জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা-১০/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 

সুরশ্রী ঘোষ সাহা 


দশম পর্ব - জীবনধারণের নানা পেশা


ছোটবেলায় যতবার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি, কত নতুন নতুন ধরনের ফেরিওয়ালা আসতে দেখেছি। যাদের কখনো শহরের বাড়িতে দেখিনি। কিংবা হয়ত আমি বড় হওয়ার সাথে সাথে শহরের পথ তাদের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শহর গ্রাম দিনে দিনে যত বেশি আধুনিক হয়ে উঠছে, বহু পেশাও কালের গর্ভে চিরকালের মতন হারিয়ে যাচ্ছে।

 'শিল কাটাও' ডাকটা গ্রামের পথে আজও টিকে থাকলেও, শহরে প্রায় কমে এসেছে। জেঠিমার বড় একান্নবর্তী সংসারে একটা বিরাট আকারের শিল আজও রোজ পাতা হয়। জানি না, গ্রামের ছোট সংসারগুলোয় তার ব্যবহার হারিয়েছে কিনা! 

 তখন আমার আট কী নয় বয়স। গ্রামের বাড়িতে রয়েছি। আমারই কাছাকাছি বয়সী দাদা-ভাইয়েরা দেখি হঠাৎ দুয়ারে কার আওয়াজ পেয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমিও ওদের পিছু নিই। শুনি, 'বদল বিস্কুট নেবে গো' বলে এক ফেরিওয়ালা হাঁকছে। সংসারে কাজ হারিয়ে ফেলা জমে থাকা শিশি বোতল, প্লাস্টিকের এটা ওটা পুরনো জিনিস নিয়ে ছোটভাইটা চলে এসেছে। সে'সব পোঁটলায় ভরে নিয়ে বিনিময়ে অনেকগুলো বিস্কুট দিয়ে গেল সেই ফেরিওয়ালা। 

 তখন গ্রামে সাইকেল এসে গেছে বাড়ি বাড়ি। একজন ফেরিওয়ালা আসত, হরেকরকম জিনিসকে একটা সাইকেলে সাজিয়ে নিয়ে। নানা জিনিসে তার বাহনটাই চাপা পড়ে যেত, দেখাই যেত না প্রায়। যার মধ্যে কীই-না থাকত, মেয়েদের সাজসজ্জার জিনিস থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর ও প্রয়োজনের নানা জিনিস। ডাকঘরের অমলের মতন আমিও গ্রামে গিয়ে বাঁকে করে ভর্তি হাঁড়ি নিয়ে দই-ওয়ালাকে হেঁটে আসতে দেখেছি।


 একটা ছোট টিনের বাক্স কাঁধে নিয়ে এক ফেরিওয়ালা আসত। যার ভিতর থেকে বেরুত শৈশবের খুশির কাঠি আইসক্রিম। ববি কুলপিওলাও তার ঠেলা গাড়ি নিয়ে হেঁটে যেত গ্রামের পথ ধরে। মটকা আইসক্রিমওয়ালা মাথা থেকে মটকার হাঁড়ি নামিয়ে বসে গলার গামছা দিয়ে ঘাম মুছত। মেয়েদের কাচের চুড়ি, কানের দুল, সিঁদুর-আলতা, টিপের পাতা সাজিয়ে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসত এক ফেরিওয়ালা। গ্রামের মেয়ে-বউরা মাথায় ঘোমটা টেনে বাড়ির বাইরে এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নেড়ে চেড়ে দেখত। কখনো সখনো একটা দুটো জিনিস কিনতও। মাথায় বিরাট ঝুড়িতে অ্যালুমিনিয়ামের ও স্টিলের বাসন নিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গ্রামে ঘুরত বাসনওয়ালা। আরেকটা নতুন ধরণের পেশার লোককে আসতে দেখেছি, যে গৃহস্থের দাঁতের পোকা বের করানোর জন্য আসত। এখন মিষ্টির দোকানে গিয়ে মানুষ মিষ্টি কেনে। কিন্তু তখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মিষ্টি নিয়ে আসত হালুইকর। যাদের ডাকা হত, 'খাবার ওলা'। 'বম্বে মিঠাই', 'বম্বে মিঠাই' বলে এক বিক্রেতা আসত, যে, বাচ্চাদের মনের মতন খেলনার শেপে নতুন ধরনের লজেন্স বানিয়ে দিত। জানি না, সেই জিনিসকে ঠিক লজেন্সও বলা যায় কিনা! সেসব এখন ভাবলে মনে হয়, অন্য কোন জগতের সব জিনিস। 

 কতরকমের খেলা দেখিয়েও যে রোজগার করা যায়, তা আগেকার দিনেই ঘটত। যেমন - রাজা আর রানী নাম দিয়ে একটা বাঁদর আর একটা বান্দরী নিয়ে এক মানুষ পথে পথে ঘুরত। তার স্পেশাল ডুগডুগি বাজানোর শব্দে শিশুরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসত। একজন কোন শিশু তার বাড়ির লোকের কাছে আব্দার করলে সেখানেই অন্য বাড়ির বাচ্চারা ছুটে এসে ভিড় জমাত। সামান্য এক পয়সা, কী দুই পয়সা করে বাচ্চাদের বাবারা দিয়ে যেত, বাঁদরওয়ালাকে। সাপুড়েরাও বীণ-বাঁশি কী তুবড়ি বাঁশি বাজিয়ে ঝুড়ির ভিতর থেকে বিষধর সাপ বের করে খেলা দেখাতে আসত। সেই ফণাওলা সাপ যে শুধু তাদের পেশার জন্য ছিল তা নয়, দিনে দিনে অমন বিষধর সাপেরা তাদের সন্তানের মত হয়ে উঠত। কী অদ্ভুত ভাবে যে তারা পোষ মেনে যেত, ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। 

 তখন রূপালি জগতের দুনিয়াকে মানুষের দোরে দোরে ঘুরে দেখাতে আসত আরেক ভিন্ন পেশার মানুষ। যার কাছে থাকত, একটা ছোট বাক্স। সে সেই ম্যাজিক বাক্সের গায়ের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সিনেমা দেখাত। ছেলেমেয়েরা একটা চোখ বন্ধ করে দূরবীনের মতন অংশটায় যখন অপর চোখ রাখত, দেখতে পেত অন্য এক রঙিন দুনিয়াকে। এক চোখ দিয়ে দেখার জন্য অমন সরে সরে যাওয়া তাজমহল, কুতুবমিনার, পাহাড়, কী টয় ট্রেনের ছবি দেখার ছোট্ট বাক্সের মতন খেলনা পরবর্তী সময়ে বাজারেও পাওয়া যেত। বহুকাল আগে যদিও সেটাও অতীত হয়ে গেছে।

 আজ ভাবতে অবাক লাগে, তখন কত অল্প ছিল মানুষের চাওয়া-পাওয়া। কত অল্পেই ছিল মানুষের প্রাণ ভরা সুখ। এখন একটা শিশুর মন কোন খেলনাতেই ভরে না। শুধু আরো চাই, অন্য চাই ভাব। পেলেও শান্তি নেই। বেশিক্ষণ কোনো জিনিসেই মন টেকে না। সন্তুষ্টি জিনিসটাই বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার ভিতর থেকে হারিয়ে গেছে। 

 আলতা পরানো মাসি আসত তখন বাড়ি বাড়ি। দুপুরবেলা বাড়ির মহিলারা খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে, সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে দাওয়ায় এসে মাটিতে চাটাই পেতে বসত। একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে খানিক আলতা ঢেলে, কাপড়ের ন্যাকড়া চুবিয়ে মাসি মা-বউদের আলতা পরিয়ে দিত। বিনিময়ে লাল হয়ে যাওয়া আঙুলগুলো পেতে নিয়ে যেত, সামান্য কয়টা পয়সা। পুতুলওয়ালা মাথায় ঝুড়ি করে মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল নিয়ে আসত। ঝুলনের আগে আগে তাদের আসা যাওয়া আরো বেড়ে যেত। তখন ঘরে ঘরে ঝুলন উৎসব পালন করত বালক-বালিকারা। আর তার জন্য লাগত ঠাকুরের মূর্তি, ছোট ছোট খেলনা পশু মূর্তি। মিছিমিছি গাছ, বাড়ি আরো কত কী! সে দৃশ্য গ্রামগঞ্জের পথঘাট থেকেও চিরকালের মতন হারিয়ে গেছে। বর্তমানে বেশ কয়েকবার পুতুল বিক্রি হতে দেখেছি নদীয়া লাইনের রেলের কামরায়। লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের কাছে কিংবা দূরপাল্লার প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলোতেও কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল বেচতে আজও কিছু বিক্রেতা ওঠে। 

 আজও গ্রামের পথে কখনো সখনো দেখতে পাওয়া যায় হরেক রকম জিনিস নিয়ে ফেরিওয়ালা। তবে সাইকেল ছেড়ে তারা এখন ট্রলি নিয়েছে। সমস্ত ট্রলি জুড়ে সাজানো থাকে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। কখনো বা তার দাম ফিক্সড করা থাকে। 'হরেক মাল কুড়ি টাকা' রেকর্ড চলে অনবরত। হিন্দি গান চালিয়ে আজ কাচের গাড়িতে আচার সাজিয়ে নিয়ে যায় আচারওয়ালা। মাদুর ও চাটাইওয়ালা ঢুকে পড়ে গ্রামের নির্জন পথে। ইঁদুর, উকুন, তেলাপোকা মারার ওষুধ, বাতের ব্যথা, গাটের ব্যথা, মাথাব্যথার তেল, মাথায় মাখার গন্ধ তেল, এইসব নিয়েও বেচতে আসে কেউ কেউ। তবে, খদ্দের এখন অনেক কমে গেছে। তাই তারাও যে কতদিন এই পেশায় থাকবে তা লাখটাকার প্রশ্ন। 

 আগে গ্রামের পথে খঞ্জনি বাজিয়ে বাউল ঘুরত। গৌর নিতাই সেজে দোরে দোরে ঘুরে, নাচ দেখিয়ে, রোজগার করত কিছু মানুষ। যাদের আর তেমন বিশেষ দেখতে পাওয়া যায় না। আগে কত মানুষের পেশাই ছিল বহুরূপী সেজে রোজগার করা। একদিন রংচং মেখে রাম-সীতা সেজে ঘোরা, তো পরদিন ননীচোর নাটুয়া সেজে অন্য পথে হেঁটে যাওয়া। আবার তারপর দিন গলায় প্লাস্টিকের সাপ ঝুলিয়ে ভবঘুরে শিব সেজে ভিক্ষা করে বেড়ানো। শুধু এইভাবে যারা উপার্জন করত, তারা এখন অন্য কোন উপায়ে পেট চালানোর চেষ্টা করে। অথচ মানুষের মনোরঞ্জন করাই একসময় কারুর কারুর পেশার পিছনে নেশা ছিল। যেমন, এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, 'আরণ্যক' উপন্যাসের ধাতুরিয়াকে। যাকে জমি দিতে চাইলেও নিতে চায়নি। কারণ, গরিব নর্তক ধাতুরিয়া জানিয়েছিল, মানুষকে নাচ দেখিয়ে দু'পয়সা উপার্জন করতেই সে ভালবাসে। তাতে আধপেটা খেলেও দুঃখ নেই। 

 নিজের নেশাকে পেশা করে ভালবেসে টিকিয়ে রাখতে কোন যুগে কোন মানুষই পারেনি। আজও পারে না। ধাতুরিয়ার মতন অনেককেই তাই আত্মহত্যা করতে হয়। 

 হনুমানজির সিঁদুর মাখা মূর্তি হাতে পান্ডা ঠাকুরের প্রণামী আদায় করে বেড়ানোর লোকও এখন বড় কম। এখন সিনেমার নায়ক - নায়িকাদের জন্য চুল কিনতে আসে ডুগডুগি বাজিয়ে। শুনেছি, পড়ে যাওয়া চুল নাকি চার হাজার টাকা কিলো। 

 এই সেদিনের কথা, রবিবারের সকালে গ্রামের বাড়িতে উঠোনে বসে তরকারি দিয়ে মুড়ি মাখা খাচ্ছি। কপালে তিলক কেটে হাতে গোপাল ঠাকুর নিয়ে এসে দাঁড়াল এক মানুষ। গোপালের গলায় ঝুলছে, ভিক্ষালব্ধ কিছু দশ টাকা। ইচ্ছে করছিল, গোপালের সাথে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলি। হল না। দুনিয়ার সবকিছু বদলে গেলেও গোপাল যে শিশুটিই থেকে গেছে। শিশুরা কি বড়দের ইচ্ছা টের পায়? 
                                                                  (ক্রমশ...) 

ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments