কোলবালিশ অথবা তৃতীয় জন
শ্রীজিৎ জানা
শ্রুতিমধুর মিউজিক বেজে উঠবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। তারপর ঘড়ির দিকে চোখ মেলা যেতে পারে। ঘন্টা এবং মিনিটের কাঁটার অবস্থান জানাবে এখন রাত একটা। মিতুলের ঘুম ভাঙবে। ঘরে হালকা নীল আলো। সমুদ্রের নীলচে জল যেন মৃদু ঢেউ খেলছে দেয়ালময়। বিছানার প্রান্তরে। টেবিলে ঢাকনা দেওয়া কাচের গ্লাস। তার ভিতর স্ফটিকস্বচ্ছ জল। কয়েক ঢোক জল মুখে নিয়ে মিতুল সোজা যাবে বাথরুমে। তারপর ফিরে এসে দাঁড়াবে বারান্দায়। আকাশের দিকে চোখ রাখবে অনিমেষ দৃষ্টিতে। কত কিছু যেন খুঁজতে চাইবে মিতুল। পুনরায় ফিরে আসবে বিছানায়। বাসব তখনো ঘুমে অচেতন। তার কোলের কাছে জাপটে ধরা হয়ে আছে নরম কোলবালিশ, আলিঙ্গনের ভঙ্গিমায়! যেন চরম আদরে জড়ানো। নারী শরীরকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে একজন পুরুষ ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে। অথবা যেভাবে একটি বিরুৎ লতা জড়িয়ে ধরে তার অবলম্বন, বাসব কোলবালিশকে জড়িয়ে আছে সেভাবে। এবার মিতুল নিজেকে বিছানায় ছড়িয়ে দেবে। তার মুখ ভঙ্গিমায় আলতো বিষাদের ছায়াছবি। এবার সে পাশ ফিরে ঘুমোবে। চোখের পাতা দুটোকে জোরপূর্বক বন্ধ করতে চাইবে। যদিও চোখ সাড়া দেবে না, ঘুমোতে চাইবে না।
মনও তার ঘুমোবে না। এখন তার দূরের সফর শুরু।
প্রথমেই মনের গন্তব্য কলেজ ক্যান্টিন। সেখানে দুএক প্রস্থ আড্ডা হবে কলেজ ফ্রেন্ডদের সাথে। সেখান থেকে কাঁসাইয়ের পাড় ধরে হেঁটে যাবে দুজনে। এই দৃশ্যে কথামতো ঢুকে পড়বে বাসব। ব্রাইট রেজাল্ট বাসবের পকেটে। অনেকগুলো কমপিটেটিভ পরীক্ষা দিয়েছে ইতিমধ্যে। বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ। ব্রাউন এনভেলাপ বাড়িতে আসা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এসব হাবিজাবি লাল নীল কথার ফুল্লকুসুমদলে দুজনে সাজাবে স্বপ্নের ফ্লাওয়ার ভাস্। শহরের মাঝখানে আদরের একটা বাড়ি হবে। যার ছাদ থেকে সায়াহ্ন বেলায় রোদ্দুরকে বিদায় জানাবে মিতুল। প্রভাতী নমস্কারে স্বাগত জানাবে কুসুমময় আলোকে। সেই ঘরের
বিছানার পাশটিতে টেবিলে ঠাঁই পাবে স্বপ্নের ফ্লাওয়ার ভাস্। তাতে ভালবাসার মুকুল জন্মাবে একদিন। ঘরময় হাস্য কলরোলে মেতে উঠবে মুকুলের রুনুঝুনুতে;আহ্লাদভরা সুবাসে।
কখন এরই ফাঁকে সময় পাড়ি জমিয়েছে ঘণ্টা দুয়েকের পথ! ঘুম থেকে জেগে উঠবে বাসব। বিছানার উপর হাঁটু মুড়ে খানিকক্ষণ বসবে সে। মুক্ত পদ্মাসন। তারপর বেশ কয়েকটা আলসেমির হাই তুলবে সশব্দে।হাতের তালুর উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ দুটোকে রগড়ে নেবে কয়েকবার। চোখের তারায় লেগে থাকা ঝাপসা ভাব মিলিয়ে যাবে। পাশে মিতুল তখন কাত হোয়ে শুয়ে রয়েছে। মিতুলের নিদ্রাভঙ্গিমা বেশ গোছানো। সাধারণত এমন করে পরিপাটি কেউ ঘুমায় না। প্রথম দিকে বাসবের সন্দেহ হত। মিতুল কি সত্যিই ঘুমোচ্ছে? নাকি ঘুমের ভান করে তাকে চমকে দেবে হঠাৎ উঠে। এমন তো বিয়ের পরে পরেই কতবার করেছে সে। আজকাল কেন এমন করেনা তা বাসবের অজ্ঞাত। কি আশ্চর্য নিদ্রামগ্ন মিতুলের শরীরী আবেদন! অপরূপ ভাস্কর্যের মতো খোদাই করা নিটোল শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ! মিতুল এখন চুম্বক! বাসবকে যেন দুর্নিবার ভাবে টানছে তার দিকে। বাসক যেতে পারছে না। মিতুল আর তার মাঝখানে পর্বতপ্রমাণ একটা কোলবালিশ।
সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা নিয়ে সোজা হাজির হবে চিলতে বারান্দায়। খানিকটা সময় দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বাসব। যতক্ষণ না একটা ফ্লেক ধিকিধিকি করে পুড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে শূন্যে মিলে যায়। ছাই হয়ে যায়। এরই মাঝে বেশ কয়েক বার চোখ চলে যাবে পাশের বাড়ির একটি আলোকিত জানলার দিকে। পর্দার ওপারে মায়াবী সবুজ আলো। জানলার পর্দা ভেদ করে বাইরে আসছে একজোড়া ছায়ামানুষ! এ প্রান্তে একাকী বাসব। ছায়ামানুষ দুজন দাঁড়িয়ে আছে মৈথুন ভঙ্গিমায়! মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার মূর্তিগুলো যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। বাসব ঘনিষ্ঠ হতে চায় কিন্তু পারে না। মাঝখানে জমাট অন্ধকার। সেই কালো অন্ধকারের অবয়ব যেন কোলবালিশের মত দীর্ঘ এবং স্ফীতকায়।
আজ শুক্রবার। দেয়ালঘড়ির বেজে ওঠার সুরে জলতরঙ্গের মূর্ছনা! ঘন্টা ও মিনিটের কাঁটার দাঁড়ানো কেতায় এখন রাত্রি একটার সূচক। রোজকার মত মিতুল দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণের বারান্দা। কোন আলো জ্বালায়নি সে। সামনে দলা দলা অন্ধকার! অন্ধকার সমগ্র নিসর্গ জুড়ে, এমনকি তার মনের অন্দরেও। হাতের মুঠোয় বারান্দার স্টিলের গ্রিলটাকে আলগা করে ধরা। শক্ত করে ধরতে চেয়েও পারছে না যেন কিছুতেই। আজকাল মিতুল কোনকিছুকেই শক্ত করে ধরে রাখতে পারে না। বাসবকেও বোধহয় পারছে না!অথবা হয়তো এসব তার মনের ভ্রম। চোখের সামনে হঠাৎ করে ভেসে ওঠে বাসবের মুখ।
এখন বাসব নিশ্চিন্তে কোলবালিশ আঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। কোলবালিশ তার নির্ভরতা,তার প্রেম, তার শয্যাসঙ্গিনী। কিছুতেই কোল বালিশ ছাড়া আজকাল বাসব ঘুমোতে পারে না। মিতুলের দৃঢ় ভাবনা, সে না থাকলেও বোধহয় চলে যাবে কিন্তু ফুলতোলা নরম কোলবালিশ ছাড়া বাসব রাতে চোখের পাতা এক করতে পারবে না। বালিশের পাহাড় ডিঙিয়ে কখনো-সখনো যৌন ইচ্ছেরা চরম ক্ষুধা নিয়ে ছুটে আসতে চায় পরস্পরের দিকে। হয়তোবা সেগুলো শারীরিক অভ্যাস। তাকে সঙ্গম বলে না, প্রেম বলেনা।তাকে উদরপূর্তি বলা যেতে পারে। দু'দন্ডের উত্তেজক অনুভূতি। কোলবালিশকে নিয়ে বাসব যেভাবে ঘুমের ঘোরে দুমড়ে-মুচড়ে আদর করে আরাম খোঁজে, ঠিক সেভাবেই মিতুল একটা কোলবালিশ হয়ে উঠতো প্রচন্ড ক্ষুধার কাছে। এখন তেমন ক্ষুধার তাড়না অনুভব করেনা বোধহয় দুজনেই।
অথচ মিতুল খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক পেরিয়ে জ্যোৎস্নার আলো মাখতে চায়। ভিজতে চায় নরম বৃষ্টিতে। সারারাত একটা আদরের পানসি নৌকার মতো বাসবের বুকের চরে বাঁধা থাকতে চায়। কিন্তু বাধ সাধে কোলবালিশ। আজকাল ফুলতোলা কোলবালিশ মিতুলের চোখের বিষ। ধীরে ধীরে কোলবালিশ একটা চেহারা নিয়েছে মিতুলের চোখে। একটা নারী শরীর। সুন্দরী, প্রচন্ড স্মার্ট! শ্রাবণী বাসবের অফিস কলিগ। শ্রাবনীর কথা বাসবের মুখে বর্ষার ধারার মতো অনর্গল ঝরে পড়ে। তিন বছরের ডিভোর্সি। শ্রাবনী কাছে এলে নাকি আপনা থেকেই সবাই প্রগলভ হয়ে উঠে। অফিসের অনেকেরই সে আকাঙ্খিতা। এসব বাসব পরোক্ষ উক্তিতে মিতুলকে শোনায়। কিন্তু শ্রাবণী বেশি করে ঘনিষ্ঠ থাকতে চায় বাসবের। শ্রাবণী চ্যাপ্টার নিয়ে অনেকবার ডাইনিং টেবিলে নাড়াচাড়া হয়েছে মিতুল আর বাসবের মধ্যে।সেক্ষেত্রে বিভিন্ন রসালো রেসিপি বানিয়ে জোর করেই শুনিয়েছে মিতুল বাসবকে। অথবা না শোনার ভান করে বাসবও শুনতে চেয়েছে সেসব রগরগে ধারাভাষ্য। এক চিমটি শ্রাবনীর উষ্ণতাভরা দৈহিক উপাদান আর কয়েক চিমটি বাসবদের সেক্সচুয়াল অ্যাট্রাকশান মিশিয়ে দুর্দান্ত হট কফি সার্ভ করে মিতুল। প্রথম প্রথম এসবের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত ভাল লাগার খোরাক খুঁজে ফিরতো মিতুল। দুজনের সংসারে একটু মাইন্ড ফ্রেশ করার ট্রিক হিসেবেএসব কথার জাল বুনে হালকা চালে ইয়ার্কি-ফাজলামি কোরতো। আজকাল কথাগুলোকে নিয়ে মিতুল মগ্ন হয়। হারিয়ে যায় নিরুদ্দেশে। নানা রকম ভাবনার অতলান্ত সমুদ্রে ডুবে যায় মিতুল।
' অফিসের কলিগ শ্রীতনুর চোখে শ্রাবণী নাকি রহস্যময়'!
জয়ন্ত বলে 'খানিকটা ঐশ্বর্য রাইয়ের শরীরী আবেদন যেন শ্রাবনীর মধ্যে আছে'!
এসব কথা সন্ধ্যেতে ফিরে বাসব ইচ্ছে করেই মিতুলকে শোনায়। মিতুল নিরুত্তাপভাবে কান পেতে দ্যায়। কথাগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া করে। সবগুলো বাক্যের শেষে শুধু মিতুল হাজারটা বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা চিহ্ন বসিয়ে যায়।
কতদিন হয়ে গেল খিদেটা আর কোলবালিশ ডিঙিয়ে খাবার চাইতে আসে না। মিতুল ভাবে তার রহস্যময়তা ক্রমেই মিলিয়ে গ্যাছে তাহলে। এখন সে বহুশ্রুত, বহুবার পঠিত একখানা উপন্যাস। যার প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে নিয়েছে বাসব। নতুন করে পড়ার ইচ্ছে, মনোযোগ, আনন্দ ও শিহরন একেবারেই নেই তার। মাঝে কয়েকবার নিজেকে বাড়তি রূপটানে মায়াবী করে তুলতে চেয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝেছে এসবের মধ্যে আসলে সে নিজেকে সহজলভ্যা করে তুলতে চাইছে অথবা নিজেকে নিজের কাছে ছোট করে দিচ্ছে ক্রমশ। আর তারপর থেকেই বিছানার নিদ্রা ভঙ্গিমায় পরিবর্তন এনেছে মিতুল। বাসবের চোখে এই নিঃশব্দ বিপর্যয়গুলি ধরা পড়েনি।
বারান্দায় ক্যাকটাসের টবের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। কত ধরনের কাঁটা গাছ। মিতুল ভাবে একদিন বোধহয় পুরো ঘরটা কাঁটা গাছে ভরে যাবে! ইতিউতি দু-একটা হ্যাঙ্গিং অর্কিড ছাড়া আর কিছু নেই। তারাই যেন মন খারাপের দিনে স্মৃতির মতো সজীব করে রাখে ঘরটাকে। মিতুল নিজেও এখন কোলবালিশের এপারেই থাকতে ভালোবাসে। নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায়। নিজেকে দোষারোপ করে। কেন এত তাড়াতাড়ি সে আবিষ্কৃত একটি দ্বীপ হয়ে উঠলো বাসবের কাছে? কেন তার শরীর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল নারীত্বের মায়াবী রহস্যময়তা? গর্ভাধানে জমা হচ্ছে গুচ্ছের পিলস। অথচ মিতুল তার শরীরের ভেতর ধারণ করতে চেয়েছে বাসবকে। বাসব কি কোনদিন নিজেকে রাখতে চেয়েছে মিতুলের মাতৃগর্ভে? সেকথা কখনো বিছানায় তোলপাড় করে প্রকাশিত হয়নি। শুধুমাত্র দীর্ঘ হয়ে উঠেছে ফুলতলা কোলবালিশ অথবা কোলবালিশের মত একটা নারীর শরীর!
কেন দু'বছরের বৈবাহিক জীবনের মাঝে কোলবালিশ চলে আসে? কেন ক্রমশ মিতুলের ভাবনার ভেতর জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে কখনো শ্রাবণী, কখনো মঞ্জুলা, কখনো ফুলতলা একটা কোলবালিশ! যাকে পেরিয়ে মিতুল পৌঁছোতে পারেনা বাসবের দরজায়।বীভৎস চিন্তা প্রত্যেক রাত্রে দাঁড় করায় এই চিলতে বারান্দায়। তাকে ভাবায়। আজও ভাবছে। সামনে তরল অন্ধকার। দু-একটা জোনাকি আলোর রেখা টেনে উড়ে যায়। জানান দ্যায় অন্ধকারেও আলো আছে। আলো খুঁজতে ছুটে যায় মিতুল বিছানায়, যেখানে অচেতন হয়ে ঘুমোচ্ছে বাসব। বোধহয় বাসব টের পায় না কোনকিছুর।
রুটিন মতো বারান্দা অপেক্ষা করছিল বাসবের আগমনের। এবার তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে একটা ফ্লেক্ জ্বলে উঠবে। মৃদু দহনে পুড়তে থাকবে সিগারেট। বাসবও বোধহয়! তার চোখের অপটিকে ভেসে উঠবে ফেলে আসা দিনের ছবি। ছবি মানেই মিতুল আর তাদের আদরের এই বাড়ি। মা-বাবা খুব ছোটবেলায় মারা গেছে তার।একা বাসবের আজকের যা কিছু তার পেছনে জ্যাঠামশাই- এর অবদানের শেষ নেই। সেই ঋণ বাসব জীবন দিয়েও শুধতে পারবে না। আজও সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। জ্যাঠামশাই- এর কাছে যায়। আর অবশিষ্ট যা কিছু তা সব মিতুলকে নিয়ে। অথচ আজ যেন দুজনে মূকাভিনয়ের কুশীলব। প্রয়োজনে কথা আসে দুজনের মুখে। দু'বছরের দাম্পত্য জীবনে কেন এমন হলো বাসব খুঁজে পায়না! কত কিছু ভাবনা আসে তার মাথার ভেতর। মিতুলের অহেতুক রাগ, নিছক সন্দেহ, তাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। জোর করে কোন কিছু পেতে চায় না বাসব। মন, শরীর কোনকিছুতে তার জবরদস্তি ভালো লাগে না। কেমন যেন দস্যুবৃত্তি বলে মনে হয়। কতবার এসব নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে চেয়েছে মিতুলের সঙ্গে। প্রসঙ্গ উঠলেই নানারকম কথার প্যাঁচে, জোরালো খোঁচায় তিক্ততার পরিবেশ তৈরি হয়ে ভেঙে গ্যাছে সাঁকো। শ্রাবণী, মঞ্জুলা তার অফিস কলিগ একথা সত্যি। তাদের সঙ্গে বাসবের যে খুব ভালো সম্পর্ক তাও মিথ্যে নয়। কিন্তু এর বাইরে আরও এক চরম সত্যি আছে যে সত্যের ভেতর তাদের এই আদরের বাড়ি আর সেদিনের স্বপ্নেরা পাখা মেলে উড়তে চায় দিগন্ত বেরিয়ে অসীমে। শত চেষ্টায়ও মিতুল তা শুনতে চায়না। জানতে চায় না। বাসব এক্ষেত্রে নিজেরও অক্ষমতা ভাবে। ধীরে ধীরে বিছানা একটা কোলবালিশ এর আগমন হয়। বাসব তাকে দুমড়ে-মুচড়ে নিজের অক্ষমতা কে প্রশমিত করতে চায়। ভেতরের অভিমান রাগ আর সন্দেহ কে শায়েস্তা করতে চায়। ফুলতোলা বালিশ তার কাছে সন্দেহবাতিক মিতুল। ভেতরে ভেতরে বাসব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নিজেকে সরিয়ে রাখে। মাঝের কোলবালিশ ক্রমশ পাহাড়ের রূপ নেয়।
একটা ঘরের ভেতর এভাবে কতদিন দুটো শরীর যন্ত্রের মতো হেঁটে চলে বেড়াবে? কেউ কারো ইশারায়, ইচ্ছের ডাকে সেভাবে সাড়া দেবে না? শরীর এভাবে টিকে না। মন এভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। বাসবের একাকীত্ব দীর্ঘ হতে থাকে।
আজ তাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। মিতুলের সেকথা মনে আছে কিনা জানতে চাইনি বাসব। প্রথম বারের মত বাড়িতে আজ কোন রকম আয়োজনের চিহ্ন নেই। পরস্পর যেন একে অপরের পরীক্ষা নিতে চায়। আজকে তাহলে বাসব নিজেই এগিয়ে যাবে মিতুলের কাছে! যেভাবে ঝড় নুইয়ে দিয়ে যায় দীর্ঘ গাছের মাথা সেভাবে বাসব আজ নত হবে! পরক্ষণে ঋজু হয় বাসবের আমিত্ব। মিতুলও তো আসতে পারে তার কাছে! বিছানায় পাহাড়টা ক্রমশ দীর্ঘ হয়।
অথচ একটা ভঙ্গুর পাহাড় তাসের ঘরের মতো সামান্য হ্যাঁচকা টানে ভেঙে যেতে পারে। তারপর দুটো শরীর, মন মিশে যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য লাগবে সজোরে একটা টান। তার জন্য চারটে হাত জরুরী। আজ নিদেনপক্ষে দুটো হাতেই চেষ্টা করবে বাসব। সে ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে একবার ঈষৎ নত হোতে চায়।ফ্লেকটা কখন নিভে গেছে খেয়াল করেনি বাসব। দূরের সেই বাড়িটা থেকে সবুজ আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। আর সেই মৈথুন ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো ছায়ামূর্তি। পা দুটো হাঁটা দ্যায় ঘরের দিকে। ধীরে ধীরে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। বিছানায় অপরূপ ভঙ্গিমায় ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে মিতুল! আরো একবার আজ এই জিজ্ঞাসা বাসবকে নাড়া দ্যায়। তার কোলের কাছে কোলবালিশ। মায়ের মতো পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে মিতুল।কিন্তু একি দেখছে বাসব! ফুলতোলা পাহাড়টা যেন ফুটফুটে একটা নরম ফুলের মত শিশু! কি সুন্দর তার শুয়ে থাকা।স্বর্গীয় আলোয় ভরে উঠছে ঘরখানা।আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে বাসব। মিতুলও বোধ হয় টের পাচ্ছে আসন্ন ঝড়ের।অতঃপর বৃষ্টিপাতের। ধীরে ধীরে বাসব বিছানার দিকে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে...।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments