অ্যাপের নাম বাবাজী (শেষ পর্ব)/বাসুদেব গুপ্ত

অ্যাপের নাম বাবাজী 
বাসুদেব গুপ্ত

শেষ পর্ব  
 
 শিখা অবশেষে কথা বলেছিল। রূপম রতু অর্ণব সবাইকেই দূত করে পাঠিয়েছে। টেক্সট করে করে হাত ব্যথা করে ফেলেছে  শিখা জবাব দেয়নি। বলল যেদিন লোকিকে কম্পানী থেকে বার করে দেওয়া হল। মিঃ চোরারিয়ার মেয়ের বিয়েতে বরযাত্রীদের ম্যানেজ করার জন্য তিনি অনুরোধ করেছিলেন একটু কামপানী থেকে ম্যানপাওয়ারের জন্য। লোকি ডাকাবুকো ছেলে। ওকেই ওনার পছন্দ। কিন্তু লোকি সোজা মুখের ওপর জানিয়ে দিল ও পারবে না। ও কারো ব্যক্তিগত চাকর নয়, কম্পানীর এক্সিকিউটিভ।
-একজিকুটিভ। হা হা হা। চোরারিয়ার হাসি আর থামতে চায় না। ওকে বলুন ইংরেজীতে কথাটা একবার লিখতে। আপনি ওকে ছাড়িয়ে দিন। এরকম লোক দিয়ে চলবে না ।
রূপম শিখেছে যে আধুনিক ব্যবসায় লাইফেরই কোন দাম নেই। একজনের কাজ গেল কি এল কিছু যায় না। এই তো সেদিন এক সি ই ও ৯০০  জনকে জুম মিটিঙে ডাকলেন। ডেকে বললেন আমাদের কম্পানী এখন নতুন সিস্টেমে নতুন টেকনলজি ব্যবহার করবে। তাতে এক বছরে টার্নওভার ডবল হবার টারগেট। সেই সংগে বললেন যদি আপনি আজ এই মিটিঙে যোগ দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার চাকরীটা আজ থেকে টারমিনেট করে দেওয়া হল। গুড বাই।
 লোকিকে গুডবাই করার পরে  শিখার ফোন এলো।
-তুমি ওকে তাড়িয়ে দিলে? সবে বিয়ে করেছে, ভীষণ বিপদে পড়বে।
কথা শুনে কে বলবে  শিখার সংগে এক বছর কথা হয় নি। এতটা স্বাভাবিক কি করে থাকতে পারে। ভেবে অবাক হয়ে যায় রূপম। কিন্তু ওর বলার কিছু ছিলো না। সত্যি কথাটাই বলল। 
-টাকার পেছনে দৌড়তে দৌড়তে কোথায় চলে যাচ্ছো একবার ভাবছো কি? 
 রূপম বলার চেষ্টা করন
-তুমি কেমন আছো? শরীর ভালো?
কথার মাঝেই ফোন কাট। একবার জিগ্যেস পর্যন্ত করল না আমি কেমন আছি। লোকির জন্য চিন্তা। অথচ! 
সেদিন অফিস না গিয়ে সারাদিন বাড়ীতেই কাটাল রূপম। ফোন ধরল না। আর জানতো পারলো না যুধিষ্ঠির সেদিন দলবল নিয়ে চলে গেছে একদল অনশনকারীদের পিছন থেকে বোমা মেরে তুলে দিতে।

পরের দিন জানতে পারল ব্যাপারটা। সেদিনের টপ বাজী ছিলে অনীতা সোরেন তার অনশন তুলবে কি না। তিরিশ দিন ধরে অনশন চলছিল। পুরনোকালের জমিদারের পেয়াদার জায়গা নিয়েছে এখন শান্তি রক্ষা বাহিনী। পাঁচশো লোকের ভিটেমাটি তুলতে হবে কারণ তার নীচে পাওয়া গেছে কালো সোনা। নতুন বিটামিনের খনি। এক রাত্রি।  কয়েকটি বুলডোজার। বিক্ষিপ্ত গুলি। কিছু মানুষ বেপাত্তা। বড় খালের জলে ভেসে যাওয়া কিছু বডি। নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশে এমন আকছার হয়। প্রতিবাদ অনশনও নতুন কিছু নয়। নতুন ছিল বাজী। 

অনশন তুলবে নার স্বপক্ষে বাজী ধরেছিল কয়েক লক্ষ। ঊঠবের স্বপক্ষে বাজী ধরেছিল বাবাজীর হিডন সেল। কয়েকটি বোমা এবং অনীতা সোরেনকে যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নকুল সহদেব পাঁচ ভাই ধর্ষণ করল খুব সাবধানে যাতে প্রাণে না মরে যায়। অগত্যা পুলিশ যখন এলো স্টেটমেন্ট নিতে অজ্ঞান অবস্থায় কি বলেছিল সেটা আর কে প্রমাণ করবে। বিশ্বাসের ওপরেই দেশ চলে। প্রমাণে নয়। যখন সব প্রধান কাগজ ও টিভি চ্যানেলে বেরোল অনীতা সোরেন দলবল নিয়ে থানা চড়াও হয়েছিল এবং মারপিট করে তিনি আহত তখন অনশন আর চলে কি করে। অনশন শেষ।  অনশন মঞ্চ ফাঁকা। বাজীর সব চেক বাবাজীর ঘরে।

লোকির বদলে এখন কাজ করে সহদেব ঠাকুর। কোন এক ইউটিউবে নাকি দেখা গেছে অনীতাকে ও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম নিষিদ্ধ বিষয় আপলোড করার জন্য যথারীতি সেটা ব্লক হয়ে গেল। তারপর একদিন শেনো গেল সিটিবাজানো এই সাংবাদিকের সিটি বেজে গেছে। খবরটা সহদেবই এসে দিয়েছিল সংগে এনে দিয়েছিল এই মেথ। মেথি নয় দাদা। হা হা করা হেসে বলে গিয়েছিল মাথা কিন্তু ঠান্ডা করে দেবে।
রূপম ফোন করল ঠিক ভোর ছটায়।  শিখার ওয়ারক আউট শুরু হবার আগে। অবাক হল না শুনে শিখার গলার স্বর।   অপরপ্রান্তে হঠাৎ আশাভৈরবীর মত বেজে উঠল। ফোন করার আগে ওর মন বলেছিল পার আছে, আজ পার ছুঁতে পারবে। হয়ত মেথের নেশা। হয়ত টেলিপ্যাথি।

- শিখা আমি এই কম্পানী ছেড়ে দিতে চাই। আমি চাই তুমি আবার ফিরে এসো। আমরা নতুন করে আবার কিছু করতে পারি না?
ওপাশ থেকে ভেসে আসে কঠিন সরোদের দমক
-তুমি আর ফিরতে পারবে না আমি জানি রূপমদা। তুমি শেষ হয়ে গেছ।
-তুমি থাকলে আমি সব পারি।
-আমি বিশ্বাস করি না। আমি ছাড়ছি। ভাল থেকো।

রূপমের মনে হয় কি যেন একটা হতে চলেছে। ওর কোন ক্ষমতা। েই তাকে আটকাবার।
গরু স্বর্গে গিয়েও ভালো লেখক পেলে গাছে ওঠে। ঢেঁকি স্বরগে গিয়েও ধান ভানে। মাতাল বাপের শ্রাদ্ধতেও মাল খেয়ে মন ভালো করে। 
রূপম ঠিক করলো সুইসাইডই করবে। পালাতে হবে। এই গ্রহে কোথাও তার আশ্রয় আর রইল না। এলন মাস্ক এখনও মঙ্গলে পা দেন নি। তাই যথা ইচ্ছা তথা যা ভেবে রূপম ঠিক করল এবার গুডবাই করার সময় হয়েছে। যদি ও বিবেক দংশনের জন্য মিডিয়াতে গিয়ে স্বীকারোক্তি করে তবে দেশের আইন তাকে ছাড়বে না। সরকার নিজের সততা ও ক্ষমতা দেখানোর এমন সুযোগ কি ছাড়ে। আবার প্রসুনকে গিয়ে যদি বলে তোমরা আমাকে এই অন্যায় থেকে মুক্তি দাও তাহলে নিশ্চয় ঐ পঞ্চপান্ডব পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে। তারপর কোন একটা বদনাম করে বোর্ড রেজলুশান করে বার করে দেবে কম্পানী থেকে। বাড়ীর এত টাকার ই এম আই দিতে গেলেই পথে বসতে হবে। 
কিন্তু এর মধ্যেও  শিখাকে না নিয়ে এলে ওর চলছে না। ওর ডেথ শুধু বোকার মত মৃত্যু হোক এটা মন স্বীকার করতে চায় না। একটা স্টেটমেন্ট করে যেতে হবে। বিশ্ব সংসারের কাছে। ওর ভালোবাসার। সার্ভারে লগ ইন করার আগে এক স্নরট টেনে নিতে মাথাটা টিউনে এসে গেল। চারদিক মোলায়েম গোলাপের গর্ভকেশরের মত ভিজে নরম। বেট চালু করার পাসওয়ার্ডটা টাইপ করল। 53 48 49 4B 48 41 । 

রাত বাকী থাকতেই বাবাজীর লক্ষ লক্ষ সভ্যের ইমেলে ও হোয়াতে পৌঁছে যাবে এই মেসেজ। 

জ্যাকপট জ্যাকপট। জ্যাকপট। 
আজকের টপ বেট। ১ টাকায় ১০ টাকা। বাজী ধরুন। ভাগ্য ফেরান।
নীচে লিংক। মোরাদাবাদের কুসুম খারে দশ লাখ টাকা জিতে ক্যানসার রোগী মাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। ভিডিও। 
তার নীচে কলকাতার শ্রাবন্তী সান্যাল দু লাখ টাকা পেয়ে শুরু করেছেন তাঁর নিজস্ব বুটিকস। 
জ্যাকপট ১ টাকায় ১০। 
আজকের বাজী বাবাজীর সি ই ও রূপম তাঁর ফিয়াসিকে প্রপোজ করলে সেটা একসেপ্ট হবে কি না। 
একসেপ্টে বাজী ধরুন। All the world loves the lover. বাজী ধরুন।

দ্বিতীয় বাজী। সুপার ডুপার জ্যাকপট।
রিফিউসড হলে রূপম সুইসাইড করবেন না ব্রেক আপ মেনে নেবেন?
এক টাকায় ৫০ এক টাকায় ৫০।

কারো কাছে পৌঁছবার আগে পুরো পেজটা চিরকাল  শিখার কাছে যেত ওর এপ্রুভালের জন্য। এখন আর তা হয় না।কিন্তু সফটওয়ার পাল্টানো আর হয়ে ওঠে নি।  শিখার কাছে মেসেজ যায় প্রতিদিন। আর তাই থেকেই ও জানতে পারে রূপম কেমন তলিয়ে যাচ্ছে চোরাবালিতে। আজকেও গেল।  শিখার শরীরে কয়েক হাজার ভোল্টের শক লাগল। মনে হল এক নিমেষেই চারদিকটা বাজ পড়ে ছাই হয়ে গেছে। পৃথিবী বলে আর কিছু নেই। শুধু ও দাঁড়িয়ে আছে একটা কার্টুন তালগাছ হয়ে যার প্রতিটি পাতাই দীঘল সবুজ।
রূপমকে ও কিছুতেই হ্যাঁ বলতে পারবে না। কোটি টাকা দিলেও নয়। আর মরে গেলেও নয়। কিন্তু রূপম নেই সে পৃথিবীতে ও থাকবে কি করে?
মেসেজ হ্যাক করা ওর স্পেশালিটি। পাসওয়ারডটা কি এখনও একই আছে? ৪২ 53 48 49 4B 48 41 ।  SHIKHAর বাইনারী কোড। উদগ্রীব হয়ে টাইপ করে। সাইট খুলে যায়। পাসওয়ারড পালটায়নি দেখে হঠাৎ দুচোখে ঝেঁপে বৃষ্টি নামে এই শীতের রাতে। 
দু একটা ফোঁটা ভিজিয়ে দেয় রুক্ষ কীবোর্ড। মুছতে গিয়ে মাউসটাও ভিজে সপসপ করে। কিন্তু কাজ থামায় না। 
নতুন বাজী তৈরী হয়। একটু কথাগুলো পাল্টে।
তৃতীয় বাজী। সুপার ডুপার জ্যাকপট।
রূপম সুইসাইড করলে রূপমের ফিয়াসিও সুইসাইড করবেন?
এক টাকায় ৫০ এক টাকায় ৫০।

পরের দিন দাবানলের মত ছড়িয়ে যায় এই বাজী। কোটি কোটি মানুষ বাজী ফেলে। সবাই বাজী ফেলে, আশ্চর্য নির্বেদ ফুটে ওঠে বাজির মধ্যে। রূপম রিফিউসড হবে, সুইসাইড করবে ও তার ফিঁয়াসিও সুইসাইড করবে। সবাই উদ্গ্রীব। কখন সেটা হবে। ফেসবুক লাইভে কি সুইসাইড দেখা যাবে? অজস্র কমেন্ট আর প্রশ্ন। কাস্টমার সারভিসের চ্যাটবট ক্র্যাশ করে গেল।

এইখানে এসে গল্পকারের হল মুশকিল। কথা ছিল দুজনেই সুইসাইড করবে। হাতের শিরা কেটে একজন। আর একজন তাকে বাঁচাতে না পেরে ২৫ তলার ফ্ল্যাট থেকে পাখির মত ভেসে যাবে। ওদিকে বেজে যাবে যোশিজির ফোন।গ ল্পটা দারুণ ক্লাইম্যাক্স হতো। 
কিন্তু গল্পের ভবিতব্য অন্যরকম ছিল। রূপম ও  শিখা দুজনেই বাজী ফেলেছিল বেঁচে থাকার পক্ষে। জানত তা হবার নয়। ওদের দুজনেরই শেষ ঘনিয়ে এসেছে। তবু ভাগ্যের সংগে একটা শেষ কৌতুক করে চলে যাবার কথা ওদের কেন মনে হল তা এই কত্থকের বোঝা সম্ভব না।

ওরা দুজনে বেঁচে গেলে বাজীর পুরো টাকাটা ওরা পেয়ে যাবে এটা ওদের হঠাত খেয়াল হল সারাদিন বাজী ধরার  ট্রেন্ড ফলো করতে করতে। 

বাঙ্গালী হাঁদা ভাববাচ্যিক ইত্যাদি হলেও হঠাৎ বুদ্ধি জেগে ওঠে। ঠিক বিকেল পাঁচটা যথন সুর্য আর চাঁদের আকাশ সীমান্ত বিটিং দি রিট্রিট শুরু হয়েছে তখন দুজনেই দুজনকেই একসংগে ফোন করল। এবং দুজনেই পেল বিজি মেসেজ। বারবার তিনবার। রূপমের ফোনে ঝং করে মেসেজ নামল যোশির। সেটা দেখতে গিয়ে যেই একটুদে রী হয়ে গেছে  শিখার কল ঢুকে পডল এবং রূপমের হিয়ায় গিয়ে বেজে উঠল ঝালার মত। 
-বাজীর ট্রেন্ড দেখেছ?
-বাজীর ট্রেন্ড দেখেছ?
দুজনে একই কথা বলে ফেলে বুঝল আর কিছু বলার নেই। তাও মেয়েরা সহজে ছাড়ে না।
-কি সুইসাইড করবে?
-কেন তুমি রিফিউজ করবে?
-কেন তুমি প্রপোজ করবে?
-ফোনে?
-এখানে চলে এসো। সামনেই ভালো।
ওরা যে কয়েক মিলিয়ন ডলার জিতে নিল এই ফাঁকে সেটা নিশ্চয় আপনাদের বিশেষতঃ যাঁরা এখন বিটকয়েন ও শেয়ার নিয়ে গবেষণা করছেন তাঁদের চোখ এড়ায়নি।
রূপম রিজাইন করার পরে বাবাজীর কি হলো? কি আবার? বাবাজীরা আবার তপস্যা করতে চলে গেলেন। আর কি?  হিমালয়ের বরফে মাঝে মাঝেই তাঁদের পায়ের ছাপ দেখা যায়। যতদিন না তাঁরা তপস্যা ভাঙ্গেন আমাদের স্বস্তি।
রূপম ও শিখা ওদের টাকা দিয়ে একটা রিসারচ ল্যাব খুললো কলকাতায়। এই প্রথম। এখানে মানুষ ধরে ধরে এদেশ ওদেশ পাঠানো হবে না। সত্যি কারের এ আই নিয়ে কাজ হবে, যা দিয়ে নতুন ভাইরাস আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভ্যাক্সিনের ফরমূলা বার করা যাবে। 

শেষ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments