জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন- ১০ /মলয় সরকার

তুর্কী নাচন

পর্ব- ১০ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মলয় সরকার


পামুক্কেল পর্ব


আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে অনেকখানি জায়গা। সুন্দর গাছপালা দিয়ে সাজানো। ভিতরে রয়েছে ছেলেদের এবং মেয়েদের কাপড় জামা ছাড়ার যথেষ্ট জায়গা, একেবারে পরিচ্ছন্ন।আর রয়েছে নীল জলের পুল একটি। তাতে প্রচুর মেয়ে পুরুষ স্বল্পতম অংশ আবৃত করে আনন্দে জলক্রীড়া করছে। পাড়েও অনেক মানুষ তাদের উৎসাহ দিচ্ছে।পুলটি বেশ বড়ই। ভিতরে এছাড়াও রয়েছে চা , কোল্ড ড্রিংক্স বা স্ন্যাক্সের ছোট ছোট স্টল।তবে সব মিলিয়ে জায়গাটি বেশ ভাল লাগার মতই। জলটি ঈষদুষ্ণ। এখান থেকে জলটি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে । বেরোনোর ব্যবস্থা করা হয়েছে মাটির তলা দিয়ে। শুনেছি বিগত ৫০০০ বছর ধরে এই প্রস্রবণটিও মানুষ ব্যবহার করে আসছে। Antique pool বা ক্লিওপেট্রা পুলএর সামনেই একটা বেশ বড় জায়গা ঘিরে, রাখা আছে বহু ধ্বংসাবশেষের টুকরো। তার মধ্যে বিশাল বিশাল মাটির কলসীর মত কিছু দেখছিলাম। সেগুলি কোন কাজে ব্যবহার হত বুঝলাম না।হয়ত’ কোন শস্য বা মদ জাতীয় তরল রাখা হত। এ ছাড়া রয়েছে নানা স্তম্ভের টুকরো, পুরানো কারুকাজ রাশিকৃত  করা। সামনেই একটা দেওয়ালের অংশ দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পাথরের টুকরোগুলোর আয়তন দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।সেই সমস্ত পাথর কি দিয়ে নিটোলভাবে কাটা , কি দিয়ে গাঁথা অত সুন্দর করে দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। 



এখান থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই দেখি সেই সমস্ত জল বেরিয়ে আসছে আর তার সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সাদা দুধের মত এক চুনের আস্তরণ পড়ে আছে জলের বহমানতার চিহ্ন হিসাবে কোঁচ কোঁচ দেহ নিয়ে।আসলে এই জলে মিশে আছে ক্যালসিয়াম যৌগ বেশ প্রচুর পরিমাণে। তা গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গা বেয়ে। তার ফলে সারা পাহাড়ের গায়ে সুদীর্ঘ দিন ধরে তা জমে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। তবে স্থানীয় মানুষকে অনেক ধন্যবাদ। তারা এই প্রকৃতির সৃষ্টিকে নষ্ট না করে বাঁচিয়ে রেখেছে।যত দূর চোখ যায় নীচে পর্যন্ত ধবধবে সাদা চূণের আস্তরণ। এর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মে মাঝে মাঝে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট সাদা চৌবাচ্চার মত নীল জলের জলাধার। এই ধবধবে সাদা পাহাড়ের ঢালকে ওরা বলে পামুক্কেল    বা ‘ তুলোর প্রাসাদ”। এর থেকে আমার একটা জিনিস মাথায় খেলে গেল। তুরস্কের বিখ্যাত লেখক ওরহান পামুকের লেখা অনেক পড়েছি। তাঁর পদবী পামুকের সাথে তাহলে এর মিল আছে। পামুক এর অর্থ তুলো । লেখকদের আদি পুরুষেরা বোধ হয় তুলোর ব্যবসায়ী ছিলেন , তাই পামুক পদবী।সাধারণতঃ সব দেশেই মানুষের পেশা থেকেই তো তাদের পদবীর সৃষ্টি।


যাই হোক, এখানে, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, এই সাদা চুণের আস্তরণ বোধ হয় খুব ভঙ্গুর, একে বাঁচিয়ে চলতে হবে। একটু পরেই ভুল ভাঙ্গল। দেখি শ’য়ে শ’য়ে মেয়ে পুরুষ এর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এখানে নিয়ম হচ্ছে জুতো পরে হাঁটা যাবে না। তাই জুতো হাতে করে এর উপর দিয়ে যেতে হবে। এই যাওয়ার সময় পায়ের তলায় অনন্য অনুভূতিটা লাভের জন্যই বা এগুলো জুতোর চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে- এই আশঙ্কা থেকেই হয়ত এই ব্যবস্থা। আমরাও জুতো হাতে নিয়ে এর উপর দিয়ে চললাম। অনেকেই জুতো কোথাও রেখে যাচ্ছেন। তাঁরা আবার এখানে ফিরে আসছেন। কিন্তু আমরা আর ফিরব না, নীচে চলে যাব। তাই এর উপর দিয়েই হেঁটে নীচে নামতে লাগলাম। পায়ের পাতা ভিজিয়ে দেওয়ার মত জল সির সির করে ধাক্কা খেতে খেতে ছোট ছোট তরঙ্গের সৃষ্টি করে গড়িয়ে চলেছে। পায়ের নীচে , সমুদ্রের বালির উপর যেমন ঢেউয়ের দাগ থাকে তেমনই কোঁচকানো দাগ , কিন্তু খুব ছোট ছোট । জুতোর নীচের সোলের মত খাঁজ খাঁজ কাটা রয়েছে যেন। কিন্তু সেগুলো বেশ শক্ত, পাথরের মত। এর উপর দিয়ে চলতে বেশ ভালই লাগছে। চতুর্দিকে সাদায় সাদা । এখন গোটা পাহাড়ের ঢালটা দেখা যাচ্ছে। যখন যেখান দিয়ে জল গেছে সেখানেই রেখে গেছে তার সাদার স্তর। মাঝে মাঝে নীল জমা জল। যেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে সেখানেও গড়িয়ে পড়ার আকৃতিতে সাদা চুণের দণ্ড ঝুলছে। এ এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। উপরে সূর্য পরিস্কার আলোয় পড়ন্ত বিকাল ঝকঝক করছে।চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে সাদার ঔজ্বল্যে।


নামলাম নীচে।সঙ্গে রইল এক অদ্ভুত স্মৃতি। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, হয়ে গেলে আবার সেই পুরানো দোকানে ফিরে যেতে।


ফিরে এলাম দোকানে। এখানে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর একটি লোক আমাদের তুলে দিল মালপত্র সমেত একটি ছোট ভিড়ওলা মিনিবাসের মত বাসে। পরে বুঝেছিলাম, এই রাস্তা টুকুই আমাদের সবচেয়ে খারাপ যাত্রাপথ ছিল।তবে ওরা ড্রাইভারকে বলে দিয়েছিল আমাদের সঠিক জায়গায় নামিয়ে পরের বাসে উঠতে সাহায্য করতে।বেশ অনেকখানি রাস্তা, একেবারে আমাদের দেশের ছোট ভিড় ওলা মিনিবাসের মত বাসে গুঁতিয়ে আসতে মনে বেশ রাগ জমা হচ্ছিল।প্রায় আধ ঘণ্টা -চল্লিশ মিনিট চলার পর পৌঁছালাম একটা বড় বাস টার্মিনাসে। এই কষ্টের কথা জানানোরও কোন জায়গা নেই, কাকেই বা বলব। তবে পরের বাসে, সবটা উসুল হয়ে গেল।আগের বাসের ড্রাইভার পরের বাসে তুলে দিল যত্ন করেই। ওঠার একটু পরেই বাসে দেওয়া হল, ঠাণ্ডা জল, স্ন্যাক্স ইত্যাদি।


বোডরাম পর্ব


বাসে চেপে হোটেলে পৌছাতে বেশ সন্ধ্যে হয়ে গেল।তবে হোটেলে পৌঁছানো পর্যন্ত আর তেমন কষ্ট হয় নি। তবে এই হোটেলটা তুলনামূলক ভাবে খুবই সাদা মাটা। বেশি ভিড়ও নেই।আমাদের যে ঘর দিল, সেটিও আমাদের দেশের খুব সাধারণ মাপের হোটেল, যদিও এমনি ব্যবস্থাও সব আছে এবং খুব নোংরাও নয়। আমরা ভাবলাম, মাত্র একদিনের জন্য তো থাকব, এত চিন্তা করে আর লাভ নেই। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হোটেলেই। হোটেলের আশপাশের পরিবেশও খুব ঝাঁ চকচকে নয়। মামুলী ধরণের। 


সকালে উঠতেই, হোটেল মালিক বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেবেন, একটু পরেই আপনাদের গাইড আসবেন। আমরা যথারীতি তৈরী হয়ে খেতে গিয়ে দেখি, হোটেলটি একটি মোটামুটি একটু বড় উঠান সম্বলিত হয়ত কারও বাড়ী। হোটেল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।উঠানে রয়েছে একটি বেদানা গাছ। তার থেকে পড়ে পাকা সুন্দর বেদানা গড়াগড়ি যাচ্ছে, কেউ কুড়িয়ে নেয় নি।সামনেই বসে খাবার টেবিলে হোটেলের মালিক, আর দুজন অতিথির সাথে গল্প করছেন। তা না হলে লোভী আর পেটুক বাঙালী চরিত্র আমার প্রকাশ হয়ে পড়ত। আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ, এমন সময় হোটেল মালিক জানালেন, আপনাদের গাইড গাড়ী নিয়ে এসে গেছেন, অপেক্ষা করছেন।


গাইড ভদ্রলোক, ধবধবে ফর্সা, আমার থেকে একটু বেশী বয়স , রিটায়ার্ড। আগে তেল কোম্পানীতে ভাল পোষ্টে ছিলেন। এখন এই সমস্ত কাজ করেন শখে- ভাল লাগে করতে।


বেরোলাম। এখানে প্রথমেই ভদ্রলোক (ওনার নামটা ভুলে গেছি) নিয়ে গেলেন সেই প্রাচীন বোডরাম শহরের এক প্রায় অবিকৃত থিয়েটার বা নাটমঞ্চ। এখানে যে ভাবে লাইট লাগানো আছে, এবং পরিচ্ছন্ন, দেখে মনে হল, রীতিমত এটি ব্যবহৃত হয়। অবশ্য না হওয়ার কোন কারণই নেই। এটির সঙ্গে তো আর এখনকার মুক্তমঞ্চের কোন তফাতই নেই। সম্প্রতি শুনলাম, তুরস্ক সরকার নাকি এফেসাসের গ্রেট থিয়েটার টিকে আবার চালু করছেন। খুবই ভাল প্রস্তাব।এই মঞ্চটির সম্বন্ধে নতুন করে আর কিছু বলছি না।তবে এত অন্য গুলোর থেকে অনেক ভাল অবস্থায় আছে এটা বলতে পারি। এটি শহরের উপরেই রয়েছে।


বোডরাম শহরটি বেশি বড় নয় যদিও এর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। এটি ইজিয়ান সমুদ্রের উপর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। চারধারে নীল সমুদ্র ঘেরা, উঁচুনীচু পাহাড়ের উপর এই প্রায় রুক্ষ মরুভূমি সদৃশ শহরটির সৌন্দর্য কিন্ত এক কথায় অপরিসীম। এই শহরটিতে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জড়িত বলে আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে। প্রথম ব্যাপারটি হল, এখানেই সেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ লেখক, ভূগোল তত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের জন্মস্থান। আর দ্বিতীয় কারণটি হল, এখানেই সেই প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের আর একটি আশ্চর্যের জায়গা। এতটা জানলেও ঠিক খেয়াল ছিল না যে আজকের তুরস্কই সেদিনের এশিয়া মাইনর। এখানেই ছিল সপ্তম আশ্চর্যের দ্বিতীয় আশ্চর্য। একটির কথা আগেই বলেছি এফেসাস ঘোরার সময়ে আর দ্বিতীয়টি হল রাজা মসুলাসের (Mausolus)সমাধি। যেখান থেকে রাজাদের সমাধি ক্ষেত্র হিসাবে (Mausoleum) শব্দটির উদ্ভব হয়েছে।অর্থাৎ একা তুরস্কেই ছিল সপ্তম আশ্চর্যের দুটি আশ্চর্য।সেই সমাধি ক্ষেত্রটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর তার পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষের পাথর দিয়ে নাকি ১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে এখানকার দুর্গটি তৈরী হয়। 


এই শহরটির ইতিহাস কিন্তু খুবই প্রাচীন।এই শহরের প্রাচীন নাম ছিল হেলিকারনেসাস  (Halicarnassus)।
শহরটি খুব উঁচু একটি ভীষণ মজবুত দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল।এমনই শক্ত দেওয়াল ছিল যে গ্রীক মহাবীর আলেক্সাণ্ডারকেও এই রাজ্য জয় করতে বেগ পেতে হয়েছিল।


এই শহরের সঠিক প্রতিষ্ঠা না জানা থাকলেও খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় চতুর্থ শতাব্দীতে যে এটি রমরম করে চলত তা বোঝাই যায়। কারণ এখানকার পৃথিবীবরেণ্য শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক হেরোডোটাস ওই সময়েই বা খ্রীঃপূঃ চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতেই বর্তমান ছিলেন।এটি তখনকার দিনের কারিয়া প্রদেশের অন্তর্গত ছিল।


এখানে একটি জিনিস আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। যেটি দেখেছি আমার দেখা পৃথিবীর আর একটি জায়গায়। সেটি হল এখানকার সমস্ত বাড়ীর রঙ সরকারী নিয়ম অনুযায়ী, ধবধবে  সাদা। অন্য কোন রঙ করার কোন উপায়ই নেই।হয়ত বা জায়গাটা গরম বলে এই ব্যবস্থা।এর ফলে সারা শহরের একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। এই ব্যাপারটা অন্য ভাবে দেখেছি আর একটি শহরে, ভুটানের থিম্পুতে প্রতিটি বাড়ীতে ওদের ভুটানী রীতিতে আঁকা সাজানো আছে। এটা নাকি ওদের মিউনিসিপ্যালিটির নিয়ম। প্রত্যেককেই করতে হবে। সত্যি সমস্ত বাড়ী একই রকম হলে যে কোন মানুষেরই সে শহরকে দেখে অন্য ধারণা জন্মায়।


আমাকে গাইড বললেন, খুব তাড়াতাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে দেখতে হবে না। এখানে এত কিছু নেই যে আপনার দেখা হবে না। তবে প্রতিটিই দেখার মত, তাই আরাম করে আনন্দ করে ধীরে ধীরে দেখুন। ইতিহাসকে অনুভব করুন। গাইড ভদ্রলোকটি কম কথা বলেন, কিন্তু বড় সুন্দর কথা বলেন , স্মিত হাস্যে। খুব শান্ত।

এর পর ঢুকব বোডরাম শহরের মাঝে—

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments