ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
পর্ব – ১
প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে খড়্গপুরের ইন্দাতে এক বিচিত্রানুষ্ঠানে সঙ্গীত শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়,মান্না দে এবং আরও অনেক শিল্পী গান গাইতে এসেছিলেন। সেই সময়ে সারা রাত্রি ব্যাপি বিচিত্রানুষ্ঠানগুলি হত। ভোরের দিকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন 'মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা' গানটি এবং তাঁকে তবলায় সঙ্গত করেছিলেন প্রখ্যাত তবলচি রাধাকান্ত নন্দী মহাশয়। এখনো মনে আছে এই গানটি ছিল কাহারবা তালের। দর্শকের অনুরোধে গানটি প্রায় তিন বার পুনরাবৃত্তি করে শিল্পীকে গাইতে হয়েছিল। যখন তিনি গানটি শেষ করেছিলেন সমস্ত দর্শকবৃন্দ আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সহর্ষ অভিনন্দিত করেছিলেন।
উপরের উপক্রমণিকাটি করলাম এই কারণে যে সংগীতের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ তা কিন্তু আজকের নয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই সংগীতের সৃষ্টি। ভারতীয় সংগীত পৃথিবীর আদি সঙ্গীত। সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তন কিভাবে হয়েছে আদিকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সেটাই আমার লেখার উপজীব্য।
ভারতীয় সংগীতের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা রূপক কাহিনী ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কেউ বলেন সংগীতের স্রষ্টা দেবাদিদেব মহাদেব। তাঁর কাছ থেকে ব্রহ্মা এবং ব্রহ্মার কাছ থেকে তাঁর পাঁচ জন শিষ্য - ভরত, নারদ, রম্ভা, হুহু ও তুম্বরু এই সঙ্গীতবিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন। আবার কোন মতে বলা হয়েছে ব্রহ্মা থেকে পরম্পরা ক্রমে মহাদেব, সরস্বতী, নারদ ও ভরত এই শিক্ষা লাভ করেন। বিভিন্ন মতে যাই বলা হোক না কেন অনাদিকাল থেকে ভারতীয় সংগীত যে পৃথিবীর আদি সংগীত সে বিষয়ে পণ্ডিতেরা একমত। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন ডক্টর উইলার্ড হিন্দু সঙ্গীত সম্বন্ধে যে গ্রন্থ লিখেছেন তাতে উল্লেখ করেছেন ভাষাতত্ত্ববিদ ও দার্শনিকেরা এই মত প্রকাশ করেছেন যে মানুষের ভাষা সৃষ্টির পূর্বে সঙ্গীতের উদ্ভব হয়েছে।
ভারতের সুপ্রাচীন সভ্যতা যেমন বিভিন্ন ধারায় উৎকর্ষ লাভ করেছে তদ্রুপ সংগীতেরও ক্রমবিকাশ হয়েছে। সংগীতের প্রাচীনত্বের উল্লেখ করে ঐতিহাসিকেরা বৈদিক যুগের উল্লেখ করেছেন। তাহলে স্বভাবতঃই প্রশ্ন আসছে বৈদিক যুগের শুরু কখন হয়েছে। বেদের বয়স নিয়ে বিভিন্ন পন্ডিতের বিভিন্ন মত। কেউ বলেন খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বৎসর, কেউ বলেন আড়াই হাজার, আবার কেউবা বলেন দুই হাজার বৎসর পূর্বে বেদের সৃষ্টি। তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিতে পারি খ্রিস্টপূর্ব দু হাজার বৎসর পূর্বে বেদের সৃষ্টি হয়েছে।
বৈদিক যুগের সংগীত বলতে বোঝায় মুনি-ঋষিদের সাম গান। বৈদিক যুগে সংগীতের সাতটি স্বরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলি হল যথাক্রমে ক্রুষ্ট (উঁচু), প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মন্দ ও অতিস্বার্য। নারদ মুনি ও বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্য সাতটি স্বরের নাম উল্লেখ করেছেন। যেগুলি হল যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম। পরবর্তী যুগে দেশী সংগীতের মাধ্যমে আমরা সাতটি স্বরের উল্লেখ পাই। সেগুলি হল যথাক্রমে ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ নামে
বৈদিক যুগ থেকে সুর ও ছন্দ মিশ্রিত মুনি-ঋষিদের সংস্কৃত ভাষায় স্তোত্র পাঠের থেকে ভারতীয় সংগীতের সূত্রপাত বলা যেতে পারে এবং সেখান থেকে বিবর্তিত হয়ে বর্তমানের আধুনিক সঙ্গীতের সুর, তান ও লয়ের সৃষ্টি। সমস্ত যোগ ও যোগের সারবস্তু নিয়ে স্বয়ং পদ্মযোনি ব্রহ্মা সর্বযোগের সার সঙ্গীত নামক মহাযোগ সৃষ্টি করেছিলেন। "যোগানাং যোগ শাস্ত্রানাং সারং আকৃষ্ণ পদ্মভূঃ। ইদন্তং সর্বযোগসারং সঙ্গীতাখ্যাং অকল্পয়ৎ।।
বেদের প্রতিটি মন্ত্রই সংগীতের আদি সূত্র। পৌরাণিক যুগে আমরা দেখতে পাই দেবর্ষি নারদ হিমালয়ের রুদ্রপ্রয়াগে সংগীত সাধনার জন্য মহাদেবের কঠোর তপস্যা করেছিলেন কারণ মহাদেবই সমস্ত রাগরাগিণীর স্রষ্টা। মহাদেবের থেকে গুণী ও সমঝদার সঙ্গীতজ্ঞ ত্রিজগতে আর কেউ নেই। মহাদেব বিভিন্ন প্রকার রাগরাগিণীর শিক্ষা দেবর্ষি নারদকে রুদ্রপ্রয়াগে যে তপঃস্থলী শিলাতে দিয়েছিলেন সেটি নারদশিলা নামে পরিচিত।
পৌরাণিক গ্রন্থ যেমন রামায়ণ, মহাভারত, হরিবংশ পুরাণ, ছান্দোগ্য উপনিষদ, বৃহদারণ্যক, মার্কণ্ডেয় পুরাণ এবং বায়ুপুরানেও উল্লেখ আছে গীত, বাদ্য ও নৃত্যের। আশ্রমের সাত্ত্বিক পরিবেশে যেমন সুমধুর সামগীত গাওয়া হত মুনি ঋষিদের স্তোত্রের মাধ্যমে, দেবসভায় যেমন সংগীত ও নৃত্যের প্রচলন ছিল অনুরূপভাবে রাজাদের রাজসভাতেও সংগীত, বাদ্য ও নৃত্যের প্রচলন ছিল।
ভারতীয় সংগীতের একটি গভীর অতীত ঐতিহ্য আছে। প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক শব্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রতি সাযুজ্য রেখে, পাখিদের কলকাকলি বা অন্যান্য প্রাণীদের ডাক মিলিয়ে ভারতীয় সংগীতের প্রাথমিক সাতটি স্বরের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন 'সা' স্বরটি এসেছে ময়ূরের ডাক থেকে, 'রে' স্বরের সঙ্গে গরুর ডাকের সাদৃশ্য, 'গা' স্বরের সঙ্গে ছাগলের ডাকের সাদৃশ্য, 'মা' স্বরের উদ্ভব শেয়ালের ডাক থেকে, কোকিলের কুহুতানের থেকে 'পা', ঘোড়ার ডাকের থেকে 'ধা' এবং হাতির বৃহংন থেকে 'নি' স্বরের উদ্ভব হয়েছে।
ইম্পিরিয়াল গেজেট অফ ইন্ডিয়ার ষষ্ঠ খন্ডে স্যার উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন "a regular system of notation had been worked out before the age of Panini (350 BC) and the seven notes were designated by their initial letter. These notation pass from the brahmins through the persians to Arabia and was thence introduced into European music by Guindor Arezzo at the beginning of the 11th century". অর্থাৎ পাণিনির (খ্রিষ্টপূর্ব 350 বর্ষে) পূর্বেই ভারতীয় সংগীতের সাতটি স্বর আবিষ্কৃত হয়েছিল। বৈদিক ব্রাহ্মণদের এই সাতটি স্বরলিপি পার্সিয়ানদের দ্বারা আরবদেশে ও তৎপরবর্তী কালে একাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রচারিত হয়েছিল। এই ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে বিশ্ব সংগীতের জনক ভারতবর্ষে সংগীতের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে দু হাজার চারশ বৎসরেরও পূর্বে।
ক্রমশঃ
0 Comments