জ্বলদর্চি

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ- ৭/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ৭

গজল – তারানার পরে এলো গজল গান। খেয়ালের মত গজল ও একটি পারসিক শব্দ। ভারতবর্ষে গজল গানের প্রচলন করেন আমীর খসরু। গজল প্রধানতঃ প্রেম বা ভালোবাসার গান। বহু বিখ্যাত কবি গজল গান রচনা করেছেন - যেমন মির্জা গালিব, জওক, অরজু প্রভৃতি। কাজী নজরুল ইসলামও উর্দু গজলের অনুকরণে বাংলা ভাষাতে গজল গান লিখেছেন। প্রেমের গান গুলি প্রধানতঃ টপ্পা ও ঠুমরীর জন্য নির্দিষ্ট রাগে গাওয়া হয়।                   

  ভজন - গজলের পরে এলো ভজন গান। ভজন প্রধানত ভক্তিরসাশ্রিত গান অর্থাৎ ভক্ত সাধক তাঁর আরাধ্য দেবতার উদ্দেশ্যে যে গানের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি রচনা করেন সেগুলিই ভজন গান। যেমন তুলসীদাস, কবীর, মীরাবাঈ, সুরদাস, ব্রহ্মানন্দ প্রভৃতি। অন্তরের আকুতি মিশিয়ে পাণ্ডিত্যের অহংকার বর্জন করে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পনের এই গান।                  

  লোকসঙ্গীত - প্রকৃতির মাঝে গ্রামের সাধারণ মানুষ হৃদয়ের আবেগে স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে যে গান রচনা করে গেয়ে থাকেন সেগুলিকেই লোকসঙ্গীত বলা হয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সুরে গানগুলি গাওয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের সুরকে মার্জিত করে পরবর্তীকালে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনেক রাগ তৈরী হয়েছে।             

  ভারতে ব্রিটিশ শাসনাধীন এলাকা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথেই একশ্রেণীর নতুন জমিদারদের উদ্ভব হলো যাদের তালুকদার বলা হত। এই ধনী তালুকদারেরা উচ্চমার্গীয় ধ্রুপদের প্রতি অনাগ্রহ দেখানোর ফলশ্রুতি স্বরূপ ঠুমরী গান তাদের রুচিবোধ অনুযায়ী জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই জমিদারদের নিজস্ব আসরে দু'ধরনের নাচের অনুষ্ঠান হত -  কণ্ঠসঙ্গীতসহ এবং কণ্ঠসঙ্গীত ব্যতীত। নৃত্য ও কণ্ঠসঙ্গীত সহযোগে ঠুমরী ও দাদরা (দ্রুত লয়ের ঠুমরী) গজল ও ভজন গান গাওয়া হতো। কণ্ঠসঙ্গীত ছাড়া যে নাচ হত তাকে 'গৎ' বলা হতো, যার বৈশিষ্ট্য ছিল দ্রুত ও মসৃণ অঙ্গ সঞ্চালন, নির্দিষ্ট ছন্দ ও তালের  কাঠামোয় গৎ সৃষ্টি করা হত এবং এই প্রকার নাচের সময়ে তাল বজায় রাখার জন্য তবলচি ও সারেঙ্গী বাদকের প্রয়োজন হতো। সারেঙ্গী বাদ্যযন্ত্রে অনেক সময় 'লহেরা' নামে একটি সুরেলা কাব্য পুনরাবৃত্তি করা হতো যার সঙ্গে তালের একটি নির্দিষ্ট সময় চক্রের যোগ ছিল। গৎ আগের থেকে রচনা করা থাকত এবং এর প্রধান দৈহিক অঙ্গ সঞ্চালনা অংশটির উদ্ভব ঘটেছিল লখনৌতে, যাকে 'লক্ষ্ণৌ ঘরানা' বলা হয়। এই ধরনের নাচে নৃত্যশিল্পী গানের একটি লাইন গাইতেন এবং জাজিমে বসে মুখের ভাব ও অঙ্গ সঞ্চালনার মাধ্যমে সেই লাইনটিকে পরিস্ফুট করতেন এবং তারপরে নাচের জন্য পুনরায় উঠে দাঁড়াতেন। বেশিরভাগ গনিকাই সঙ্গীত ও নৃত্য দুটিতেই পারদর্শী হতেন। এদেরকে বলা হত 'জান', যেমন, হায়দার জান, মালকাজান বা গহরজান। আবার যেসকল গায়িকাদের ভঙ্গিমা নাচের উপযুক্ত ছিল না বা যারা গানের কথাকে ভাবের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার জন্য ঠিকভাবে চোখ, হাত বা সূক্ষ্ম কাঁধের পেশির সঞ্চালন করতে পারতেন না তাদের বলা হতো 'বাঈ'। এক্ষেত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর জোহরা বাঈয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। খেয়াল গানের ক্ষেত্রে জোহরা বাঈ একজন অতুলনীয় শিল্পী ছিলেন যার খেয়াল গাইবার গায়কী সেই সময়ে সবচেয়ে সেরা বলে মনে করা হতো। তিনি একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে একটি রাগের রূপ সুন্দরভাবে পরিবেশন করতে পারতেন।                            

  উত্তর ভারতের দেহপসারিনীদের গণিকা বা বাঈজী বলা হতো। নবাবদের রাজত্বকালে আউধ এবং সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যে লক্ষ্ণৌয়ের উন্নতি এইসব বাইজিদের জীবনে এক স্বর্ণ যুগের সূচনা করেছিল। তারা সংগীত, নৃত্য, উর্দু ও ফারসী ভাষায় কাব্য, সাহিত্য রচনা ইত্যাদি সব বিষয়ে পারদর্শিতা লাভ করে এবং চর্চার মাধ্যমে এই শিল্পকে নিখুঁতভাবে পরিস্ফুট করতে পারত। ঐতিহ্যপূর্ণ ও সম্মানিত পরিবারের মহিলারাও বাঈজীদের এইরূপ আভিজাত্যপূর্ণ বিলাসবহুল জীবনের প্রতি ঈর্ষান্বিত হত।                     

  নিজেদের বংশ-পরম্পরা নিয়ে বাঈজীদের অত্যন্ত গর্ব ছিল। তারা মনে করত দেবরাজ ইন্দ্রের সভা থেকেই তাদের বংশের উৎপত্তি এবং তাঁরা নিজেদের গন্ধর্ব বা উর্বশী বলে অভিহিত করতো। আসলে এই গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের তিনটি ধারা ছিল - গন্ধর্ব, কিন্নর এবং রাজমণি, যাদের নামের আদি উৎস ছিল সংস্কৃত পুরানে। ফলে বাঈজীরা মনে করত তারা এই স্বর্গীয় শিল্পের একমাত্র ধারক ও বাহক, যা তাদের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিক লাভ করে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে সমস্ত অনুষ্ঠানগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। এখানে একটি জিনিসের উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ঐতিহ্যশালী সম্মানীয় গৃহস্ত ঘরের মেয়েদের কখনো প্রকাশ্যে নৃত্যগীতের শিল্পচর্চা করার অধিকার ছিল না। কিন্তু বাঈজীদের কাছে এই শিল্প চর্চা ছিল নিজস্ব সম্পত্তির মত এবং যারা এই শিল্পচর্চা করে সাফল্যের শীর্ষবিন্দুতে পৌছাবার চেষ্টা করত তারা একদিন সেই লক্ষ্য পূরণ করতে সমর্থ হত। যারা পরবর্তীকালে জীবনে স্থিত হতে চাইত তাদের কাছে মুক্ত বিবাহের পথ খোলা ছিল। আবার অনেকে একাকী স্বাধীন জীবন যাপন করতে চাইতো এবং তারা সেটাও করতে পারত। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য বাঈজীরা মুক্ত বিবাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। সমাজের সবচেয়ে ধনী এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির সাথে তাদের মুক্ত বিবাহ হত এবং তারা তাদের রক্ষিতা হিসেবে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি অতিবাহিত করত। দৈহিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে পরিশীলিত সৌখীন আচার আচরনের জন্য তারা সমাজের বহু পুরুষের কাম্য ছিল।               
                                                                                                 ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments