জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি/ পর্ব -৬/সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি 

পর্ব -৬

সূর্যকান্ত মাহাতো

জামবনী তথা চিলকিগড় রাজবংশ

 সুবর্ণরেখার উপনদী। নাম ডুলুং নদী। ছোট এই নদীর পাড়ে এলেই মনে পড়ে যাবে ছোটবেলায় পড়া সহজ পাঠের সেই কবিতার লাইন দুটো--
" আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে
 বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।"
 কোথাও বা সাপের মতো সর্পিল গতিতে এঁকেবেঁকে সবুজের মাঠের বুক চিরে এগিয়ে গেছে। আবার কোথাও বা ছোট ছোট কোনও গ্রাম কিংবা শহরকে গায়ে জড়ানো শাড়ির আঁচল এর মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এগিয়ে চলেছে। কোথাও আবার কোনও জঙ্গলকে ডাইনে অথবা বামে, নয় তো ধান ক্ষেত ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছে একেবারেই নিজস্ব ছন্দে, নিজস্ব ঢঙে আপন মাধুরী নিয়ে। বড় বড় নদীর আভিজাত্য তার নেই। তবু কোথাও বা হাটু সমান, কোথাও বা কোমর সমান জল নিয়েই নিজের কৌলিন্য বজায় রেখেছে। নদীগর্ভের কালো কালো বড় পাথরগুলোতে ধাক্কা খেয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে হেসে হেসে গড়িয়ে চলেছে সুবর্ণরেখার কোলে অমোঘ এক টানে।

চিকচিক করা বালিগুলোই তার অলংকার। ক্ষয়ে যাওয়া পেলব মাটি তার নিত্য যাত্রাসঙ্গী। কাউকে স্নান করাতে করাতে, কাউকে জল পান করাতে করাতে, কাউকে পবিত্র করতে করতে এবং কখনও আবার নিজে অপবিত্র হতে হতেই প্রবাহিত হয়ে চলেছে। তার প্রবহমান ধারা স্রোতের সেই যাত্রাপথের নৈসর্গিক দৃশ্য কোন কোন স্থানে এমনই সুন্দর যেন কোন এক দক্ষ চিত্র শিল্পীর সুদক্ষ তুলির টান।

ডুলুং তার আপন সৌন্দর্য আর মাধুর্য নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ৬০ কিলোমিটার গতিপথ পরিক্রম করে চলেছে। বেলপাহাড়ী থানার অন্তর্গত দ্বিঘলপাহাড়ী বা ডুলুং ডিহা পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তারপর দক্ষিনে মুখ করে এই দীর্ঘ ৬০ কিমি গতিপথ অতিক্রম করে রোহিনী গ্রামের কাছে এসে সুবর্ণরেখা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বছরের অন্যান্য সময় তার শরীর ক্ষীণ হলেও বর্ষার সময় এলেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। মাঝে মাঝেই হঠাৎ হড়কা বানে দুরন্ত গতি পেয়ে ভয়াল শব্দ করতে করতে সেও তখন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

সবাই হয়তো ভাবছেন হঠাৎ করে রাজা-রাজড়াদের কথা না বলে এই ডুলুং নদীর স্তুতি করছি কেন? কারণ আকারে ছোট হলেও অভিঙ্গতায় পাকা এই ডুলুং নদী একটা রাজবংশের দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বয়ে চলেছে, তির তির করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। শুধু সাক্ষী নয়, অতীতে একটা সময় নরবলির টাটকা তাজা রক্ত ধারা তার স্রোতের সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছিল।এবং এখনও পশুবলির রক্ত গায়ে মেখে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সেই ইতিহাসেরও প্রত্যক্ষদর্শী এই ডুলুং নদী। আপন তীরেই সহমরণে যাওয়া রাণী মাদের আর্তনাদ শুনেছে, রাজ হত্যার ষড়যন্ত্র দেখেছে। দেখেছে রাজবংশের উত্থান ও পতন। তারপর ডুলুং এর বুক দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তাই এখন তার স্তুতি না করলে প্রকৃত ইতিহাসকেই একরকম উপেক্ষা করা হয়।

জামবনী তথা চিলকিগড় রাজবংশ একদা ডুলুং নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল। জামবনী রাজ্য বা পরগনা ছিল  "ধবলদেব" রাজাদের। তাদের রাজধানী ছিল চিল্কিগড়। তবে এই রাজবংশের ইতিহাসের পরতে পরতে এমন সব উত্থান-পতনের কাহিনী আছে, যা অন্য কোনও রাজবংশের ইতিহাসে এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। এজন্য এর সঠিক তথ্য বিচ্যুতিও ঘটেছে নানা ভাবে। তার উপর বিশেষ কিছু লিখিত বা প্রামাণ্য তথ্য সেরকমভাবে কোনও কিছু নেই বললেই চলে। ইতিহাস ও লোকবিশ্বাস পরস্পরের সঙ্গে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। রাজাদের উত্তরসূরী এবং তাদের বর্ণিত তথ্যই এ রাজবংশের ইতিহাসের অবলম্বন।

যাইহোক চিলকিগড় এর "ধবলদেব" রাজবংশের ইতিহাস জানার আগে আরও দুটো বিষয় জানতে হবে। এক, জামবনী তথা চিল্কিগড় এর অতীত ইতিহাস এবং দুই, ধলভূমগড় এর রাজবংশের ইতিহাস। এই দুটো বিষয় না জানলে জামবনীর বর্তমান রাজ বংশের প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে না

বাংলায় সালটা হবে আনুমানিক ৮৮২ এর কাছাকাছি, ইংরেজিতে ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দ, তখন জঙ্গলমহলে ব্রাহ্মনের রাজত্ব ছিল। শাসন ক্ষমতা একরকম তাদেরই হাতে। সেরকমই এক ব্রাহ্মণ হলেন বলভদ্র ত্রিপাঠী। তিনি জামবনীর বিস্তীর্ণ এলাকার শাসন ক্ষমতা লাভ করেছিলেন তৎকালীন উড়িষ্যার রাজা প্রতাপ রুদ্রের কাছ থেকে। সে সময় বাংলার মেদিনীপুর সহ বেশ কিছু অংশ তার দখলে ছিল। তিনিই পরবর্তী সময়ে জামবনীর দায়িত্ব তুলে দেন বন্ধু বা মিত্র রূপে বলভদ্র ত্রিপাঠীর হাতে।

বলভদ্র ত্রিপাঠী দীর্ঘ দিন রাজত্ব করেছিলেন। তারপর পরবর্তী রাজা হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বরূপ ত্রিপাঠী। বিশ্বরূপ ত্রিপাঠী ও তাঁর রাণী মহামায়া দেবী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই রাজার যোগ্য উত্তরসূরি সেরকমভাবে কেউ ছিলেন না। তখন রাজার পদমর্যাদা ও ক্ষমতার লোভে পড়ে তার দুই সামন্ত সেনাপতি রাজা ও রাণীকে হত্যা করেন। তাদের সমাধিও করা হয় ডুলুং নদীর তীরে। এখনও প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে পুজো দেওয়া হয়। সে সময় কল্যাণপুর, বাহাদুরপুর, জামবনী, শিলদা পরগনা নিয়েই গড়ে উঠেছিল সামন্তভূমি। জামবনীর প্রথম সামন্ত রাজা ছিলেন অনুকুল দাস মত্তগজ সিংহ। তারপর সামন্ত রাজারা দীর্ঘদিন ধরে জামবনীর শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। এভাবেই ষষ্ঠ পুরুষ রঘুনাথ দাস মত্তগজ সিংহ রাজা হয়েছিলেন। তার পুত্র ছিলেন নিত্যানন্দ মত্তগজ সিংহ। যদিও তিনি খুব বেশিদিন রাজত্ব লাভ করতে পারেননি। রাজত্বলাভের কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র হিসাবে গোপীনাথ মত্তগজ সিংহ জামবনীর প্রকৃত রাজা হয়ে ওঠেন। তাঁর সময়কাল ছিল ১৬৯৩ থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি বিবাহ করেন গোবিন্দমণিকে। রাজ ক্ষমতায় এসে গোপীনাথ মত্তগজ সিংহ দেবী মহামায়ার প্রতিষ্ঠা করেন। এবং জনশ্রুতি, তাঁর রাজত্বকালেই দেবীকে সন্তুষ্টি দিতে একসময় এখানে নরবলি প্রথা চালু ছিল। সেই নরবলির তাজা রক্তে রাঙ্গা জল নিয়েই প্রবাহিত হত ডুলুং নদী। ছিল তাঁর সাক্ষীও। তবে এই নরবলি বিষয়ে রাজার নির্দেশ ছিল যে রাজ্যের কোনও ব্যক্তি এবং কোনও ব্রাহ্মণ সন্তানকে কখনো বলির অংশ করা যাবে না। যদিও পরবর্তীকালে রাজ উদ্যোগেই এই ভয়ঙ্কর প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।

নরবলি যে একসময় হত, তার সব থেকে বড় প্রমাণ দেবী রঙ্কিণীদেবী। কনক-দুর্গা ছাড়াও চিলকিগড়ে রঙ্কিণীদেবীও আছেন। কিংবদন্তি আছে যে, রঙ্কিণীদেবী আগে খড়গপুরে ছিলেন। নিয়ম ছিল প্রতিদিন একজন করে মানুষের রক্ত তিনি পান করে থাকেন। সেই মতো গ্রামবাসীরা প্রতিদিন তাঁকে একজন করে মানুষ জোগান দিতেন। একদিন এক বুড়ির পালা এলো। বিধবা বুড়ির আবার একটাই সন্তান। বুড়ি তখন দুঃখে কাতর হয়ে কাঁদছেন। সেই দেখে পীর লোহানীর দয়া হল। তাই বুড়ির হয়ে তিনিই গিয়েছিলেন দেবী রঙ্কিণীর কাছে। নরবলি নিয়ে দেবী রঙ্কিণী এবং পীর লোহানীর মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। সেখানে রঙ্কিণীদেবী পরাস্ত হয়ে জঙ্গলমহলে ধলভূম রাজাদের কাছে পালিয়ে আসেন। রাজারাই দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং নরবলি দিয়ে দেবীকে তুষ্ট করেন। এ প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি" (দ্বিতীয় খণ্ডে) গ্রন্থে বলেছেন, "কিংবদন্তির মধ্যে পীরের মহানুভবতা কৌশলে প্রচার করা হলেও, রঙ্কিণী দেবীর আনুষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যটি লক্ষণীয়। রঙ্কিণীও যে জঙ্গলের বনদেবী তাতে সন্দেহ নেই। নরবলি হত তার সামনে এবং মাত্র এক শতাব্দী আগেও যে হয়েছে বর্ধমান অঞ্চলে, প্রাচীন পত্রিকাদিতে তার বিবরণ আছে অনেক।"

রাজা গোপীনাথ ছিলেন অপুত্রক। তাঁর চার জন রাণী ছিলেন।গোবিন্দমণি, চম্পামণি,ঠাকুরমণি এবং দুর্গামণি। এদের মধ্যে কেবলমাত্র চম্পামণির গর্ভে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল। তার নাম সুবর্ণমণি। রাজা গোপীনাথ তাঁর রাজকন্যা সুবর্ণমণির সঙ্গেই পরবর্তী কালে  ধলভূমের রাজা জগন্নাথ ধবলদেবের বিবাহ দেন। তারপর ১৭৬৫ সালে রাজসিংহাসন শূন্য করে রাজা মারা যান। ডুলুং নদীর তীরেই রাজার নশ্বর দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে রাজার চিতাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সহমরণে গিয়েছিলেন দুই রাণী, চম্পামণি ও ঠাকুরমণি। তাদের হাহাকার আর আর্তনাদে আজও কেঁপে কেঁপে উঠে ডুলুং এর জল।

ধলভূমের রঙ্কিণী দেবী এখনও পূজিত হলেও জামবনীতে দেবী কনক দুর্গার কনক দ্যুতিতে ও ঔজ্জ্ব‍্যলে রঙ্কিনী দেবী  অনেকখানি ম্লান হয়ে পড়েছেন। তার কোনও মূর্তি নেই। কতকগুলো শালগাছের ঝোপেই তার আস্তানা। কতকগুলো সিঁদুর মাখা হাতি ঘোড়া আছে কেবল, আর এটাই হলো রঙ্কিনী দেবী।

ধলভূমগড়ের রাজ বংশের আদি পুরুষ ছিলেন জগদ্দেও। পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ থেকে পুণ্য লাভের জন্য জগন্নাথধামে এসেছিলেন, তারপর  ধলভূমের ধল(রজক) রাজা কে পরাজিত করে ধলভূমের রাজা হয়ে উঠেন। এবং "ধবলদেব" উপাধি ধারণ করেন। রাজ‍্যাভিষিক্ত হয়ে তাঁর নতুন নাম হয় রাজা জগন্নাথ ধবলদেব। এরপর বংশপরম্পরায় তারা রাজশাসন করে আসছেন। রাজ কুলপঞ্জি ছাড়া রাজবংশের সে রকম কোনও প্রমাণ নেই। রাজ কুলপঞ্জি থেকেই অনুমান প্রায় ২৮ থেকে ২৯ পুরুষ ধরে এরা রাজত্ব করে আসছেন। অর্থাৎ 700 বছর এদের রাজত্বের ইতিহাস।

এই রাজবংশের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, 'জগন্নাথ', 'রামচন্দ্র' ও 'বৈকুণ্ঠধাম' এই তিনটি নামই তারা বংশ পরম্পরায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছিলেন। একমাত্র চতুর্থ, ত্রয়োবিংশ এবং ষোড়শ রাজার নাম পরিবর্তন হয়েছিল। চতুর্থ এবং ত্রয়োদশ রাজার নাম চিত্রেশ্বর এবং ষোড়শ রাজার নাম শত্রুঘ্ন রাখা হয়েছিল। এই ব্যতিক্রম এর কারণ ছিল পূর্ববর্তী রাজারা অপুত্রক ছিলেন। তাই বংশের অন্য সন্তানের নাম যেরকম ছিল হুবহু সেই নামেই তাদের রাজা করা হয়েছিল। কোনও পরিবর্তন করা হয়নি।

ঘাটশিলা ধলভূমের বিংশ রাজা জগন্নাথ ধবলদেবের সঙ্গে জামবনির চিলকিগড় এর রাজা গোপিনাথের একমাত্র কন্যার শুভ বিবাহ হয়। রাজা গোপীনাথ মত্তগজ সিংহের মৃত্যুর পর রাজ সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়েছিল। তখন রানী গোবিন্দমনি রাজ্যের প্রধান শাসক হয়ে ওঠেন। অবশেষে তিনিও মারা গেলেন ১৮১৮ সালের ২৭শে মার্চ। ফের শুণ্য হয়ে পড়েছিল রাজ সিংহাসন। তখন রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে নানান টানাপোড়েনও চলেছিল। অবশেষে দৌহিত্র হিসাবে ধলভূমগড়ের কমলাকান্ত ধবলদেব জামবনী তথা চিলকিগড়ের রাজ সিংহাসনে বসেন। বিংশ রাজা জগন্নাথ ধবলদেবের ছয় পুত্র-- রামচন্দ্র, নরসিংহ, যুগলকিশোর, কমলাকান্ত ও নিমাই। এদের মধ্যে চতুর্থ পুত্র কমলাকান্ত জামবনীর রাজা হয়ে ওঠেন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১৮২২ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত। শুরু হল চিলকিগড় তথা জামবনী রাজবংশের এক নতুন অধ্যায়।

জামবনী তথা চিলকিগড় এর রাজাদের পদবী 'মত্তগজ সিংহ' থেকে পরিবর্তিত হয়ে, হয়ে উঠেছিল 'ধবলদেব'। যা আজও রাজাদের উত্তরসূরিরা 'ধবলদেব' উপাধি বহন করে চলেছেন। জামবনী হল তাই ধলভূমের ধবলদেব রাজবংশেরই একটি শাখা। কমলাকান্তের পর রাজা হন তাঁর পুত্র মান গোবিন্দ ধবলদেব। মান গোবিন্দের সময়কাল ছিল চিলকিগড়ের স্বর্ণ যুগ। 'পরভা' নাচ সহ একাধিক সাংস্কৃতিক নৃত্যের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন তিনি। তার দুইজন পুত্র ছিল, হরিহর ও মধুসূদন ধবলদেব। মধুসূদনের কোন সন্তান ছিল না। হরিহরের আবার দুই পুত্র ছিল, পূর্ণচন্দ্র ও ইশ্বরচন্দ্র ধবলদেব। ১৮৬২ সাল থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত রাজ্য কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের হাতে চলে গিয়েছিল। কারণ ওই সময় ইশ্বরচন্দ্র ধবলদেব নাবালক অবস্থায় ছিলেন। রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের পর তার পুত্র জগদীশচন্দ্র ধবলদেব চিলকিগড়ের শেষ রাজা ছিলেন। কারণ এরপর ১৯৫৩ সালে জমিদারি প্রথা উঠে যায়। রাজা জগদীশচন্দ্র ধবলদেব ছিলেন খুবই শিক্ষিত ও বিচক্ষণ মানুষ। তিনি বি.এ., জ্যোতিষাচার্য, উচ্চশিক্ষিত, দানশীল এবং বিদ্যানুরাগী জমিদার ছিলেন। শিক্ষার প্রসার ও বিস্তারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন- চিলকিগড়ে ইংরেজি বিদ্যালয়, সংস্কৃত চতুষ্পাঠী, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি গঠনে নানাভাবে অর্থসাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। রাজা জগদীশচন্দ্র ধবলদেব মারা যান ১৯৫৭ সালে।

চিলকিগড়ের রাজারাও ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ইংরেজদের জুলুমের বিরুদ্ধে চুয়াড় বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের নানাভাবে উৎসাহও দিয়েছিলেন।


বর্তমানে রাজবাড়ির এই বৃহৎ অট্টালিকা খাঁচার মতো নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে। রাজপদের গৌরবান্বিত পদধ্বনি, ঔদ্ধত্যের অট্টাহাসি, রাণীদের কলকাকলি, রাজকর্মচারীদের ব্যস্ততা সবকিছুই আজ শূন্য। কেবল তাদের স্পর্শ মেখে বাড়িটা অতীতের ঐতিহ্য নিয়ে বোধহয় খালি দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আর অবহেলা ও উপেক্ষায় যেন আরও বেশি করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। 

রাজভবনে পুরোনো সেই ঐতিহ্য নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে রাজ মন্দিরগুলোও। কালাচাঁদ জিউর মন্দির, শিব মন্দির প্রভৃতি। একসময় যে মহা ধূমধামের সঙ্গে রথযাত্রা পালিত হত তার সব থেকে বড় প্রমাণ রাজবাড়ির রথ। বেশ কারুকার্যময় এই রথ রাজবাড়ির উঠোনে রাখা আছে।

তবে চিলকিগড় যতটা না রাজবংশের কারণে বিখ্যাত তার চেয়েও বেশি বিখ্যাত রাজাদের প্রতিষ্ঠিত কনক দুর্গার মন্দির। তিনশোরও বেশি প্রজাতির লতানো জঙ্গলের গা ছমছমে পরিবেশে জামবনীর রাজারা এই মন্দির নির্মাণ করেণ। ডুলুং নদীর পাড়েই এই মন্দিরটি অবস্থিত। আগের পুরোনো মন্দিরটি বজ্রপাতে দ্বিখন্ডিত হয়ে ভেঙে গেছে। পরে বাংলা ১৩৪৪ সালে জগদীশচন্দ্র ধবলদেব এই নাট মন্দিরটি নির্মাণ করেন। দেবী কনকদুর্গা অশ্বারোহী এবং চতুর্ভুজা। উপরের বাম হাতে পানপাত্র। এবং নিচের বাম হাতে ঘোড়ার লাগাম। উপরের ডান হাতে খড়্গ এবং নীচের দান হাতে বরাভয় মুদ্রা। রাজা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে রাণীর সোনার কঙ্কন থেকে এই দেবীর মূর্তি গড়েন। মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন, স্যাকরা যোগেন্দ্রনাথ কামিল‍্যা। প্রথম পূজা করেন ব্রাহ্মন রামচন্দ্র ষড়ঙ্গী। এখনও তার উত্তরসূরীরাই পূজা করে আসছেন। দেবীর শরীরে নীল রঙের শাড়ি আছে বলে রাজপরিবারের কেউ কখনও নীল শাড়ি পরেননি। বিনয় ঘোষের কথায়,"কনকদুর্গা মহাসমারোহে পূজিত হন এবং তার বলিদানও হয় সাড়ম্বরে। যেরকম থমথমে বন্য পরিবেশে কনকদুর্গা প্রতিষ্ঠিত, তাতে মনে হয় এককালে হয়তো দেবীর সামনে বন্দী শত্রুর মুন্ডচ্ছেদন করা হত নরবলি দিয়ে।"(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খণ্ড)


তথ্যসূত্র: ১) মেদিনীপুরের ইতিহাস: যোগেশচন্দ্র বসু
২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি(দ্বিতীয় খণ্ড): বিনয় ঘোষ
৩) ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি: মধুপ দে
৪) গুগল/ ইউটিউব ইত্যাদি

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇





Post a Comment

2 Comments