জ্বলদর্চি

প্যান্ডোরা'র বাক্স /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৫৫

প্যান্ডোরা'র বাক্স :

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
ডিটেনশন ক্যাম্পের অন্ধকার কুঠুরি :

বার্লিনের দশ কিলোমিটার পশ্চিমে ছোট্ট শহর রুহলেবেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ডিটেনশন ক্যাম্পের জন্য শহরটি বিখ্যাত। ক্যাম্পের নাম রুহলেবেন ইনটার্ন ক্যাম্প। মূলত সিভিলিয়ান বন্দী শিবির। উঁচু উঁচু কাঁটাতারের বেড়া ঘেরা। ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয়ে মোড়া সর্বত্র। লম্বা লম্বা গেটের সামনে দাঁড়ানো সর্বক্ষণের সৈনিক-গার্ড আর তাদের সন্দেহ দৃষ্টি। চব্বিশ ঘণ্টা বন্দুক হাতে গেট পাহারার মস্ত দায়িত্ব মধ্য তিরিশের যুবা সৈনিকদের কাঁধে।

তখনও বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে খুব বেশি দেরী নেই। অক্ষশক্তির দেশগুলি থেকে যে সকল নাগরিক জার্মানিতে পড়তে, থাকতে, ছুটি কাটাতে অথবা বেড়াতে এসেছে কিংবা কর্মক্ষেত্রে এসে পড়েছে, তারা এখন মহাবিপদে, ঘোর ফাঁপরে। সেদিনটা ছিল ২৮শে জুলাই ১৯১৪। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি আক্রমণ করে বসল জার্মানি। শুরু হয়ে গেল সাম্প্রতিক কালের সব চাইতে বড় মহাযুদ্ধ। সে যুদ্ধে কারণে-অকারণে জড়িয়ে পড়ে ইউরোপীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশ।

সালটা ১৯১৩। গ্রীষ্মের তাপমাত্রা খানিক উর্ধ্বমুখী সেবার। কারণটা সহজে বোধগম্য। ইউরোপের আকাশে যুদ্ধের দুন্দুভি বাজছে। কূটনৈতিক ভ্রুকুটি তখন চোখ রাঙাচ্ছে। এই আবহে জার্মানি পাড়ি দিল বছর তেইশের তরতাজা এক যুবক জেমস। জেমস চ্যাডউইক। জাতিতে ইংরেজ। ফিজিক্সে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট। ১৯১৩ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড-এর আন্ডারে ফিজিক্সে এম.এসসি. কমপ্লিট করা উঠতি এক প্রতিভাবান তরুণ। পড়াশুনায় দারুণ আগ্রহ তার। অত্যন্ত মেধাবী। উচ্চশিক্ষার আশা মনের গভীরে গ্রথিত। বিশেষত বিটা রেডিয়েশন নিয়ে আরও পড়াশুনার আশা নিয়ে জার্মানি বেড়াতে গেল সে। বেড়ানো যদিও মূল লক্ষ্য নয়; আসল উদ্দেশ্য বিটা রেডিয়েশন নিয়ে গবেষণা করা এক দিকপাল অধ্যাপকের আন্ডারে অধ্যয়ন। 'গাইগার কাউন্টার' উদ্ভাবন করে তখন রীতিমত খ্যাতির চূড়ায় অধ্যাপক হান্স গাইগার। বিশ্ব জুড়ে বেশ নামডাক তাঁর। কারণ তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রটি খুব সহজে তেজস্ক্রিয় কণিকা― আলফা, বিটা আর গামা কণা― সনাক্ত করতে পারে। বিটা রেডিয়েশন আছড়ে পড়লে নড়ে ওঠে কাউন্টারের কাঁটা। প্রফেসর হান্স গাইগার তখন বার্লিনের জার্মান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে রেডিয়েশন রিসার্চ সেন্টারের প্রধান। বিটা রেডিয়েশনের অভিনব অবিচ্ছিন্ন বর্নালী (Continuous Spectra)-এর ব্যাখ্যা পেতে দিনরাত এক করে উঠে পড়ে লেগেছেন। বিটা কণিকার এই অদ্ভূত আচরণের ব্যাখ্যা কী, গবেষণা করে দেখতে চ্যাডউইক হাজির বার্লিনে। 

সমস্যা দেখা দিল ১৯১৪ সালে জুলাই মাসের শেষে। গোটা জার্মানি জুড়ে যুদ্ধের সাজো সাজো রব। অনাগত যুদ্ধের সমরশিঙা ফুঁকে চলেছে সমর-নায়কেরা। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেল সাম্প্রতিক কালের অনাকাঙ্ক্ষিত এক লড়াই― বিশ্বযুদ্ধ। ক্ষমতা দখলের অদম্য চেষ্টা। বাতাসে বারুদের ম ম গন্ধ। সন্দেহ দৃষ্টি! ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটছে গোলাবারুদ, কামান, সৈনিক। যুদ্ধের মহড়া রীতিমত সারা। যুদ্ধের সেই যাঁতাকলে দমবন্ধ হয়ে মারা পড়বার জোগাড় সাধারণ মানুষের। বিশেষ করে চ্যাডউইক-এর মতো বিদেশী অতিথিবর্গের হয়েছে মরণ দশা। দেশে ফিরে যাওয়ার সব উপায় আপাতত বন্ধ। উপরন্তু শ'য়ে শ'য়ে নিরপরাধ ভিনদেশী মানুষকে বন্দি বানিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রিজন ক্যাম্পের অন্ধকার কুঠুরিতে। যেন মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়বে একটু পরে। ডিটেনশন ক্যাম্পের কাঁটা তারের ভেতরে মুক্তির প্রতীক্ষায় দিন গোনা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বালাই ষাট! এ কোন অন্ধকার যুগে আমাদের বাস! বলা নেই, কওয়া নেই; হুটহাট পরিস্থিতির বদল ঘটছিল আকছার। 
     

এমনই এক ক্যাম্প রুহলেবেন ইনটার্ন ক্যাম্প। বন্দী হয়ে সেখানে কঠিন দিনযাপন শুরু চ্যাডউইক-এর। যদিও প্রিজন ক্যাম্পের গার্ডরা অতটা কড়া ধাতের নয়। একটু নরম মনের। তবুও শত্রু পক্ষ তো! বিশ্বাস কী! আজ না হয়, কাল; কিছু একটা করে ফেললে কে-ই বা আটকাচ্ছে! গুলি করে মেরে মাটির নীচে পুঁতে ফেললে কিংবা নদীর জলে ভাসিয়ে দিলে কার কী আসে যায়? কে দেখতে আসবে? হাজার একটা নেগেটিভ ভাবনা মনের ভেতর। আদৌ দেশে ফিরতে পারবে কিনা কে জানে? ফিরবেই সে গ্যারান্টি নেই। এখন রুহলেবেন ক্যাম্পে দিন গণনা করে চলাই নিয়তি। হা গড! আর য়্যু সো আনকাইন্ড! প্লিজ হেল্প আস অল। হাউ ক্যান উই এসকেপ ফ্রম ক্যাম্প?

নাহ, আর নয়। এমনি এমনি ভবি ভুলবার নয়। চ্যাডাউইক যেন অন্য ধাতু দিয়ে গড়া! মচকাবে, কিন্তু ভাঙবে না। এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র সে নয়। ক্যাম্পের চৌহদ্দির ভেতর নতুন কিছু গড়তে হবে। যেই ভাবা, অমনি কাজ। বাকি সহবন্দীদের নিয়ে গরাদের চার দেওয়ালের ভেতরে একটি সায়েন্স ক্লাব তৈরি করল সে। প্রত্যেক বন্দী অপর কোনও বন্দীর সম্মুখে বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে ভাষণ দেবে আধ ঘণ্টা বা তার বেশি, বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা চলবে। এমন ভাবে বক্তৃতা দিতে হবে যাতে ক্যাম্পের গার্ডের নজরে পড়ে বিষয়টি। তাহলেই সায়েন্স ক্লাব তৈরির আসল লক্ষ্য পূরণ হবে। কারণ এতসবের মূল উদ্দেশ্য একটাই― ক্যাম্পের চৌহদ্দির মধ্যে ছোট্ট একটা ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা। সে-ল্যাবে প্রত্যেকে নিজের নিজের জ্ঞানের খোরাক জোগাড় করবে; যার যে অভিজ্ঞতা, তা উজাড় করে নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় ভাসবে। সম্পৃক্ত হবে বিজ্ঞান গবেষণা। জ্ঞানের প্রসার হবে, চর্চা হবে। উপকৃত হবে শিক্ষিত বন্দী সকলে। ক্ষুরধার মস্তিষ্ক থেকে নেগেটিভ ভাবনাগুলো অন্তর্হিত হবে নিমেষে। বন্দী শিবিরেও ব্রেন থাকবে তরতাজা, মন হবে চিরসবুজ। 

শেষমেশ বরফ খানিকটা গলল। কিছু গার্ড গোপনে বন্দীদের সাহায্য করতে সম্মত হল। হু-র-রে! অভাবনীয় ব্যাপার। একদিনের ঘটনা। গার্ড মারফত চ্যাডাউইক-এর হাতে এল একটি রেডিওঅ্যাকটিভ টুথপেস্ট। তেজস্ক্রিয় টুথপেস্ট! হ্যাঁ, তাই। সেসময় জার্মানির হাটে-বাজারে কান পাতলে হামেশাই মিলছিল রেডিওঅ্যাকটিভ টুথপেস্ট। হয়তো অনেক রাসায়নিক পাওয়া বেশ দুস্কর। কিন্তু রেডিওঅ্যাকটিভ টুথপেস্ট কেনা গার্ডদের কাছে জলভাত। খুব সহজ একটা কাজ। প্রায়শই গার্ডদের পটিয়া পাটিয়ে রেডিওঅ্যাকটিভ টুথপেস্ট ও  অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র পৌঁছে যেত চ্যাডউইক-এর হাতে। একদিন পাতলা টিনের কিছু পাত আর কাঠের তক্তা জোগাড় করে ফেলে সে। তা দিয়ে বানিয়ে ফেলল ইলেকট্রোস্কোপ যন্ত্র। বেশ কয়েকটি সিম্পল এক্সপেরিমেন্ট হাতেনাতে প্রমাণ করা গেল এর সাহায্যে।তড়িদাহিত বস্তুর আধানের অস্তিত্ব মাপল যন্ত্রটি। উপরন্তু টিনের ফয়েল আর টুথপেস্ট দিয়ে রেডিওঅ্যাকটিভিটির উপর বেশ কিছু ছোটখাটো গবেষণার কাজ এগিয়ে রাখে সে।

বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্য নিয়ন্তা যে অ্যাটম বোমা, তার মূলে রয়েছে নিউক্লিয়াসের ভাঙন। মৌল পদার্থের নিউক্লিয়াস ভাঙতে চাই একটি মাত্র মৌলিক কণা। নিউট্রন। আর নিউট্রনের আবিষ্কারক কি-না প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে বন্দিজীবনের শাপমোচন করছে শত্রু শিবিরে! বছর চারেকের অমূল্য সময় নষ্ট করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্তির নীলনকশা তৈরি হচ্ছে যেন প্রথম মহাযুদ্ধের ডিটেনশন ক্যাম্পে। এ এক অদ্ভূত সমাপতন! সমাপতন যুগপৎ ধ্বংস আর সৃষ্টির। যে-যোগী, সে নিজেও ভুক্তভোগী। জীবনের হারিয়ে যাওয়া অন্ধকার সময়গুলো তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, উত্তর হাতড়ায় আর সমাধানের প্রয়াস খোঁজে অনন্ত কাল। কারণ সে জানে কারও কারও জীবনে যুদ্ধ কতটা বিভীষিকাময়, আঁধারঘন অধ্যায় সূচনা করে। আবার অন্যদিকে, নিজের আবিষ্কার অজান্তে কখন যে শান্তিকামী বিশ্বের হন্তারক হয়ে দাঁড়ায়, তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না সে!

(২)
মশা আর হাতির যুদ্ধ :

ডেভিড আর গোলিয়াথ-এর যুদ্ধ মনে আছে? প্রথমজন পুঁচকে এবং দ্বিতীয়জন দৈত্যাকার দস্যু। তা সত্ত্বেও জয়ী হল ডেভিড। কোন মন্ত্রে অসম্ভবকে সম্ভব করল সে?

কেউ কি ভেবেছিল; জ্বালানি ভর্তি ছোট্ট একটা প্লেন সুউচ্চ দৈত্যাকার আস্ত টুইন-টাওয়ার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নিমেষে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে? খর্ব হবে সভ্যতার যাবতীয় গর্ব, ধ্বংস হবে ঠুনকো অহংকার? শত্রুরা বলবে, বেশ হয়েছে। দ্যাখ, কেমন লাগে! যোগ্য জবাব দিয়েছে অমুক। সঠিক কাজ করেছে তমুক লোক। পণ্ডিতগণ প্রমাদ গুণবে। হাহুতাশ করবে নিরীহ মানুষ। মিথ্যে ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা চালাবে কূটনীতি। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

অ্যাটম বোমা আবিষ্কারের পূর্বে যখন নিউট্রন কণিকা আবিষ্কৃত হয়নি, তখন পণ্ডিতদের ধারণা ছিল অমিত ক্ষমতাধর নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে পারে একমাত্র ভারী কোনও কণা। যেমন, আলফা পারটিক্যাল। আলফা পারটিক্যালের ভর চারটি প্রোটনের ভরের সমান আর তার আধানের মান দুটি ইলেকট্রনের বিপরীত আধানের মানের সমান। এ হেন আলফা পারটিক্যাল দিয়ে নিউক্লিয়াস ভাঙনের কাজ চলেছে দীর্ঘদিন। আলফা পারটিক্যাল দিয়ে নিউক্লিয়াসকে ভাঙার একটি বড়সড় সমস্যা হল আলফা পারটিক্যালের ধনাত্মক আধান। ওদিকে নিউক্লিয়াসও ধনাত্মক তড়িৎধর্মী। দুটি ধনাত্মক তড়িৎ পরস্পর বিকর্ষণ করে। এই বিকর্ষণ বলের মান তত বাড়তে থাকে, আধান দুটি যত কাছাকাছি আসে। তার ফলে, যে-পরিমাণ শক্তি নিয়ে একটি আলফা কণা নিউক্লিয়াসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, বিকর্ষণ বলের জন্য তার সিকি পরিমাণ শক্তি নিয়ে নিউক্লিয়াসে আছড়ে পড়ে সে। সেজন্য ভারী নিউক্লিয়াসের ভাঙন কখনও সম্ভব হয় না। অথচ ফিজিক্সের এই সামান্য ঘটনাটি তাবড় তাবড় পণ্ডিতদের বোধগম্য হয়নি। একবার নয়, বারবার একই পরীক্ষা চালিয়ে গেছেন তাঁরা। প্রত্যেক বারই ব্যর্থ হয়েছেন।

১৯১৯ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে আগের বছর। কেমব্রিজের বিজ্ঞানাগার ক্যাভেনডিস ল্যাবরেটরি। এই ল্যাবে রাদারফোর্ড-এর অসীম কৌতূহল পরমাণুর অন্তরে কী আছে জানবার। জানার সবচেয়ে ভালো উপায় পরমাণুর হৃদয়কে শক্তিশালী কণিকা দিয়ে আঘাত করা। যখন তিনি এই পরীক্ষা করতে মনস্থির করলেন; মনে রাখা দরকার― তখনও প্রোটন, নিউট্রন কিছুই আবিষ্কৃত হয়নি, এক পরমাণুর কেন্দ্রস্থল নিউক্লিয়াস ছাড়া। পরীক্ষার জন্য তিনি নাইট্রোজেন মৌল পদার্থ বেছে নিয়েছেন। সদ্য আবিষ্কৃত দ্রুতগামী আলফা কণা দিয়ে নাইট্রোজেনকে আঘাত করে বসলেন। পরীক্ষাটা সফল করতে যতটা না বেগ পেতে হয়েছে, তার চাইতেও বেশি অবাক হয়েছেন তিনি পরীক্ষার ফলাফলে। কাঁচের যে টিউবে তিনি নাইট্রোজেন গ্যাস ভরে বিক্রিয়া ঘটিয়েছিলেন, সেখানে নাইট্রোজেন গ্যাসের আর নামগন্ধ নেই। তার বদলে টিউবে তৈরি হয়েছে অক্সিজেন গ্যাস। এ যে মিরাকল ব্যাপার! সরাসরি নাইট্রোজেন থেকে অক্সিজেনে রূপান্তর কীভাবে সম্ভব? তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝালেন ― নাইট্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রে যে ধনাত্মক তড়িদাহিত অংশ (যা তিনি ১৯১১ সালে বলেছিলেন, তাঁর বিখ্যাত আলফা কণা বিক্ষেপন পরীক্ষার মাধ্যমে) বর্তমান, আলফা কণিকার আঘাতে তা বিমুক্ত হয়েছে। উনি তার নাম দিলেন 'প্রোটন'। অর্থাৎ, এতদিনে পরমাণুর দুটি যুতসই কণিকার সন্ধান পাওয়া গেছে। ইলেকট্রন আর তার যোগ্য দোসর প্রোটন। রাদারফোর্ড-এর এ হেন পরীক্ষার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে বৈকি। তা হল― হালকা মৌল পদার্থের ট্রান্সমুটেশন বিক্রিয়াসমূহের যে ধারণা এতদিন আবদ্ধ ঘরে বন্দী ছিল, এক ঝটকায় তার দরজা হাট করে খুলে গেল।
          

ইতিমধ্যে রাদারফোর্ড-এর ওই পরীক্ষার পরে তেরোটি বসন্ত অতিক্রান্ত। পরমাণুর সংসারে ভাঙনের আর কোনও খবর আপাতত নেই। সালটা ১৯৩২। সেবছর দুটো পৃথক গবেষণার রেজাল্ট মোটামুটি একই। পরীক্ষা দুটি করেছেন দু'দল বৈজ্ঞানিক ভিন্ন ভিন্ন দুটি ল্যাব‍রেটরিতে। প্রথম দলে রয়েছেন মাদাম কুরির কন্যা আইরিন কুরি আর তাঁর  জামাতা ফ্রেডরিক জোলিও। স্বামী-স্ত্রী মিলে পরীক্ষা করছিলেন মৌল পদার্থ 'বোরন' নিয়ে। বোরনের পারমাণবিক ওজন হচ্ছে দশ। এই বোরনের উপর হিলিয়াম আয়নের আঘাত হেনে তাঁরা পেলেন নাইট্রোজেনের এক তুতো-ভাইকে,অর্থাৎ আইসোটোপকে ― যার পারমাণবিক ওজন তেরো। সমস্যা দাঁড়াল এই রকম― বোরন ও হিলিয়াম আয়নের মিলিত পারমাণবিক ওজন চোদ্দো। ওদিকে, বিক্রিয়ায় যে নাইট্রোজেন তৈরি হল তার পারমাণবিক ওজন তেরো। তাহলে বাকি এক পারমাণবিক ওজন গেল কোথায়? কুরি-দম্পতি ব্যাখ্যা দিলেন ― বোরন পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে একটা গামা রশ্মি বের হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার পর্যবেক্ষণে সামান্য ভুল করে বসলেন তাঁরা। যে-ভুল পরের সায়েন্টিস্ট শুধরে দিলেন খানিকটা।

ওই বছর রাদারফোর্ড-এর শিষ্য জেমস চ্যাডউইক একটা পরীক্ষা করেছিলেন মৌল পদার্থ 'বেরিলিয়াম' নিয়ে। বেরিলিয়াম মৌলের পারমাণবিক ওজন হচ্ছে নয়। এর পরমাণুকে চার পারমাণবিক ওজনের হিলিয়াম আয়ন অথবা আলফা পারটিক্যাল দিয়ে আঘাত হানলেন। আঘাতে বেরিলিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রস্থল গেল ভেঙে। তৈরি হল কার্বনের এক আপন-ভাই অর্থাৎ আইসোটোপ, যার পারমাণবিক ওজন বারো। তাহলে মোটামুটি কী দাঁড়াল? বেরিলিয়াম মৌলের পারমাণবিক ওজন নয় প্লাস আলফা কণার পারমানবিক ওজন চার। সমান মোট পারমাণবিক ওজন দাঁড়ায় তেরো। উৎপন্ন মৌল পদার্থ কার্বনের পারমাণবিক ওজন হচ্ছে বারো। এখানেও মোটামুটি এক পারমাণবিক ওজন হাপিস। আসলে সেদিন বেরিলিয়াম আর আলফা পারটিক্যালের পরীক্ষায় কার্বন পরমাণুর সঙ্গে একটি নতুন কণিকা নির্গত হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক চ্যাডউইক সে-কণার নাম দিলেন 'নিউট্রন'। মোদ্দাকথা এই দাঁড়ায়― পরমাণুর কেন্দ্রে এতদিন অনাবিষ্কৃত যে ক্ষুদ্র অথচ ভারী অংশ রয়েছে, সেখানে দু'জাতের কণিকার সহাবস্থান। এক, ধনাত্মক বিদ্যুৎধর্মী প্রোটন কণা এবং দুই, নিস্তড়িৎ নিউট্রন পারটিক্যাল। এই আবিষ্কারের ফলে পরমাণুর অন্দরমহলের চেহারাটাই পাল্টে গেল। এ হেন যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল বৈজ্ঞানিক চ্যাডউইককে। 

১৯৩২ সালে নিউট্রন কণার আবিষ্কার নিউক্লিয়াস ভাঙনের এক নতুন দিশা দেখাল। নতুন উৎসাহ নিয়ে পণ্ডিতরা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিউক্লিয়ার ফিশন ঘটানোর নেশায়। কারণ ততদিনে বিজ্ঞানীরা পরমাণুর কেন্দ্রে অসীম শক্তির খোঁজ পেয়ে গেছেন। সেজন্য নোবেল-জয়ী জার্মান পণ্ডিত ওয়াল্টার র্নেস্ট এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন― 'মনে হচ্ছে দুনিয়াটা বুঝি একটা বারুদের স্তুপের ওপর বসানো! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, দেশলাই কাঠিটার সন্ধান কেউ জানে না।'

রাদারফোর্ড তো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে, পরমাণুর ঘুমন্ত দৈত্যকে মানুষ কোনোদিনই জাগাতে পারবে না। যদিও তা পরমাণু বোমা আবিষ্কারের অনেক আগের কল্পনা!

১৯৩৮ সালের ঘটনা। জার্মান পণ্ডিত রসায়নবিদ অটো হান সেদিন হাতি-তুল্য ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে, যার পারমাণবিক ওজন হচ্ছে ২৩৫, ভাঙতে সমর্থ হলেন মশা সমান নিউট্রন পারটিক্যাল দিয়ে। অর্থাৎ, হাতি-মশার অসম যুদ্ধে জয়ী হল পরের জন।

(৩)
শূন্য থেকে উত্তরণ :

ইংল্যান্ডের চেশায়ার-এর একটি ছোট্ট মফস্বল টাউন বোলিংটন। সে-শহরে বাস করে কারখানার এক গরীব কর্মচারী জন। জন জোসেফ চ্যাডউইক। সুতো কারখানায় কার্পাস তুলা থেকে সুতা তৈরির কাজ তার। তার বউ অ্যানে মেরি নোলেস। লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করে বেড়ায় সকাল-সন্ধ্যা। সারাদিন বাড়ি বাড়ি ঝি-গিরি করে সামান্য ক'টাকা বেতন তার ইনকাম। বাসায় এসেও দুদণ্ড শান্তি নেই। বিশ্রাম নেবার ফুরসৎ মেলে না। সংসারের যাবতীয় কাজ একলা হাতে সামাল দিতে হয় তাকে। এছাড়া বিকল্প উপায় নেই। এ হেন দম্পতির প্রথম পুত্র সন্তান একজন বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। দিনটা ছিল ২০ অক্টোবর ১৮৯১ সাল। ওইদিন বোলিংটনে শ্রীমতী নোলেস-এর কোল আলো করে জেমস চ্যাডউইক-এর জন্ম। মা নোলেস আর বাবা জন চ্যাডউইক-এর খুশির অন্ত নেই! প্রথম পুত্র সন্তানের আগমনে ঘরময় খুশির আভা নিভে যায়নি তখনও। এদিকে বাড়ির আর্থিক স্বচ্ছলতা তথৈবচ! কোনও ক্রমে দিন চলে যায় এমন হারাকিরি অবস্থা। যথেষ্ট রোজগারপাতি নেই। উপরি রোজগারের আশায় চ্যাডউইক-দম্পতি বড় শহরে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। ম্যাঞ্চেস্টার এসে পৌঁছয় তারা। সেটা ১৮৯৫ সাল। ওদিকে বোলিংটনে মামাদাদু আর দিদিমার আদরে বড় হতে থাকে ছোট্ট জেমস। সেখানেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বোলিংটন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে। ছোটবেলা থেকে দারুণ মেধাবী সে। পড়াশুনায় তার বেশ আগ্রহ। অল্প সময়ে ক্লাসের সব পড়া তার আয়ত্ত হয়ে যায়। ক্ষুরধার স্মৃতিশক্তি। পড়াশুনায় তার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অল্প ক'দিনে স্কুলের মাস্টার মশায়দের স্নেহের পাত্র বনে যায় সে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তার বিদ্যাবুদ্ধির খবর চাউর হয়ে যায় দিনকে দিন। এমনকি, ম্যাঞ্চেস্টার গ্রামার স্কুল থেকে স্কলারশিপের লোভনীয় প্রস্তাব আসে। যদিও সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তার পরিবার। কারণটা অবশ্যই আর্থিক অসংগতি। স্কলারশিপ বাদে ন্যূনতম যে পরিমাণ অর্থ স্কুলে ব্যয় করতে হবে, তার সংস্থান করা আপাত অসম্ভব কাজ তার পরিবারের পক্ষে। তায় আবার দুটি ছোট ভাই রয়েছে তার। হ্যারি ও হুবার্ট। একমাত্র ছোট বোন শৈশবেই মারা গেছে।

সব দিক বিবেচনা করে ছেলেকে ম্যাঞ্চেস্টার গ্রামার স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে বাবা-মা। ম্যাঞ্চেস্টারে আরও একটি নামকরা স্কুল আছে। সেন্ট্রাল গ্রামার স্কুল ফর বয়েজ। আপাতত সেখানে ভর্তি করা হয় জেমসকে। সেন্ট্রাল স্কুলে ভর্তি হয়ে তার উপকার-ই হল। বোলিংটন ছেড়ে ম্যাঞ্চেস্টারে মা-বাবা-ভাইদের সঙ্গে পাকাপাকি থাকবার একটা যুতসই কারণ অন্তত পাওয়া গেল!

কিশোর জেমসের বয়েস যখন মাত্র ষোল বৎসর, ইউনিভার্সিটির দু-দুটো স্কলারশিপ পরীক্ষায় বসে সে। দুবারই সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়। সালটা ১৯০৮। ম্যাঞ্চেস্টারের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সংকল্প তার। গণিত বরাবর তার প্রিয় বিষয়। ইউনিভার্সিটিতে গণিত অধ্যয়ন তার বরাবরের শখ। এদিকে একটা সমস্যা হয়েছে! গণিত বাদ দিয়ে ভুলবশত ফিজিক্সের ক্লাসে তার নাম নথিভুক্ত হয়ে গেছে ইউনিভার্সিটির খাতায়। এই যা! এখন কী করণীয়? অগত্যা স্নাতকে ফিজিক্স পড়াশুনা করার কঠিন চ্যালেঞ্জ নেয় সে। আর সে-চ্যালেঞ্জ তার সংকল্প বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস সর্বসাকুল্যে মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার হাঁটা পথ। যাতায়াতের ধার্য্য পয়সা বাঁচাতে বাড়ি থেকে রোজ পায়ে হেঁটে ইউনিভার্সিটির ক্লাসে পৌঁছে যায় সে। ক্লাস সেরে আবার গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা। এই ছিল রোজকার রুটিন। এভাবেই স্নাতকে ফার্স্ট ইয়ার পার। প্রথম বছরের শেষে ফিজিক্স পড়ার জন্য একটি স্কলারশিপ জুটে যায় অকস্মাৎ। হ্যাগিংবটম স্কলারশিপ। এখানকার ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় হেড আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। খুব নামী প্রফেসর। তিনি মূলত বৈজ্ঞানিক। গবেষণার জন্য পৃথিবী-জোড়া তাঁর নাম। ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্টদের রিসার্চ প্রোজেক্ট হাতে ধরে তৈরি করান তিনি। একদিনের ঘটনা। প্রজেক্ট ক্লাসে ছাত্রদের কাজের ভাগ পাখিপড়া করে বুঝিয়ে দিলেন প্রফেসর রাদারফোর্ড। এবার প্রফেসরের চোখের সম্মুখে সরাসরি চ্যাডউইক। দুটি ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে আগত তেজস্ক্রিয় শক্তির তুলনামূলক গণনার যন্ত্র বানানোর সুচিন্তিত পরামর্শ দেন ছাত্রকে। 
             
এদিকে ছাত্র পড়েছে মহাফাঁপ‍রে! কঠিন একখান সমস্যা তৈরি হয়েছে তার। ব্যাপারখানা কী? কীসের প্রবলেম? প্রফেসর রাদারফোর্ড যে-পদ্ধতি প্রয়োগ করে এক গ্রাম রেডিয়ামের সক্রিয়তা মাপার কথা আউড়েছেন, অধ্যাপকের সে-পলিসি ডাহা ব্যর্থ। এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট শূন্য। ওদিকে ছাত্রের মাথায় ঘুরঘুর করছে অভিনব এক উদ্যোগ। নতুন আইডিয়া! কিন্তু সমস্যা অন্যত্র! বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? প্রফেসরকে কে বলবে চ্যাডউইক-এর মনের কথা? কীভাবে প্রফেসরকে ম্যানেজ করা যায়? অগত্যা চোখ-কান বন্ধ রেখে চ্যাডাউইক একদিন ঠিক করল নিজের মনের কথা বলবে প্রফেসরকে। প্রিয় স্যারের সঙ্গে শেয়ার করল তার ভাবনা-চিন্তার ব্যাপ্তি। খুশি হলেন রাদারফোর্ড। অবশেষে প্রফেসর-এর সম্মতি মিলে গেল। নিজের উদ্ভাবিত নীতির সার্থক ব্যবহারে বনে গেল অভিনব একটি যন্ত্র। তার বানানো যন্ত্র খুব সহজে প্রফেসরের মন জয় করে নেয়। এ হেন রিসার্চ পেপারটি ছাত্রের জীবনের প্রথম গবেষণাপত্র। কো-অথার প্রিয় অধ্যাপক রাদারফোর্ড। রিসার্চ পেপার প্রকাশ পায় ১৯১২ সালে। ইতিপূর্বে ১৯১১ সালে, প্রথম শ্রেণীতে অনার্স সহ গ্র্যাজুয়েশন সম্পূর্ণ করে ফেলেছে সে। স্নাতকের পর লক্ষ্য আরও উঁচুতে। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট। ফিজিক্সে।

এমএসসি পাঠক্রমে শক্তিশালী গামা তরঙ্গ গণনার জন্য সে বানিয়ে ফেলল আরও একটি যন্ত্র। এ যন্ত্র বিভিন্ন তরল আর গ্যাসের দ্বারা গামা তরঙ্গ শোষণের পরিমাপ করে। এবার থিসিস পেপারটি ছাপা হলে আর্টিক্যালে কেবলমাত্র চ্যাডউইক-এর নামের উল্লেখ চোখে পড়ে। অর্থাৎ রিসার্চ পেপারটি তাঁর মৌলিক গবেষণালব্ধ ফসল। ১৯১২ সালে এমএসসি ডিগ্রিও হাতে এল। এসময় চ্যাডউইক সম্মানিত 'বেয়ার ফেলো' (Beyer Fellow) নির্বাচিত হন। একই বছর গামা বিকিরণে তাঁর মৌলিক কাজ '১৮৫১ এক্সিবিশন স্কলারশিপ' জিতে নেয়। এ হেন স্কলারশিপের বিশেষত্ব এই যে, ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত যেকোনও প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার অযাচিত সুযোগ রয়েছে বৃত্তি-প্রাপকের নিকট। 

চ্যাডউইক-এর প্রথম পছন্দ অবশ্যই জার্মানি। বার্লিনে প্রফেসর হান্স গাইগার-এর আন্ডারে বিটা রেডিয়েশন গবেষণা তাঁর অনেক দিনের শখ। সেজন্য ১৯১৩ সালে তাঁর জার্মানি গমন। প্রফেসর গাইগার-এর চেম্বারে তিনি প্রথম দেখলেন― বিটা রেডিয়েশন বর্ণালী নিরবচ্ছিন্ন বর্ণালী (Continuous Spectra); মোটেও বিচ্ছিন্ন (Discrete) বর্ণালী নয়। ফলাও করে ছাপলেন সে-তথ্য। বিটা রশ্মির এমন অদ্ভূত ফলাফলে পণ্ডিতগণ দারুণ বিস্মিত! চমকে উঠেছিলেন অনেকে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। বাকি দুই নিউক্লিয় ঘটনা― আলফা কণা ও গামা রশ্মি নিঃসরণ বিচ্ছিন্ন বর্ণালী সৃষ্টি করে। অথচ সমগোত্রীয় বিটা পারটিক্যাল বর্ণালীর এমন বিরুদ্ধাচরণ অনেকের অবাক ঠেকে সেদিন! বিটা পারটিক্যাল বর্ণালীর একটা যুতসই ব্যাখ্যা দিতে পেরে যতটা আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন চ্যাডউইক, তাঁর সে খুশি দীর্ঘায়িত হয়নি। কারণ খুব সিম্পল। ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ। সে-যুদ্ধ তাঁর সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। তাঁকে বন্দি করা হয় রুহলেবেন ইনটার্ন ক্যাম্পে। জীবনের মূল্যবান চার-চারটি বছর নষ্ট হল প্রিজন ক্যাম্পে এসে। ১৯১৮ সালের মে মাস। ভরা গ্রীষ্মের দাবদাহে ক্যাম্প থেকে মুক্তি মিলল। ছাড়া পেয়ে তিনি সোজা চলে গেলেন স্বদেশ ইংল্যান্ডে। লন্ডনের ক্যাভেনডিস ল্যাব‍রেটরির ডিরেক্টর তখন প্রফেসর আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। প্রৌঢ় অধ্যাপকের অধীনে কেমব্রিজের গনভিল অ্যান্ড কাইয়াস কলেজ থেকে ফিজিক্সে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন চ্যাডউইক, ১৯২১ সালের জুন মাসে। পিএইচডি কমপ্লিটের অব্যাহত পরে ক্যাভেনডিস ল্যাব‍রেটরিতে রাদারফোর্ড-এর সহকারী ডিরেক্টর হিসাবে গবেষণা কেন্দ্রে যোগ দিলেন। ঐতিহাসিক এই ল্যাব‍রেটরির ঐতিহ্য ধরে রেখে ১৯৩২ সালে নিউক্লিয়াসের নিস্তড়িৎ উপাদান― নিউট্রন আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বকে চমকে দিলেন তিনি। এ হেন কণিকা মারণাস্ত্র অ্যাটম বোমা তৈরিতে কাজে লাগে। নিউট্রন কণিকা আবিষ্কার তাঁকে নোবেল স্বীকৃতি এনে দেয় ১৯৩৫ সালে। সেবছর তিনি ক্যাভেনডিস ল্যাবরেটরি ছেড়ে লিভারপুল ইউনিভার্সিটি জয়েন করেন। গবেষণায় হাত পাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের ফিজিক্সের ক্লাস নেন লিভারপুল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়ে। 
        

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু বোমা প্রকল্পে টিউব অ্যালয় প্রোজেক্টের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ দলের সঙ্গে আমেরিকার ম্যানহাটন প্রোজেক্টে অংশগ্রহণ করেন। গোপন বোমা তৈরির মিশনে লস অ্যালামস ল্যাবরেটরি পরিদর্শনে যান। ১৯৫৯ সালে তাঁর কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ। অবসরের পনেরো বছর পরে কেমব্রিজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান বৈজ্ঞানিক, ১৯৭৪ সালের ২৪শে জুলাই।

(৪)
প্যান্ডোরা'র বাক্স :

পৌরাণিক গ্রীস দেশে আকাশ আর মেঘের দেবতা ছিলেন জিউস। তাঁর সুযোগ্য পুত্র গ্রীক-দেবতা হেফাসটাস, পিতার নির্দেশ মতো, প্রথম মানবী তৈরি করে মর্ত্যে প্রেরণ করেছিলেন। রক্ত-মাংসের সেই মানবীই গ্রীক পুরাণের 'প্যান্ডোরা'। টুকটুকে ফর্সা সুন্দরী এক রমণী। পৃথিবীতে অশুভ শক্তি থাকে কেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর পেতে প্যান্ডোরা একটি জার, যা আদপে প্যান্ডোরা'র বাক্স নামে পরিচিত, খোলে। জারের মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যত্বের সকল অশুভ শক্তি অচিরেই অন্তর্হিত হয়ে যায়।
          

হোমার-এর সমসাময়িক গ্রীক কবি হেসিওড (খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ ― ৬৫০) তাঁর বিখ্যাত 'ওয়ার্কস অ্যান্ড ডে'জ' কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন― প্যান্ডোরা'র বাক্স আদতে একটি শিল্পকর্ম, যা গ্রীক মাইথোলজিতে বহুল প্রচলিত। তিনি আরও বর্ণনা দিয়েছেন― অসুস্থ স্বামীর সুস্থতা কামনায় জারের মুখ খোলার দারুণ কৌতূহল প্যান্ডোরা'র।

বর্তমান সময়ে 'প্যান্ডোরা'র বাক্স' কথাটির গূঢ় অর্থ―অপ্রত্যাশিত মহান এক সমস্যা উন্মোচনের প্রতীক। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বর্তমানের মূল্যবান এক বস্তু; বাস্তবে তার উল্টো প্রতিচ্ছবি―অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়।

আধুনিক বিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক জেমস চ্যাডউইক-এর নিউট্রন পারটিক্যাল আবিষ্কারের ঘটনা যেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস নামক প্যান্ডোরা'র বাক্সের মুখ উন্মোচনের সামিল। সাময়িক হর্ষধ্বনির আড়ালে সভ্যতা ধ্বংসের যে নীলনকশা তার মধ্যে সযত্নে সঞ্চিত রয়েছে, সে খেয়াল কারও নেই। বর্তমানের উৎফুল্লের মধ্যে যার বীজ সুপ্ত ছিল আগামীর বিধ্বংসী অ্যাটম বোমা বানানোর হারাকিরিতে। সেজন্য আপাত দৃষ্টিতে নিউট্রনের আবিষ্কার বিজ্ঞানের এক দারুণ সাফল্য হলেও পৃথিবী ধ্বংসের মূলে যে-পরমাণু বোমা, সে-কথা চিন্তা করলেই বিজ্ঞানের যাবতীয় কারিগরি, বিজয়রথ মহাভারতের কুরুক্ষেত্রে বীর-যোদ্ধা কর্ণ-এর রথের চাকার ন্যায় মুখ থুবড়ে পড়লে বোধহয় সমাজ-সংসারের বেশি মঙ্গল হতো।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments