জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে ৫ / অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে  ৫ 

অলোক চট্টোপাধ্যায়

লাল রঙের বাড়িটার গায়ে বড় বড় করে লেখা –
পান্ডুশিখর পাগলা গারদ
এখানে সকল প্রকার পাগলদের চিকিৎসা করা হয়
অনুসন্ধানের সময় - প্রতিদিন সকাল হইতে পরেরদিন সকাল পর্যন্ত
বাড়িটার পাশ দিয়ে দুদিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে। যেমনটি বলেছিল ঘটপটি। কিন্তু মুশকিল হোল, আমার কেমন যেন গুলিয়ে গেল কোন রাস্তাটা সে ধরতে বলেছিল। একটু দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আরো গোলমাল। একবার মনে হয় ডানদিকেরটা দিয়ে যেতে বলেছিল আবার পরক্ষণেই মনে হয় বাঁ দিকেরটা। শেষমেশ লালবাড়ির ভেতরেই ঢুকে পড়লাম, সেখানে কাউকে জিগ্যেস করে বাজারের পথটা জেনে নেব।
(-কি কান্ড নিতাইকাকা। পাপাই বলে উঠল। - তোমাকে না ঘটপটিদাদা বারবার নিষেধ করেছিল ও বাড়ির কাছাকাছি না যেতে?
-ঐ দেখো পাপাইদাদা, তোমার ঠিক মনে আছে। নিতাই আফসোসের সুরে বলল। - আর আমার তখন কি যে বিভ্রম হল, গিয়ে হাজির হলাম ঐখানেই।
-তারপর কি হল? ঝিমলি অধীর গলায় বলল।)
ভেতরে ঢুকে একটা উঠোন মতন জায়গা। সেটা পেরিয়ে একটা ঘর। উঁকি মেরে দেখি সেখানে অত সকালেও একজন বুড়োপানা লোক একটা মাদুরের ওপর বসে একটা জলচৌকির ওপর রাখা একটা মোটা খাতায় পালকের কলম দিয়ে কিসব যেন লিখছে। গলা খাঁকারি দিলাম, সে মুখ তুলে তাকালোও না। কাছে গিয়ে বললাম – এই যে শুনছেন? সে মুখ না তুলেই বলল – হ্যাঁ। 
মহা মুশকিল। একটু জোরেই জিগ্যেস করলাম – মশাই, এদিকে বাজারের রাস্তাটা কোনটা বলতে পারেন? যেখানে ঘটপটি-চটপটিদের বাড়ি?
বুড়ো এবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল – তুমি কি রকম পাগল, খোলামেলা না আটকে রাখা? গান গাও না কবিতা লেখো ? লাফাও ঝাঁপাও না ঝিম মেরে থাকো? সব ঠিক ঠিক না বললে চিকিচ্ছে হবে কি করে? আমি খুব বিরক্ত হয়ে বললাম – দুর মশাই, আমি পাগল টাগল নই। একটা ঠিকানা খুঁজতে এখানে ঢুকেছি।
বুড়ো গম্ভীর হয়ে বলল – গোড়ায় গোড়ায় ওরকম সবাই ভাবে। নয়তো তাদের পাগল বলা হবেই বা কেন? এই অবধি বলেই সে হঠাৎ গলার সুর চড়িয়ে হেঁকে উঠল – জগঝম্প, এই জগঝম্প। একে ধরে বাষট্টি নম্বরে নিয়ে যা। বলতে না বলতেই  ভয়ানক মুশকো চেহারার একজন লোক ভেতরের দরজা দিয়ে এসে আমি কিছু বোঝার আগেই আমায় টপ করে কাঁধে তুলে নিয়ে ভেতরের দিকে চলল। আমি কোনো প্রতিবাদ করার আগেই। ছটপট করে হাত পা ছূঁড়ে কোনো কাজ হল না। সে আমাকে একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রায় ছুঁড়েই ফেলে দিয়ে বাইরে থেকে হুড়কো আটকে দিয়ে দিব্যি চলে গেল।
আমি তো পড়েই বুঝেছি কার না কার ঘাড়ের ওপর পড়েছি। অন্ধকারটা একটু চোখে সয়ে যেতে দেখি আমার ঠিক পাশেই খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা একজন লোক খুব রাগ রাগ মুখ করে বসে আছে। চোখাচোখি হতেই বিরক্ত গলায় বলল – তুমি তো আচ্ছা আলুপটকা লোক হে। অমন করে ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো কবিতার ভাবটাই মাটি করে দিলে। এখন কি হবে?
আলুপটকা শব্দটা আগে কখনও শুনিনি, তবে বলার ভঙ্গিতে মনে হল সেটা গালমন্দ গোছের কিছু হবে। তবে আমি দুঃখপ্রকাশ করে বললাম – আমি কি ইচ্ছে করে পড়েছি নাকি? আমাকে তো জগঝম্প নামের একজন লোক বিনা কারনে ধরে এনে এখানে ছুঁড়ে ফেলল। 
ও, জগঝম্পের কাজ? লোকটা এবারে খুব সহানুভুতির সুরে বলল, - ওর সব কিছুই ওরকম আক্কেল ছাড়া। এই দ্যাখোনা কাল বিকেলে চুপিচুপি একটা কবিতা বানাচ্ছি, কি করে জানি টের পেয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে কনকনে ঠান্ডা জলে চান করিয়ে দিল। বলে কিনা চিকিচ্ছে হচ্ছে। চিকিচ্ছে না ঘোড়ার ডিম!
আমি শুধোলাম – তুমি কি কবিতা বানাও নাকি? সে তাই শুনে ভারি অবাক হয়ে বলল – সে কি? সবাই তো জানে। তুমি জানো না? কবি চন্দ্রবান্ধবের নাম শুনেছো তো? আমিই হলাম গিয়ে সে। আর কবিতা লিখতে পারি বলেই না সবাই মিলে আমাকে ধরে এখানে আটকে রেখেছে।
আমি ঘাড় নেড়ে কিছুটা অবাক হবার ভান করে যেই বলেছি – তাই নাকি ? লোকটা অমনি বলল,- বিশ্বাস হচ্ছেনা বুঝি? দাঁড়াও, এক্ষনি একটা শুনিয়ে দিচ্ছি। বলেই আমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় সুর করে বলতে শুরু করে দিল –
লাগডিম লাগডিম কাগডিম প্যাঁচানো
মাঝরাতে সাঁঝরাতে শেয়ালের চ্যাঁচানো
হুঁকো হাতে বুড়ো বুড়ি করে গলা সাধানি
ছরকুটে তেরেকেটে সা রে গা মা পা ধা নি।
-কেমন লাগল বল তো? আরো আছে শুনবে? বলেই সে গলা খাঁকারি দিয়ে পরের কবিতাটা শুরুই করতে যাচ্ছিল হঠাৎ জগঝম্পর গর্জন ভেসে এল – কি হচ্ছে কি? আবার কবিতা বলা হচ্ছে নাকি? লোকটা তাড়াতাড়ি খুব কাঁচুমাচূ হয়ে বলল – আরে না না, পাগল নাকি? আমি তো এই নতুন লোকটাকে ঝাঁপুই মাছ ধরার চার সম্বন্ধে বোঝাচ্ছিলাম।
এরপর কিছুক্ষন সে চুপ করে বসে থেকে তারপর পা টিপেটিপে দরজার কাছে গিয়ে মনে হয় বোঝার চেষ্টা করল জগঝম্প সেখানে বসে আছে কিনা। কিছুটা নিশ্চিন্ত মুখে ফিরে এসে বেশ বীরদর্পে বলল – হ্যাঃ। ও কি ভেবেছে ওর ভয়ে আমি কবিতা বলা ছেড়ে দেব? কবি চন্দ্রবান্ধবকে কি ভিতু ভেবেছে নাকি? যে যতই বাধা দিক আমার যা বলার আমি কবিতার মধ্যে দিয়ে সমস্ত ঠিক বলেই ফেলব। কবিদের থামানো অত সোজা নাকি?
তারপরেই গলার স্বর নিচু করে বলল – আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যখন ভয় খাচ্ছো আমি একটু নিচু আওয়াজেই বলছি -। তার আগে বল তো দেখন হাসি’র সঙ্গে কিসের মিল হতে পারে? মানে কবিতার লাইনে?
-আমি কি জানি? বললাম আমি। আমি তো আর কবিতা লিখিনা। তবে চট করে মনে হচ্ছে বাঘের মাসি হতে পারে কিংবা খোদার খাসি বেশ মিলছে।
-উঁহু, মিলল বটে কিন্তু ভাল হল না। হবে কোত্থেকে, সবাই কি আর কবিতা বানাতে পারে? কবি চন্দ্রবান্ধব ভারি খুশি খুশি গলায় বলল। আমি বলছি, শোনো -। বলেই আবার কবিতা শুরু করল সে। অবশ্য কবিতা না বলে ছড়া কাটল বলাই বোধহয় ভাল।
    চিন্তামণি চিন্তা বিনা   
নাচতে থাকে ধিনতা ধিনা
    খ্যাঁকশিয়ালি দেখন হাসি   
থমকে বলে এখন আসি।
-কেমন হল বল দেখি?
আমি ভাল মন্দ কিছু বলার আগেই ধড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এল জগঝম্প। গর্জন করে উঠল – এইবার বাছাধন হাতেনাতে ধরা পড়েছ। ভেবেছ আমি চলে গেছি, তাই না? এবার মজা টের পাওয়াচ্ছি। চল, তোমার চিকিচ্ছে হবে -
লোকটা কি ভয়ানক মিথ্যেবাদি। বেজায় কাঁচুমাচু গলায় বলল – আমি কি ইচ্ছে করে বলেছি নাকি? নেহাৎ এই নতুন লোকটা বারবার শুনতে চাইল তাইতো একটুখানি বললাম। আর তোমাদের চিকিচ্ছে মানে তো ঠান্ডা জল? কতবার বলেছি না শীতকালে গায়ে ঠান্ডা জল ঢাললে আমার ভাল্লাগে না। তার চে’ বরং এই লোকটাকে ধরে নাইয়ে দাও।
জগঝম্প কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – ওরও চিকিচ্ছে হবে। আগে তোমারটা। নাও চল, মেলা গোলমাল কোরোনা। এই বলেই সে কবি চন্দ্রবান্ধবের হাত ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান।
আর তারপরেই বেধে গেল শুম্ভনিশুম্ভের লড়াই। জগঝম্পর বিশাল চেহারা, কিন্তু কবি চন্দ্রবান্ধবও দেখলাম কিছু কম যায়না। বারবার জগঝম্পের হাত থেকে কিলবিল করে পিছলে বেরিয়ে এসে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ে পালাতে লাগল সে। তার পেছন পেছন ঐ বিপুল বপু নিয়ে জগঝম্পও ছুটতে লাগল আর আমি পাছে ওদের ধাক্কায় চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যাই সেই ভয়ে চু কিৎ কিৎ খেলার মত ওদের কাটাতে লাগলাম।
এই করতে করতে হঠাৎ জগঝম্পের একটা আলতো ধাক্কায় আমি ছিটকে এসে পড়লাম খোলা দরজার বাইরে। আমি কিছু বোঝার আগেই চন্দ্রবান্ধব দাঁড়িয়ে পড়ে বলল – পালালো – পালালো। জগঝম্পও গর্জে উঠল – তবে রে, দাঁড়া তোর ব্যাবস্থা করছি।
জগঝম্প লাফিয়ে আসার আগেই আমি কিছু না ভেবেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজাটা বন্ধ করে হুড়কো আটকে দিলাম বাইরে থেকে। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছে। সে ধমকে বলল –অ্যাই, কি হচ্ছে কি?
ভাবলাম বলি – তোমার চিকিচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তার আগেই জগঝম্প গলার সুর একেবারে পালটে ফেলে ভয়ানক করুণ গলায় বলল – দরজা খুলে দে রে ভাই, তোকে কিচ্ছুটি করব না। জানাজানি হয়ে গেলে আমার এমন পছন্দের চাকরিটা চলে যাবে রে। পাশ থেকে চন্দ্রবান্ধবের আহ্লাদি গলা পেলাম – কি মজা কি মজা ! জগঝম্প জিবেগজা। 
আমি দ্রুত চিন্তা করে নিলাম এই অবস্থায় পালাতে গেলে জগঝম্প ওই ষাঁড়ের মত গলায় চ্যাঁচাবে, আর বাকি লোকজন আমাকে ধরে ফেলবে। কাজেই ওকে ঠকানোর একটা উপায় বার করতে হবে। সেইমত গলায় মধু ঢেলে বললাম – আরে দাদা ভাবছ কেন? আমি কি সত্যি সত্যি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি? এটা তো একটা মাজার খেলা। আমি তোমায় একটা কাজ দেব, সেটা তুমি করে ফেললেই দরজা খুলে আমি ভেতরে আর তুমি বাইরে।
সে গোঁজ হয়ে বলল – কি কাজ?
আমি কথা বলতে বলতেই ভেবে নিয়েছিলাম। - সতেরোর নামতা বলতে পারবে? খুব আস্তে আসতে বলতে হবে। জগঝম্প কিছু বলার আগেই চন্দ্রবান্ধব বলে উঠল – আমিও নামতা বলব। আমি তেইশের নামতা জানি, সাতাশেরটাও জানি, পাঁচেরটাও একটু একটু মনে আছে। জগঝম্প ধমকে বলল – না, আগে আমি বলব – সতেরো এক্কে সতেরো – সতেরো দুগুনে – সতেরো দুগুনে, এই চাঁদু, সতেরো দুগুনে কত হয় বল না? চন্দ্রবান্ধব বলল – তেইশ দুগুনে বলতে পারি, বলি? আমি ওদের নামতার ফাঁদে ফেলে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। সদর দরজার সামনের ঘরে সেই বুড়ো তখনো একমনে কি সব লিখে চলেছে। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায়। তারপর হনহনিয়ে হাঁটা লাগালাম সামনের রাস্তাটা ধরে। চটপটিকে খুঁজে বার করার কথা তখন আর মাথায় নেই। তখন একটাই চিন্তা, যে ভাবে হোক এই পাগলা গারদের থেকে যথাসম্ভব দূরে পালিয়ে যেতে হবে।

(এইখানে নিতাইকাকা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল – আহা, বড্ড বেলা হয়ে গেছে। আমি বরং এখন বাড়ি যাই। নয়তো ওরা আবার চিন্তা করবে। নেয়ে খেয়ে পরে  কিংবা কালকে এসে বাকিটা বলব। ঝিমলি পাপাই একসঙ্গে হৈ হৈ করে বলল – না না কাল নয়। আজকেই। দুপুরেই চলে আসবে, আমরাও খেয়ে দেয়ে রেডি হয়ে থাকব। ওদের দাদুও বললেন- হ্যাঁ, সেই ভাল।
সেইমতই নিতাইকাকা বাড়ি থেকে ঘুরে এসে আবার তার গল্পের খেই ধরল।)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments