের দিকে। হীলতোলা জুতো পরেও  উঁচু তাকের নাগাল না পেয়ে শেষে বেসামাল হয়ে পড়ল আমার ঘাড়ে। তাকে সামলাতে পারলেও হাতের বইগুলো সব ছিটকে পড়ল মেঝেতে। সলজ্জ মুখে 'সরি' বলে বই উঠিয়ে দিচ্ছিল। দেখলাম কলেজে পড়া একটা ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে।
 
     ওর অনুরোধে বাছাই করা তিনটে বিখ্যাত উপন্যাস হাতে তুলে দিলাম। বলল, " সবকটাই নিতে বলছেন?" গম্ভীর হয়ে বললাম, " আমি এখানের কর্মচারি নই।" 
                   'একটু উষ্ণতার জন্য' বইটা উঠিয়ে আবার জিগ্যেস করল, " এটা কেমন?" তখন বয়সটা কম, বলে দিলাম, " পাহাড় জঙ্গলে এঁকেবেঁকে চলার পথে, স্রোত হারানো নদীর মতো; এ এক প্রেম কাহিনী। গল্পের নায়িকা ঠিক আপনার মতোই সুন্দরী।" দেখলাম নিমেষে মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠল। একপলক আমার দিকে চেয়ে বেণী দুলিয়ে ওর বন্ধুদের মাঝে মিশে গেল।

     কেনাকাটা শেষ করে কাউন্টারে এসে দেখি, উপচে পড়া ভীড় সামলাতে দুই ভদ্রমহিলার হিমশিম অবস্থা। সবে বইগুলো রেখেছি; আবার ধাক্কা খেয়ে পিছনে ফিরে দেখি সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে। দেখামাত্রই একগাল হেসে দিল। দেখলাম ওর বইগুলোর মাঝে আমার দেওয়া তিনটে বইও আছে। ব্যস বিগলিত হয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে মেয়েটিকে এগিয়ে দিলাম। কাউন্টারে বিল করে রাখতে বলে, একপাশে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম।

      ফিরে এসে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অন্যদিকে। বইমেলায় কত যে বইয়ের সম্ভার। দেখেও যেন আশ মেটেনা। হঠাৎ মনে হল সব ঠিকঠাক দিয়েছে তো? প্যাকেট খুলে দেখলাম মেয়েটির জন্য পছন্দ করা বইগুলো এখানে। বুঝলাম অদল-বদল হয়েছে। স্টলে ফিরে ভদ্রমহিলাকে বলতেই বেজায় লজ্জিত হয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। অল্পসময়েই শুনতে পেলাম মাইকের ঘোষণা। কিন্তু বারবার ডাকাডাকি করেও মেয়েটির দেখা পাওয়া গেলনা। সেসময় মোবাইল ফোন ছিলনা। নিজের নাম আর অফিসের নম্বর লিখে রাখলাম প্যাকেটের ওপর।

      নতুন বইতে একটা সুন্দর গন্ধ থাকে। কিছু্ই না পেয়ে ভাবছিলাম সারাদিন শুধু পন্ডশ্রমই হল। বেশ একটা দুঃখের ভাব। হঠাৎ ভেসে উঠল মেয়েটির হাসিভরা মুখ। ব্যস নিমেষে মন খুশিতে ভরে উঠল। কতবার নিজেকে বোঝালাম কেউ একবার তাকিয়ে হাসলেই কিছু হয়ে যায়না। কিন্তু নির্বোধ মন মানতেই চায় না!

      সকালে অফিস পৌঁছে সারাদিন চাতক পাখির মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফোন সবার এল শুধু আমাকেই কেউ ফোন করলনা। এরপর কাজের চাপে মাথায় আর কিছু ছিলনা। বৃহষ্পতিবার বসের রুমে ডাক পড়ল। ঢোকামাত্রই বললেন, " নিন আপনার ফোন।" আমার মনের আকাশে তখন ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখিরা উড়ছে। কিন্তু নিরাশ করে কানে বাজল বইমেলার সেই ভদ্রমহিলার কন্ঠ। বললেন, " মেয়েটি  আপনার বইগুলো ফেরত দিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে। আসবেন নাকি? বসের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম মন দিয়ে টেন্ডার ভরছেন। এসময়ে কথা বললেই খেঁকিয়ে উঠেন। হতাশ হয়ে জানালাম, " রোববার আসছি।"

   বইমেলায় প্যাকেটটা ফিরে পেয়ে দেখি বাহারি কালিতে নাম লেখা, তানিয়া রায়। সাথে ফোন নম্বরও আছে। আর ত্বর সইল না। সোজা ফোন লাগালাম। ভাগ্য ভালো, তানিয়াই তুলল। ধন্যবাদ জানাতেই উচ্ছসিত হয়ে বলল, " আপনার জন্যেও একটা স্পেশাল মেসেজ আছে। আসুন না একদিন বইমেলায়।" রোববারের কথা বলায় হেসে জানাল, " ততদিনে তো মেলাই উঠে যাবে। বৃহষ্পতিবারই শেষদিন।" জানাচ্ছি বলে ফোন রাখলাম।
             'স্পেশাল' কথাটা শুনেই আমার মনে তখন ভরা কোটালের জোয়ার। বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবছি আমার মনে যা চলছে তা কি মেয়েটির মধ্যেও চলছে। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে তাহলে তো ও অন্য কোথাও ডাকতে পারত। বইমেলাতেই বা আসতে বলল কেন? আশা নিরাশার দোলায় দুলে বইয়ের কথা ভুলে বেরিয়ে আসছিলাম। কিন্তু এবারে ভদ্রমহিলা সজাগ ছিলেন।

     অনেক কষ্টে ছুটি জোগাড় করে আগেই চলে এসেছিলাম। এসেই বলল, " চলুন খুব খিদে পেয়েছে।" ওর ব্যাগ দেখে মনে হল কলেজ কেটেছে। মুখোমুখি বসলাম। ওর মুখ বইমেলার  স্টলের দিকে আর আমি খালি দোকানের ভেতরটাই দেখতে পাচ্ছি। ও খাবার সময় মাঝেমাঝেই এদিকওদিক তাকাচ্ছিল। হঠাৎ যেন ওর কারেন্টের ঝটকা লাগলো। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমার পাশে এসে বসল। মুখটাও ঢেকে নিল। ফিসফিসিয়ে বলল, " পাড়ার লোকজন।" যতটা পারি কাছাকাছি এসে ওকে আড়াল করলাম। বারবার পেছনে ঘুরে তাকাচ্ছিল। অনেকটা সময় দোকানে বসেছিলাম।

    বিপদ কাটতেই ওর নজরে এল আমার ব্র্যান্ডেড ঘড়িটা। বলল, " এটা তো দারুণ সুন্দর।" বললাম," খালি  হাতে ইন্টারভিউ দিলে চাকরি পাওয়া যায়না বলে বাবা দিয়েছে। চেনাশোনা ছিল বলে সস্তায় পেয়েছি।" ছাড়ের পরিমাণ শুনে ওর চোখ উঠল কপালে। বেশ কিছু স্টলে যাওয়ার ছিল। কিন্তু পাড়ার লোকের ভয় দেখিয়ে যেতে দিলনা। দিশাহীন হয়ে এদিকওদিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বসতেই বলে উঠল, " আমায় একবার নিয়ে যাবেন ঐ দোকানে? দাদার জন্মদিন আসছে। টিউশন করে পয়সা জমিয়েছি। দাদাকে একদম চমকে দেব।" 

   রবিবার যেতে পারবেনা জেনে ছুটির কথা ভাবতেই ভেসে উঠল খড়ুস বসের মুখখানা। আমতা আমতা করছিলাম। বলে উঠল, " ভারি তো একদিন যাবেন! আমি কি রোজরোজ ডাকি নাকি আপনাকে ?" সন্ধ্যা নামছিল; আমার থেকে কথা আদায় করেই পালালো। তালেগোলে  'স্পেশাল কথাটা' আর আমার জানা হলনা।

      মেট্রো সিনেমার সামনে এল পাক্কা একঘন্টা লেট করে। এই সময়টা মনের মধ্যে কী যে চলছিল! দেখামাত্রই বলে ফেললাম, " আজও বুঝি কলেজ কেটে এসেছেন?" এমন চোখ করে তাকালো, মনে হল পারলে আমায় খেয়েই নিত। ভেঙচি কেটে বলল, " শুনুন আজ না বাড়িতে বলেই এসেছি।" কিন্তু যে পরিমাণ ওর গাল লাল হয়ে উঠল তাতে মনে হলনা সত্যি বলছে। বললাম, " এখানে খুব ভালো লস্যি বানায়, চলুন একটু টেস্ট করবেন।"

     দেখলাম এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় গালের রঙ প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। শুরু করল ওর বকবকম। দুনিয়ার সব কিছুই বলল। বলল না শুধু আমার সেই 'স্পেশাল কথাটা'। গলা খাকরে বললাম, " সেদিন যে বলেছিলেন আমার স্পেশাল মেসেজ আছে; কই আর তো কিছু বললেন না?" খানিকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে বলল, " আপনার বেছে দেওয়া বইগুলো দারুণ। প্রথম যেদিন ফোন করলেন ততক্ষণে আমি 'একটু উষ্ণতার জন্য' পড়়ে ফেলেছি। 'ছুটির' চরিত্রটা দারুণ। আর এখন তো আমার সবকটাই পড়া হয়ে গেছে। একবার ভাবলাম জিগ্যেস করি তুমি কি আমার 'ছুটি' হবে? কিন্তু সাহসে কুলোলো না। ভাবলাম এই মেয়ে তো 'হলুদ বসন্ত' পড়ে ফেলেছে। বললাম, " তুমি কি আমার বসন্তের ছোঁয়া হবে?" গাল লাল হয়ে উঠলেও কোনো জবাব পেলাম না।

  এসপ্লানেডের মোড়ে চিরকালই যানবাহনের ভীড়। তারমধ্যেই তিনবার রাস্তা পেরিয়ে এলাম। দেখলাম পাশে ও নেই। এবার হিড়হিড় করে হাত ধরে টেনে আনলাম। হিতে বিপরীত হল। চটাশ করে হোঁচট খেয়ে বেচারীর চটি ছিঁড়ল। হতাশ হয়ে তাকালো আমার দিকে। বললাম আমায় দিন, " বানিয়ে নিয়ে আসছি।" ওনার ইতস্ততার মুখে জোর করেই চটিটা সেলাই করিয়ে আনলাম। ওনার লজ্জার শেষ নেই। ঘড়ির দোকান অবধি আর কোনো কথা হলনা।

   ঘড়ি কেনা শেষ করে আমরা তখন বড় রাস্তার ফুটপাতে। দেখলাম ঘনঘন ঘাড় ঘুরিয়ে বাসের নম্বর দেখছে। বুঝলাম বইমেলার পাঠ চুকেছে, এবার আমার সময়সুযোগ শেষ। আর দেখা হবেনা। মরীয়া হয়ে একটা দোকানের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, " আরে এদিকে চলুন। আগে আপনাকে একটা জুতো কিনে দিই, তারপর যাবেন। বলা যায়না এই মেরামত করা চটি হয়ত সেলাই খুলে ফের আপনাকে বিপদে ফেলবে।"

    বলা মাত্রই কোমরে হাত দিয়ে প্রায় ঝগড়ার সুরে বলল, " তাহলেও বা! আপনি কেনো কিনে দেবেন?" কথার ঝাঁঝে বুঝলাম এবার আমার সত্যি বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাহস জুটিয়ে বললাম, " চাইলাম বসন্তের ছোঁয়া আর আপনি কিনা দিলেন চটির ছোঁয়া। ঠিক আছে এটাকে বাক্সবন্দী করেই না হয় কাটিয়ে দেব বাকি জীবনখানা।" ডায়লগবাজি একটু বেশিই হয়ে গেছিল। ভয়েভয়ে ভাবছিলাম এবার না জানি, কি না কি শুনিয়ে দেবে।

       বকুনির স্বরে বলে উঠল, " শুনুন মশাই অনেক আগেই বুঝেছি আপনার মতলব খানা। সোজা কথা সোজা ভাবেই বলতে হয়। ওত ঘুরপ্যাঁচের দরকার নেই।"
                         
   এরপর কেটে গেছে পঁচিশটা বসন্ত। 'বইমেলায় পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ উপহার' এখনও রয়ে গেছেন আমার সাথে; সোজা কথা সোজা ভাবে বলার জন্য।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments

  1. সমলোচনা আর কি ক‍রবো। love at 1st sight আপনার সাথেই ২৫ বছর রয়ে গেছেন আর আমার love at 1st sight opposite house nabour আমার সাথে এই জুনে ২৯ বছর হবে।
    মিষ্টি প্রেমের লেখা মন ছুঁয়ে গেলো। দারুন লাগলো পড়ে

    ReplyDelete