জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা /সপ্তম পর্ব - পুতুল নাচের স্মৃতিকথা/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা


গ্রামের শহুরে রূপকথা 

সপ্তম পর্ব - পুতুল নাচের স্মৃতিকথা 

 সুরশ্রী ঘোষ সাহা 

শীতের সকাল। ভোর ভোর হাঁটতে বেরিয়ে দেখি, উঠোনে বকুল ফুল ছড়িয়ে আছে। বাতাসে মিহি সুতো দিয়ে সেলাই হয়ে রয়েছে হিমেল পরশ। সারারাত ধরে ঝরে পড়া শিশির ও কুয়াশার চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হলুদ ধানের খেত। কোথাও কাস্তে হাতে চাষি ধান কাটছে, তারপর বিছিয়ে রাখছে পাশে। কোন জমিতে আবার বেশ কিছু আদিবাসী চাষী মেশিনে সদ্য কাটা ধান ঝেড়ে আলাদা করছে। আগে দেখতাম, জমি থেকে শস্য খামারে আনা হত আর বেশ কিছু গরুকে দিয়ে মাড়িয়ে খড় থেকে ধান আলাদা করানো হত। এখন সেসবই অতি দ্রুত মেশিনে হয়ে যাচ্ছে। 

 শুধু চাকরি থেকেই নয়, সংসারের হাল ধরা থেকেও জেঠিমা এখন রিটায়ার করেছে। সকালে উঠে কোন বৌমা শাশুড়িকে পেয়ালা করে চা দিয়ে যায়। কোন ছেলে ইউটিউবে ঠাকুরের কীর্তন চালিয়ে দেয়। খবরের কাগজ খুলে শব্দছক করতে করতে জেঠিমা কীর্তন শোনে। ছকঘর কখনো শব্দহীন থাকে না। ভোরের প্রথম রোদ খেয়ে এসে জেঠিমার পিঠ ঘেঁষে বসলাম। ইউটিউবের কীর্তন শুনে হঠাৎ জানতে চাইলাম। আচ্ছা, আগে কীভাবে সুখ পেতে তোমরা, একটু সেই গল্প করো না? 

 জেঠিমা কত সুখের কথাই বলে চলল।

-ছোটবেলা প্রায়শই গ্রামে শীতকালের সন্ধ্যায় যাত্রাপালার দল আসত। যাত্রার নামগুলো দারুণ আকর্ষণীয় ছিল। "বাবুগো সিঁদুরের দাম অনেক", "শান্তি কোথায়", "গান্ধারী জননী", "থানায় যাচ্ছে ছোটবউ", "কবরে কাঁদছে আনারকলি", "কলি যুগের বউ" এমন কত কিছু। এইসব যাত্রার একটা ঐতিহ্যও ছিল। সমাজ বদলের কথা থাকতো তাতে। ধান কাটবার পর পর তখন বাপ-কাকাদের হাতে ধানবেচা টাকা আসত, তাই যাত্রার জন্য চাঁদা দেওয়ার কোনো অসুবিধেই হত না। মাঝে মাঝে তো পুরো একসপ্তাহ ধরে সিজন টিকিট পাওয়া যেত। শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকে মাইক নিয়ে গ্রামের পথে ঘুরে ঘুরে প্রচার চলত। চারদিকে পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ করে দিত যাত্রাপার্টির দল। হাতে হাতে লিফলেট বিলি হত। বাচ্চা থেকে বুড়োরা ওই রংচঙে পোস্টার আর লিফলেটের ওপর দারুণ আকর্ষণ অনুভব করত। কতবার আমার ভাইরা সেইসব পোস্টার খুলে নিয়ে খাতার মলাট করে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের দেখিয়েছে। ওটার মধ্যেই কত মজা পেত। সন্ধ্যা হলেই হাতে লিফলেট নিয়ে মা, পাড়ার কাকিমারা মাথায় চাদর চাপা দিয়ে বসে যেত দেখতে। নির্দিষ্ট দিনে আগে ভাগে গিয়ে সামনে বসা আর ৫-১০ পয়সার চকলেট আর বাদামভাজার সাথে যাত্রা দেখা, কত আনন্দই না হত মনে। শুধুই কী যাত্রা? লোকসঙ্গীত, আখড়াই, হাফ-আখড়াই, ঢপ, কবিগান, জারি গান, পুতুল নাচ, তরজা এসবও প্রায়দিনই লেগে থাকত।

 আমি জানতে চাই, তরজাটা কখনো শুনিনি, সেটা ঠিক কী, গো?.. 

 তরজা হল হেঁয়ালি করে ছড়াগান। যেটা দু'জন মূল গায়েন তাঁদের সহকর্মীদের নিয়ে বাদ্যযন্ত্রের সাথে ছদ্ম লড়াইয়ের মাধ্যমে আসরে পরিবেশন করত। এর বিষয়বস্তুগুলো ছিল মূলত পৌরাণিক। তরজার গায়েনরা রামায়ণ, মহাভারত, বেদ-পুরাণের কাহিনি নিজেদের মতন করে উপস্থাপন করতেন। 

 এখন সেসব আর হয় না, না? 

 জেঠিমা মোবাইলটা বন্ধ করে দিল। তারপর আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, যা ঘরে গিয়ে রেখে আয়। আর শুনতে ভাল লাগছে না। 

 আমি নিজের ভিতরে উত্তর পেয়ে গেলাম। বুঝলাম, বিশ্বায়নের বেনোজলে বাংলার বহু ঐতিহ্যই আজ অবলুপ্তির পথে। 

 পরিবেশটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল। আমিই আবার জানতে চাইলাম, আচ্ছা জেঠিমা, কবিগান আর তরজা কি এক?

 কবিগান বাংলা লোকসঙ্গীতের একটা বিশেষ প্রকরণ। ঝুমুর, কীর্তন এবং আঞ্চলিক গানের সুরের সংমিশ্রণে এই গান সৃষ্টি হয়েছিল। কবিগানের কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নেই। কবিগান ঠিক অনেকটা, নানা সুর ও বিষয় মিশিয়ে গড়ে উঠা সঙ্কর শ্রেণির গান। মুখে মুখেই এই গান সৃষ্টি হয়ে যেত। স্বভাবজাত কবিরা প্রতিযোগিতামূলক ভাবে তা পরিবেশন করতেন। মূলত দুজন কবি গানের আসরে বা গানের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতেন। আর এদের প্রত্যেকের সাথে থাকতেন কবিদের নিজস্ব সহযোগী কণ্ঠ ও যন্ত্রশিল্পীরা। কত সন্ধ্যা এই কবিগানের লড়াই চলেছে আমাদের গ্রামের খোলা মাঠের মঞ্চে। কত অজস্র শ্রোতাদের ভিড় জমত তখন।

 দশেরার সময় আগে আমাদের গ্রামে বহু শিল্পী পুতুল নাচ দেখাতে আসত৷ ওটাকে অনেকে চদরবদরও বলত। চাদরের তলায় এই নাচ দেখানো হত বলেই মনে হয় চদরবদর নাম ছিল৷ তোরা শহরে যেমন থিয়েটার বা পারফরম্যান্স দেখিস, পুতুল নাচ তেমনি জিনিস। যেখানে পুতুলের মাধ্যমে কাহিনি বলা হয়। আমরা নানা রকমের পুতুল নাচ দেখেছি৷ গ্লাভস পুতুল, সুতো পুতুল, ডাঙের পুতুল, ছায়াপুতুল৷ গ্লাভসের মতো করে হাতে পুতুল বা ঠোঙা গলিয়ে নিয়ে যে শো করা হত সেগুলো ছিল গ্লাভস পাপেট শো৷ সুতো-পুতুলের শরীরে আটকানো থাকত সুতো৷ কল-কবজা দিয়ে সেই সুতো নাড়িয়ে চাড়িয়ে পুতুল নাচ দেখানো হত৷ রড বা স্টিকের গায়ে কাঠের পুতুল আটকে রড ঘুরিয়ে শিল্পী নাড়িয়ে চাড়িয়ে খেলা দেখাত। তাই সেগুলোর নাম ছিল ডাঙের পুতুল। আর ছায়াপুতুল নাচের ক্ষেত্রে সাদা পর্দার পিছনে পুতুল আর আলো থাকত৷ আগে আলো হিসেবে ব্যবহার করা হত প্রদীপ বা হ্যাজাক৷ পরের দিকে ইলেকট্রিক লাইটও ব্যবহার করা হয়েছে৷ পর্দার গায়ে সাদা-কালো বা রঙিন চামড়ার পুতুলের ছায়া ফেলে এই শো হত৷ 

 ঐ গ্লাভস পুতুল নাচ গ্রাম বাংলায় সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ হয়েছিল। শিল্পীর এক হাতে থাকত সারিন্দা, আর অন্য হাতটা থাকত বাঁশের তেপায়া স্ট্যান্ডের নিচে চার দিক ঢাকা রঙিন কাপড়ের তলায়৷ ওপর থেকেই বোঝা যেত সেই হাত নড়ছে৷

 জানিস, আমরা বাপের বাড়ির গ্ৰামে অনেক সুতো পুতুল নাচ দেখেছি। সেই নাচে লাঠি এবং সুতো দুটোরই ভূমিকা থাকত৷ ছোটো ছোটো ধূসর বা কালো কাঠের টুকরো আর বাঁশ দিয়ে ঘরোয়া ভাবে তৈরি হত এর পুতুল৷ এই কারিগরি অন্য কোনও পুতুল নাচে নেই৷ মূল একটা লাঠির সঙ্গে বিভিন্ন কাঠি এবং সুতোতে যুক্ত থাকত পুতুলগুলোর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। মূল লাঠিটা নাড়লেই সেগুলো একসঙ্গে নানা ভঙ্গিতে নড়তে থাকত৷ যে কোনও পুতুল নাচই তখন পথে অথবা খোলা জায়গায় দেখানো হত৷ চদরবদরের পুতুল নাচ দেখানো হত স্ট্যান্ডের ওপরে বসানো গোল অথবা চৌকো বাক্সের মতো চারদিক খোলা মঞ্চে৷ তাদের সব চরিত্রই হত আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু৷ পুতুল থেকে নাচ দেখানোর স্ট্যান্ড লাগানো বাক্স তৈরি সবই শিল্পী নিজে করতেন৷ গানও বাঁধতেন নিজেই৷ নাচ তো বটেই। পুতুলগুলোও এত নিখুঁত দেখতে হত যে, দেখে চোখ ফেরানো যেত না৷  নাচ গানের মধ্য দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের কাহিনি, যুদ্ধের ঘটনা সবকিছু দেখানো হত৷ সমাজের মানুষের মধ্যে নানা নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষাও ছড়িয়ে দিতেন শিল্পীরা। যেমন, বাল্য বিবাহের কুফল, অরণ্য সংরক্ষণের সুফল কিংবা নানা বিপদ সম্বন্ধে সচেতনতা, ধর্মশিক্ষা ও লোকশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। 

 এখন শুনি ২১শে মার্চ নাকি বিশ্ব পুতুল নাচ দিবস হিসেবে পালিত হয়। অথচ সেভাবে এখন পুতুল নাচই নেই। আমাদের গ্রামে তো আর সেভাবে হয়ই না। 

 জেঠিমার গ্রাম জীবনের সুখ জানতে চেয়েছিলাম। দুঃখ জেনে ফেললাম। এখন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা বসে  বসে টিভিতে কার্টুন দেখে বসে। অথচ পুতুল নাচ বা পাপেট্রিও যে একধরনের অ্যানিমেশন৷ কার্টুনকে যেমন আঁকার পর ক্যামেরার সাহায্যে গতি দেওয়া হয়, পুতুল নাচও অনেকটা তাই৷ সেখানে ক্যামেরার বদলে গতি দিত মানুষ৷

 হায় রে গ্রাম বাংলা! এখন মানুষ পুতুলের জীবন কাটাচ্ছে। আর পুতুল মানুষের।
                                                                      (ক্রমশ...) 

ছবি :  পলাক্সী ঘোষ পাইন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments