মাতৃভাষার উপর রাষ্ট্রের শোষণ জয়ী হয়নি
সুদর্শন নন্দী
আজ আন্তর্জাতিক ( ২১শে ফেব্রুয়ারি) মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার প্রতি বিশ্বজুড়ে এ এক দূর্লভ সম্মান। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরই সে যেমন মাতৃক্রোড়ে লালিত হয়, মাতৃদুগ্ধ তাকে বাঁচিয়ে রাখে তেমনি তার অন্তরের ভাবনা প্রকাশের জন্য মা ও আত্মীয়দের কাছ থেকেই শিখে নেয় আপন ভাষাটিও। শিরায় শিরায় রক্তের কণিকায় কণিকায়, কোষে কোষে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে মায়ের সেই ভাষা। ভাষার সিঁড়ি বেয়েই তার পরিচিতি বাড়ে শিক্ষা দীক্ষা খেলাধূলা সব। ভাবপ্রকাশে, মনের কথা বলতে তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে মাতৃভাষাই।শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’—রবীন্দ্রনাথের এই সর্বজনস্বীকৃত অতি সহজ কথাটা এখনও সর্বজনীন রূপ পায়নি। শিক্ষাবিদেরা বারবার বলে থাকেন, এক জন শিশুকে তার মাতৃভাষায় শিক্ষা দিতে না-পারলে তার কাছে পড়াশোনাটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর যদি হঠাৎ একদিন বলা হয় রাষ্ট্র আর তোমার ভাষা মানে না, এবং অন্য ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া হয় সমস্ত কাজে তবে তা হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এ যেন মরে বেঁচে থাকা। আর তাই মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই জেলা, রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও। আর এই চাপিয়ে দেওয়া ভাষা শোষণ ছাড়া কিছুই নয়। দূর্বলের উপর সবলের প্রাধান্য বজায় রাখা। মাতৃভাষার উপর এই রাষ্ট্রীয় শোষণ আসলে সাম্রাজ্যবাদীদের মতো ঔপনিবেশিক শোষণই। শোষণের অক্ষটি হল ভাষা, এই যা। আর এই সাম্রাজ্যবাদী শাসক-শোষকদের চাপিয়ে দেওয়া থেকে বাঁচতে মানুষ লড়াই করেছেন বা করছেন ভাষাসন্ত্রাস থেকে মুক্তি পেতে ।
ভাষা আন্দোলন বলতেই মানুষ স্মরণ করে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে। অথচ, ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং লড়াই কোনওটাই কিন্তু নতুন নয়। বাংলা নিয়ে শুধু বাংলাদেশবাসীর লড়াই নয়, আমাদের দেশে বরাক উপত্যকার মানুষও শোষণের শিকার, শিকার জেলার সীমানারেখা টানার খামখেয়ালিতে পুরুলিয়া জেলার মানুষও।
এছাড়া আমরা দেখছি সারা দেশে বিশেষ করে প্রতিবাদী দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের ভাষাগুলির উপর রাষ্ট্র হিন্দী ভাষাকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে চাপিয়ে দিতে বারবার চেষ্টা করেছে। আর ঐ রাজ্যগুলিও এর প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়েছেন বা চালাচ্ছেন।
স্বাধীনতার আগে থেকেই, ১৯৩৭ সাল থেকেই সরকারি কাজে হিন্দি ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেন দক্ষিণ ভারতের বিরাট অংশের মানুষ। এর মধ্যেই স্বাধীনতার পর হিন্দি ভাষাকে প্রধান রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হলে ক্ষোভ চরমে ওঠে। ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে হিন্দিকে মুখ্য রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ওঠে। তার আগের দিন, অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি মাদুরাই শহরের রাজপথ দখল করে প্রতিবাদী জনতা। নেতৃত্ব দেয় পড়ুয়ারাই।
ভাষার উপর আগ্রাসন প্রায় সমস্ত উপনিবেশের সাধারণ ঘটনা। শাসক জাতি সবসময় নিজেকে শাসিতের থেকে উন্নত বলে মনে করেছে, উন্নত মনে করেছে তার ভাষাকেও। উপনিবেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছে তার ভাষাকে। ভারতে এই প্রক্রিয়া তেমন ভয়াবহ না হলেও, যদি দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে দেখি তবে দেখব সেখানকার উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাতই কিন্তু ভাষার প্রশ্নকে সামনে রেখে। আবার উনবিংশ শতকেই ডাচ ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন 'অন্ধকার' এই মহাদেশের পরাধীন মানুষরা। দাবি ছিল, আফ্রিকান ভাষাকে পৃথক সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে।
ইউরোপের যুক্তরাজ্য কাঠামোর মধ্যেও একটি রাজ্যের ভাষা অন্য ভাষাকে গ্রাস করেছে। একদিকে আইরিশ ভাষার অধিকার চেয়ে ইংল্যান্ডের থেকে পৃথক হতে চেয়েছেন আয়ারল্যান্ডের মানুষ। অন্যদিকে নরওয়ের মানুষ মুক্তি চেয়েছেন ডেনমার্কের থেকে। উনবিংশ শতকের শুরুতে নরওয়ে তার ভাষার অধিকার নিয়ে পৃথক হয়ে গেলেও, আয়ারল্যান্ড পারেনি। এখনও ইংরাজিই সেখানকার সরকারি ভাষা।
আসি বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ নিয়ে। ভাষা-আক্রমণের জেরে সমধর্মী একটি দেশ ভেঙে গেল।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা মায়ের সন্তানরা তাদের মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠায় নিজের বুকের রক্ত দিয়েছিল। তেমনি ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতেও ১১ জন শহীদ হন। আবার হিন্দিকে মানভূম জেলায় রাজভাষা ঘোষণা করা হলে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাভাষাকে বাঁচানো সম্ভব হয়। ১৬টি থানা নিয়ে নতুন পুরুলিয়া জেলার জন্ম হয় এবং ১ নভেম্বর, ১৯৫৬ সালে এই নতুন জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের অংশ বলে মেনে নেওয়া হয়।
জয় হয় মাতৃভাষার। বাংলাও তেমনি অন্যের মাতৃভাষাকে মর্যাদা দিয়েছে। ২০১১ সালে আমাদের রাজ্যে সাঁওতালিকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মর্যাদা পেয়েছে কুড়মালি ভাষাও।
যাইহোক, মোটকথা দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে মাতৃভাষার কোনঠাসার বিরুদ্ধ লড়াই আন্দোলন বিশ্বজুড়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছে মাতৃভাষা-প্রাণ সন্তানেরা।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments