জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. শৌভিক মাইতি এবং এক সত্যিকারের 'ফেলুদা' -৩ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৫১



মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. শৌভিক মাইতি এবং এক সত্যিকারের 'ফেলুদা' ― ০৩

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে...' 

১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষার মরসুম। একটানা ঝরে পড়ছে অভিমানী বৃষ্টির ধারা। একফোঁটা বিশ্রাম নেই। অথচ, আজকেই কী না হস্টেলে ভর্তি হতে হবে! সবে রেজাল্ট আউট হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার। এবার লক্ষ্য উচ্চ মাধ্যমিকের বৈতরণী পার হওয়া। পিংলা থানার আরেকটি নাম-করা স্কুল গোবর্ধনপুর প্রমথনাথ বিদ্যায়তন। হায়ার সেকেন্ডারির ফলাফলে জেলায় বিশিষ্ট স্থান রয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্কুলটির। এ হেন হাইস্কুলে হায়ার সেকেন্ডারির বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে শৌভিক। থাকার বন্দোবস্ত হস্টেলের ঘরে। বাড়ি থেকে স্কুলের মেলা দূরত্ব; প্রায় চোদ্দ-পনেরো কিলোমিটার। যাতায়াতের ডাইরেক্ট রাস্তা নেই। ব্রেক জার্নি করে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। তার উপর সেদিন ছিল বর্ষা-বাদলার দিন। হস্টেলে অ্যাডমিশনের তারিখ। নেহাত দায়ে না পড়লে ঘরের বাইরে বের হবে না কেউ। অগত্যা ইচ্ছা না থাকলেও বাড়ি থেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে। সঙ্গী বলতে বাবা আর একজন দিনমজুর তল্পিবাহক। বই-খাতা বোঝাই টিনের ট্রাঙ্কে তালা ঝুলছে। ট্রাঙ্কের মাথায় হস্টেলে থাকার বিছানাপত্র দড়ি দিয়ে বেঁধে, প্যান্ট-জামা পরে সে রেডি। অথচ গ্রাম থেকে বের হবার রাস্তাঘাট সব জলবন্দী। পিচ্ছিল মাটির রাস্তা। জলকাদায় ভর্তি রাস্তা। কিছু দূর পায়ে হেঁটে যেতে হবে জল নিকাশি খাল পর্যন্ত। তারপর নৌকায় গন্তব্য পাকা রাস্তা। কোত্থেকে একটা কাঠের নৌকা ডেকে আনে বাবা! নৌকায় চড়ে প্রথমে গেল হোগলাবাড়ি বাস রাস্তার মোড়। সেখান থেকে পাকা রাস্তা বরাবর সোজা পশ্চিমে ছ'কিমি দূরে বলাইপণ্ডা। বলাইপণ্ডায় যখন বাস এসে পৌঁছল, ওয়েদার আরও খারাপ। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। ফেরিঘাট প্রায় ফাঁকা। একটা মাত্র ভাড়ার নৌকা বাঁধা নদীঘাটে। বলাইপণ্ডার বুক চিরে বয়ে গেছে চণ্ড্যানদী। তার দুকূল ছাপিয়ে উপচে পড়ছে জল। টইটুম্বুর পাড়। ভরা বর্ষায় সে যেন রণচণ্ডীরূপে ফুসছে রাগে। সে কী জলের স্রোত! ঘূর্ণি স্রোতের বিপরীতে নৌকা বাইতে রাজি হল গরীব মাঝি। ভাড়াটে নৌকায় প্রায় চার কিলোমিটার উজানী নদীপথ পাড়ি দিতে হবে ঘন বর্ষায়। একটানা রিমঝিম রিমঝিম শব্দ। নৌকার পাটাতনে ছইয়ের নীচে আশ্রয় নিল বাবা-ছেলে আর তল্পিবাহক। নৌকায় আরও অনেক যাত্রী বোঝাই। গাঢ় বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে-ওঠা চণ্ড্যানদীর ভয়ংকর অপরূপ রূপ চাক্ষুস করে মুগ্ধ শৌভিক। বর্ষার নৌকায় সওয়ারী হলে এক অন্যরকম ভালো লাগা আষ্টেপৃষ্ঠে লেপটে থাকে হৃদয়ে, মনে। একসময় নৌকা যাত্রা শেষ হয়। চণ্ড্যানদীর পাড়ে অজ্ঞাত কুলশীল প্রত্যন্ত এক গ্রামের প্রান্তে এসে থামে নৌকা। নৌকা থেকে নেমে পড়ে তিনজনে। আরও দুই কিমি হাঁটা পথ বাকি। বর্ষায় পিচ্ছিল মেঠোপথ। চলতে চলতে একটু অসতর্ক হলে মূহুর্তে পা পিছলে সটাং গিয়ে পড়বে কাদা রাস্তার মাঝখানে। পিচ্ছিল রাস্তায় শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রেখে চলা বেশ মুসকিল। ভাগ্যিস! একজন তল্পিবাহক সঙ্গে আছে; তবুও রক্ষে! তা না-হলে বরফ ঢাকা পাহাড়ি পথে লাঠি ঠুকে ঠুকে একজন পথিক যেমন একটু একটু পথ হাঁটে; বাবা-ছেলের ঠিক তেমন দশা হত। ঝাড়া হাত-পা হয়েও দুজনের যেন কচ্ছপ গতি। পা টিপে টিপে এগোয়। ধীরে ধীরে হাঁটু ভর্তি কাদা রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছয় গোবর্ধনপুর প্রমথনাথ হাইস্কুলের গেটে। হস্টেলে পৌঁছতে না-পৌঁছতেই উধাও পথশ্রমের ক্লান্তি! নতুন স্কুল। নতুন হস্টেল। আর, জ্ঞানী গুণী মাস্টার মশায়দের সান্নিধ্য! যেন এক নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে রূঢ় বাস্তবের শৌভিক।
       
গোবর্ধনপুর হাইস্কুলে ভর্তির আসল কারণ ভেমুয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাত বাবু। মূলত তাঁর পরামর্শেই গোবর্ধনপুরে অ্যাডমিশনের সিদ্ধান্ত। ইতিপূর্বে প্রভাতবাবু কলকাতার দু-তিনটি নামিদামি স্কুলে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ভেমুয়া স্কুলে এসেছেন। শহরের ঝাঁ চকচকে স্কুলগুলোতে রেজাল্টের শেয়াল আর কুমির ছানার গল্প তাঁর অজানা নয়। তাছাড়া সম্পূর্ণ গ্রাম্য এক কিশোর ছাত্রের কলকাতার মতো আলট্রা মডার্ন জায়গায় বেড়ে ওঠা বেশ মুশকিল। মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হবার সমূহ সম্ভাবনা। তার চাইতে বরং গোবর্ধনপুর হাইস্কুলের পণ্ডিত শিক্ষককূল অনেক বেশি ছাত্র দরদী আর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। ফলাফলও বহুগুণ ভালো। গোবর্ধনপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তখন প্রভাতবাবুর ভাই শ্রী যুগলকিশোর দাস। যুগলকিশোর স্যারের তত্ত্বাবধানে আর সকল মাস্টার মশায়দের স্নেহ ছায়ায় শৌভিক-এর পড়াশুনায় কোনও খামতি হবে না। তাছাড়া আরও একটা কারণে ছেলেকে গোবর্ধনপুরে ভর্তি করেছেন সুকুমার বাবু। তিলখোজা গ্রামের বাসিন্দা তাঁর বাল্যবন্ধু শ্রী শচীন্দ্রনাথ দাস শিক্ষকতা করেন এখানে। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখ তাঁকে লোকাল গার্জেন হিসাবে পাওয়া বড় পাওনা― এই ছিল ভাবনা। হস্টেলে আর স্কুলে শৌভিক-এর দেখাশুনার যাবতীয় দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে গ্রহণ করলেন নির্দ্বিধায়। এখন অনেক চাপমুক্ত বাবা-মা। 

একজনও প্রাইভেট টিউটর নেই শৌভিক-এর। দরকার পড়েনি কোনও দিন। কী স্কুলে, কী হস্টেলে― বিষয় বুঝতে অসুবিধা হলে সংশ্লিষ্ট গুণী মাস্টার মশায়রা সর্বদা দরাজহস্ত। তাঁদের সৌজন্যে কোনও বিষয়ে শৌভিক-এর খামতি নেই। এ হেন শিক্ষক মশায়রা তার জীবন গড়ার প্রকৃত কারিগর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার কঠোর অধ্যবসায়, শিশুসুলভ প্রসস্থ একটা উদার মন আর নতুনকে জানার তীব্র কৌতূহল। ফল আজ হাতে নাতে। অল্পের জন্য স্টার মার্কস হাতছাড়া হয়। তবে ১৯৮৯ সালে উচ্চ প্রথম বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারির কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে।

বিজ্ঞান তার প্রথম পছন্দ। প্রথম প্রেম। হায়ার সেকেন্ডারি পাশের পর যদিও উচ্চশিক্ষার অনেক দরজা খোলা। ইঞ্জিনিয়ার হবে? ডাক্তার হবে? লেকচারার? না-কি গবেষক! কিঞ্চিৎ ধন্দে সে। একদিনের ঘটনা। বাবা আর ছেলে কলকাতার ফুটপাত ধরে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলের স্পষ্ট স্বগতোক্তি :
―বি. বি. এ. করে এম. বি. এ. করলে ভালো রোজগার হবে।
দোদুল্যমান ছেলের মন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধভূমিতে উতলা অর্জুন-এর কোমল মন যেমন সুদূরের কল্পনা আশ্রয়ী; আগামীর কথা ভেবে যেন কিঞ্চিৎ চিন্তিত সৌভিক। দারিদ্র্য-পীড়িত বাবা জীবনের মোক্ষ দর্শন করায় ছেলেকে। অনিশ্চয়তার রাস্তা থেকে মুক্তির উপায় বাতলে দেয় তাকে :
―মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন মত একটা রোজগারের সংস্থান থাকা নিশ্চয়ই আবশ্যক; তার বাইরে আরও একটি বিষয় আছে। সেটি হল সামাজিক মর্যাদা লাভ। উঁচু মাপের মানুষ তৈরি হওয়া। আমি স্কুল শিক্ষক হয়েছি, তার বেশি কিছু নয়। আমাদের বংশধারায় আমার প্রথম শিক্ষা‌লাভ করে শিক্ষকতা করা। তোমার ক্ষেত্রে, আমার একান্ত ইচ্ছা, সায়েন্স নিয়ে এম. এস. সি. করে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা আর গবেষণা করা।

নিমেষে উধাও দিশেহারা মনের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। অদৃশ্য সব দোদুল্যমানতা। লক্ষ্য এখন স্থির। ডাক দিল চির নতুন। উদ্দেশ্য নতুনের উদ্ভাবন। সে-লক্ষ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এসসি. অনার্সে তার ভর্তির আবেদন। চান্স মিলতেই কলকাতা রওনা হয়ে যায় সে। ভর্তি হয় কেমিস্ট্রি অনার্সে। তিন বছর স্নাতক স্তরে পড়াশুনার পর ১৯৯৩ সালে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয় সে। গ্র্যাজুয়েশান সম্পূর্ণ করে একই ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স ডিগ্রিতে আবারও অ্যাডমিশন নেয় সে। মাস্টার্সে তার স্পেশাল পেপার ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি। রসায়ন বিদ্যার থিওরির চাইতে প্র্যাকটিক্যালে বরাবরই অধিক ঝোঁক তার। ল্যাব‍রেটরিতে হাতে-নাতে প্রমাণ করার আলাদা মজা। অকৃত্রিম আনন্দ। এ ঝোঁক তাকে গবেষণায় আগ্রহী করে। 

(২)
প্রত্যয়ী আর প্রগতিশীল এক গ্রাম্য তরুণ শৌভিক। অগ্নিগর্ভ সত্তরের প্রথম ভাগে দিকভ্রষ্ট বিপ্লবের জ্বলন্ত আগুন তখন বাংলার বুকে। বিদ্রোহের সে-আবহে তার জন্ম। সেজন্য উনিশ শতকের রোজা লুক্সেমবার্গ (Rosa Luxembourg)-এর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করার সৎসাহস তার ধমনীতে বইছে জন্ম লগ্ন থেকে। অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সংগ্রাম-আন্দোলন তার লোম কুপে। বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক। তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধাচরণ করে নিজের স্বাধীন মতবাদ প্রকাশ করার মতো যে কলজের জোর জন্মক্ষণে তার দর্শনে গ্রথিত, তার সফল বহিঃপ্রকাশ ঘটে সেদিন।
         
কলকাতার প্রথম সারির একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানে তখন একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের একচেটিয়া রাজত্ব। একচ্ছত্র আধিপত্য, দাপট আর জয়জয়কার। দীর্ঘকালের নৈরাজ্য গ্রাস করছে বাম ছাত্র সংগঠন এস. এফ. এস. ইউ. (SFSU)-তে। ইউনিভার্সিটির অঙ্গনে রাজনীতি সম্পূর্ণ বেমামান। অথচ, তা-ই করে বেড়াচ্ছে SFSU। 

সালটা ১৯৯৪। শৌভিক তখন এম. এসসি.-র প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ইউনিভার্সিটির আঙিনায় রাজনীতির রঙ আর অনিয়ম আকছার ঘটছে। এমন সময় ছাত্র রাজনীতির দুয়ারে পা রাখে সে। তার স্পষ্ট ধারণা :
―দেশ ও রাজ্যকে বাঁচাতে গেলে রাজনীতিতে আরও বেশি করে শিক্ষিতদের যোগদান দরকার।
সমস্যা বাধল ইউনিভার্সিটির বর্তমান ছাত্র সংগঠনটিকে ঘিরে। তার কানাচে কানাচে অনিয়ম বে-নিয়মের ঘুঘুর বাসা। স্বভাবতই স্বার্থের সংঘাত দেখা দিল। বেশ কিছু রীতি নীতি নিয়ে SFSU-এর সঙ্গে শৌভিক ও তার বন্ধুদের মতবিরোধ চরমে উঠল। SFSU-এর অন্দরে ছাত্র রাজনীতির চাইতে বৃহত্তর রাজনীতির প্রভাব বেশি, যা শৌভিক-এর একেবারে না-পসন্দ। সেজন্য তার মাথায় ঘুরপাক খায় বিকল্প ছাত্র সংগঠনের বাড়তি চিন্তা। তার সঙ্গে জুটে গেল সমমনা বন্ধুবান্ধবের দল। মিলনদা'র ক্যান্টিনে কিংবা হস্টেলে বসল রুদ্ধদ্বার বৈঠক। মিটিং-এ ঠিক হয় এক ছাত্র সংগঠন তৈরি করবে তারা, যার কাজ হবে শিক্ষাঙ্গন রাজনীতি মুক্ত রাখা। সেবছর শৌভিক ও তার বন্ধুদের হাত ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করে নতুন ছাত্র সংগঠন 'উই দ্য ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট' (We The Independent বা WTA)। ওই বছর ছাত্র সংসদের ভোটে প্রথম বারের জন্য লড়াই করে WTA। প্রথম চান্সেই কিস্তিমাত। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে WTA। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বাঁধ-ভাঙা বহিঃপ্রকাশ ঘটে। WTA-এর আশাতীত সাফল্যে অভিভূত সকলে। সেবছর ভোটে জিতে সে-ছাত্রসংসদের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিল শৌভিক। কারণ পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান হবেন ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক― বিশ্ববিদ্যালয়ের এটাই নিয়ম। পরবর্তীকালে যাদবপুরের আঙিনা ছাড়িয়ে অন্য কলেজেও 'উই দ্য ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট' প্রসার লাভ করে। 

রাজনীতির প্রথম হাতেখড়িতেই অভাবনীয় সাফল্য আসায় বৃহত্তর রাজনীতির আঙিনায় পা রাখার একটা সুপ্ত বাসনা যে শৌভিক গোপনে পোষণ করত না, তা নয়। তার জন্য একটি পৃথক মঞ্চ প্রস্তুত করার দরকার ছিল। আর দরকার প্রচুর অর্থ আর লোকবল, যা সেসময় তার হাতে ছিল না। ফলে স্বপ্নের ডালপালা বাস্তবে প্রস্ফুটিত হবার আগেই তার অকাল সমাধি ঘটে। 

(৩)
ব্যতিক্রমী শৌভিক। মেধাবী শৌভিক। গ্রাম্য সরলতা তার কথাবার্তায়, চাল-চলনে। সুমনের গান অসম্ভব ভালোবাসে। ভালো লাগে মৌসুমী ভৌমিকের গানও। রাতভর জমে ওঠে আড্ডা। রাতের সে-আড্ডায় হাজির দিবাকর কুণ্ডু, সুমন, বেটু, সৈকত, মহুয়া, ধারা, দেবযানী কিংবা আশুতোষ ভট্টাচার্য-এর মতো সিনিয়র আর ক্লাসমেটরা। এত বড় শহরে আপনার বলতে প্রথমে কেউ ছিল না তার। ব্যস্ত বড় রাস্তা পার হতে ভয় করত। শহুরে আদব-কায়দা জানে না। ইংরেজি তথৈবচ। মনমোহিনী রাতের কলকাতা শহর, ইউনিভার্সিটি হস্টেল, ট্রাফিক রাস্তা, জেব্রা ক্রসিং, গান্ধীভবন, মিলনদা'র ক্যান্টিন আর বন্ধু-বান্ধবের দল আস্তে আস্তে তার আপন হয়ে গেল। কী অরগানিক কেমিস্ট্রি, কী ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি― সবেতেই তুখোড় বনে গেল পড়াশুনা করে। স্টাডি লিভে নোটপত্র ম্যানেজ করা বেশ ঝক্কির কাজ। বন্ধু বৎসল ক্লাসমেটদের সৌজন্যে সে সমস্যাও দূর হল। তাদের অন্তরঙ্গতা, ভরসার হাত আর ভালোবাসার কাহিনী আজও বেশ সম্পৃক্ত। 

হস্টেলে রাত জেগে পড়াশুনা করা হোক কিংবা নাইট শো'য়ে সিনেমা দেখে রাত বার'টায় হস্টেল ফেরা হোক― সব দল বেঁধে করে সবাই। লেকের ধারে নির্ভেজাল ঠেক মেরে লেকের রাস্তা ধরে সবাই ঘরে ফেরার অকৃত্রিম আনন্দ― স্রেফ আজ নষ্টালজিক ঠেকে।

সবাই মিলে একদিন ঠিক করল বালিগঞ্জ ধাবায় ডিনার সেরে হস্টেলে ফিরবে। এক কথায় রাজি শৌভিকও। বালিগঞ্জ! সে তো অনেক দূর! কুছ পরোয়া নেই। সবাই চলল রাতের খাবার খেতে। একসময় খাওয়া শেষ হল। দাম মিটিয়ে পায়ে হেঁটে ধাবা থেকে বেশি রাতে বাড়ি ফেরার মজা আলাদা। গরম কী পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়ি না ফিরে কলকাতায় থেকে যেত সবাই। পকেটে হয়তো দারুণ টান। কানাকড়িও নেই। কিন্তু মেজাজটা বিন্দাস! সামান্য ক'টি পয়সা পকেটে নিয়ে সবাই চলে যেত ঢাকুরিয়া। ঢাকুরিয়া ব্রিজের তলায় হোটেলে পেট পুরে রুটি-তরকারি খাওয়ার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আর একটা বিষয় হামেশাই ঘটত। বলা নেই, কওয়া নেই; সবাই মিলে ঘুরতে চলে গেল হেসাডি কি ঘাটশিলা কিংবা মধুপুর। ঘাটশিলার অদূরে বুরুডি ড্যাম। তিন দিকে পাহাড় ঘেরা। অপরূপ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শহরের বাইরে এক টুকরো বন্য সবুজের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর আলাদা মজা। 

একদিনের ঘটনা। ওল্ড মঙ্ক সেবনের সকলের দারুণ ইচ্ছা। মদিরা পানের ইচ্ছায় বাধ সাধল চাটের অভাব। কোনও সমস্যা নেই। চাটের বদলে বিস্কুট গুঁড়া দিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত মদিরা পান চলল। যাদবপুরের সোনার সেই দিনগুলি সদ্য যুবা শৌভিক'কে অনেকটা আত্মনির্ভর গড়ে তোলে। সে-দিনগুলো বিস্মৃত হবে না কোনও দিনও। বরং মনের মণিকোঠায় চির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। 
        
যাদবপুরে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড. নীতিন চট্টোপাধ্যায়। প্রচণ্ড স্নেহ করেন শৌভিককে। প্রফেসর চট্টোপাধ্যায়-এর অকপট উপলব্ধি―
'শৌভিক আমার প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে একজন। ভৌত রসায়ন স্পেশাল নিয়ে এম.এসসি. করেছে। ওদের ব্যাচ থেকেই এম.এসসি-তে প্রজেক্ট শুরু হয়। ও আমার কাছে প্রজেক্ট করে। সেই কাজটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল এবং জে. মোল স্ট্রাকচার (J. Mol Structure)-এ প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওরই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গাতে গিয়েছি লেকচার দিতে। ওর গবেষণার লেবেল বোঝা যায় ওর পাবলিকেশন থেকে।''

(৪)
সালটা ১৯৯৫। এম.এসসি. ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র শৌভিক। এম.এসসি-তে প্রথম শ্রেণী পেয়েছে। ওই একই বছরে প্রথম বার সে সর্বভারতীয় নেট (NET বা National Eligibility Test) পরীক্ষায় বসে। প্রথম চান্সেই বাজিমাত। এক চান্সেই কোয়ালিফাই করে নেট-এ ও গেট-এ। তার আপাতত লক্ষ্য পিএইচডি। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে রিসার্চের দরখাস্ত লেখে সে। সুযোগ পায় একঝাঁক ইনস্টিটিউশনে। শেষমেশ বেছে নেয় হায়দ্রাবাদের ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল টেকনোলজি; কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা মন্ত্রকের অধীন নামকরা একটি প্রতিষ্ঠান এটি। তার রিসার্চ গাইড ড. প্রভা রাণী চ্যাটার্জি। রিসার্চের বিষয় নির্বাচন ঘিরে একচোট তিক্ততার সম্মুখীন হল শৌভিক। ড. চ্যাটার্জি প্রথম যে বিষয় নির্বাচন করেছিলেন, তা শৌভিক-এর একেবারে না-পসন্দ। তার পছন্দ পলিমার কেমিস্ট্রি। মৌলিক বিষয়। রিস্ক বেশি। আসলে বিষয় নির্বাচনে শৌভিক-এর হাত ও ভাগ্য ছিল ষোলোআনা। এ হেন পরিস্থিতিতে গাইডের নির্বাচিত বিষয়ের সঙ্গে নিজের নির্বাচিত বিষয়টি নিয়ে গবেষণা এগিয়ে রাখে সে। রিসার্চের কাজে সামান্য অগ্রগতি হতেই মাননীয়া গবেষণা-তত্ত্বাবধায়িকা'কে নিজের রিসার্চ পেপারটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করে শৌভিক। পেপারটির হেডলাইন দেখে দারুণ ক্ষিপ্ত ড. চ্যাটার্জি। 'পলিমার কেমিস্ট্রি'। গোঁ ধরে বসে আছেন তিনি― কোনমতেই রিসার্চ পেপার বিদেশি জার্নালে প্রকাশ করার জন্য অনুমতি পত্রে স্বাক্ষর করবেন না। কারণ একেবারে ভিন্ন। শৌভিক-এর পছন্দ করা গবেষণার বিষয়টি যেমন জটিল, তেমনই কঠিন। তিনি যদি স্বাক্ষর করেন, তাহলে গবেষণা পত্রটি ভেরিফিকেশনের জন্য বিদেশি জার্নালে ছাপতে পাঠানো হবে; ছাপা হলে তখন বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা যাবে। শ্রীমতী চ্যাটার্জি'র মতে― গবেষণা পত্রটি অমনোনীত হবার যেমন সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে; তেমনি একবার অমনোনীত হলে গাইডের সম্মানহানিও ঘটতে পারে। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে বেশ ক'দিন গাইডের সঙ্গে শৌভিক-এর একপর্যায়ে টালবাহানা চলতে থাকে। শেষে, শৌভিক-এর জেদের কাছে হার স্বীকার করেন ড. চ্যাটার্জি। স্বাক্ষরিত অনুমতি পত্রটি শৌভিক-এর হাতে তুলে নিশ্চিন্ত তিনি। 
      
কিছু দিন পরের ঘটনা। বিদেশি জার্নালে উক্ত পেপারটি ছাপা হয়ে শৌভিক-এর হাতে এসে পৌঁছয় পত্রিকা হয়ে। সময় ব্যয় না করে শৌভিক ছুটে যায় গাইডের চেম্বারে। পত্রিকা মেলে ধরে টেবিলের উপর। টেবিলের উল্টোদিকে তখন শ্রীমতী চ্যাটার্জি। জার্নালটি হাতে ধরে পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করেন তিনি। পড়া শেষ। মুখ তুলে চাইলেন শৌভিক-এর দিকে। যারপরনাই খুশি তিনি। তরুণ গবেষকের পিঠ চাপড়া দিয়ে সাহস জুগিয়েছিলেন সেদিন। শৌভিক-এর নিজের পছন্দ করা পলিমার কেমিস্ট্রি'তে পিএইচডি করার অনুমতি দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়।

দীর্ঘ চার বছরের কঠোর অধ্যবসায়ের জোরে ১৯৯৯ সালে তাঁর পিএইচডি কমপ্লিট হয়। এখন ডক্টরেট উপাধিতে সম্মানিত তিনি। ড. শৌভিক মাইতি। আজ তাঁর বাবার স্বপ্ন পূরণের দিন। যদিও ডক্টরেটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়া। লক্ষ্য আরও সুদূর প্রসারী। একই বছর তিনি পাড়ি দেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কার মেডিক্যাল সেন্টার কলেজ অব ফার্মেসি থেকে 'বায়ো ফার্মো ডায়নামিক' বিষয় নিয়ে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি করেন। প্রফেসর লুইস এ. মারকি'র অধীনে দু'বছর ধরে চলে তাঁর পোস্ট ডক্টরেট। তারপর মার্কিন দেশ থেকে সোজা চলে আসেন ফরাসি দেশে। ২০০১ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে আরও একবছর ধরে চলে তাঁর পোস্ট ডক্টরেটের বাড়তি গবেষণা। এখানে গাইড ছিলেন প্রফেসর ফ্রানসিস রনডেলেজ। প্রফেসর রনডেলেজ-এর ল্যাবে মূলত ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা ডি. এন. এ. ন্যানো পারটিক্যালের উন্নত ডিজাইন আর ডেভেলপমেন্ট প্রসেস নিয়ে গবেষণা করেন পোস্ট-ডক্টরেট শৌভিক মাইতি। ফ্রান্সের ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিক্স, ক্যুরি ইনস্টিটিউট থেকে 'ডি. এন. এ. ন্যানো টেকনোলজি'তে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। (ক্রমশ...)

তথ্য-সহায়তা :
●শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের পিতা ড. সুকুমার মাইতি মহাশয়
●সুকুমারচর্চা : সম্পাদনা শ্রী শ্যামল বেরা
●আনন্দবাজার, আজকাল, দি টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকাসহ অন্যান্য প্রিন্ট মিডিয়া

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments