শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত
পর্ব-২৪
সুদর্শন নন্দী
১৮৮৬, ১১ই মার্চ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে হলঘরে ভক্তসঙ্গে অবস্থান করছেন। রাত প্রায় আটটা। ঘরে নরেন্দ্র, শশী, মাস্টার, বুড়োগোপাল শরৎ। শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন — ব্রহ্ম অলেপ। তিন গুণ তাতে আছে, কিন্তু তিনি নির্লিপ্ত।
যেমন বায়ুতে সুগন্ধ-দুর্গন্ধ দুই-ই পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত।
বললেন, কাশীতে শঙ্করাচার্য পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন! চণ্ডাল মাংসের ভার নিয়ে যাচ্ছিল — হঠাৎ ছুঁয়ে ফেললে। শঙ্কর বললেন — ছুঁয়ে ফেললি! চণ্ডাল বললে, — ঠাকুর, তুমিও আমায় ছোঁও নাই! আমিও তোমায় ছুঁই নাই! আত্মা নির্লিপ্ত। তুমি সেই শুদ্ধ আত্মা।
ব্রহ্ম আর মায়া। জ্ঞানী মায়া ফেলে দেয়।
মায়া আবরণস্বরূপ। এই দেখ, এই গামছা আড়াল করলাম — আর প্রদীপের আলো দেখা যাচ্ছে না।
ঠাকুর গামছাটি আপনার ও ভক্তদের মাঝখানে ধরলেন। বলছেন, “এই দেখ, আমার মুখ আর দেখা যাচ্ছে না।
রামপ্রসাদ যেমন বলেছে — ‘মশারি তুলিয়া দেখ —’
ভক্ত কিন্তু মায়া ছেড়ে দেয় না। মহামায়ার পূজা করে। শরণাগত হয়ে বলে, ‘মা, পথ ছেড়ে দাও! তুমি পথ ছেড়ে দিলে তবে ব্রহ্মজ্ঞান হবে।’ জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, — এই তিন অবস্থা জ্ঞানীরা উড়িয়ে দেয়! ভক্তেরা এ-সব অবস্থাই লয় — যতক্ষণ আমি আছে ততক্ষণ সবই আছে।
যতক্ষণ আমি আছে, ততক্ষণ দেখে যে, তিনিই মায়া, জীবজগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব, সব হয়েছেন!
জ্ঞানী জ্ঞানলাভ করবার পরও বিদ্যামায়া নিয়ে থাকতে পারে — ভক্তি, দয়া, বৈরাগ্য — এই সব নিয়ে থাকতে পারে। এর দুটি উদ্দেশ্য। প্রথম, লোকশিক্ষা হয়, তারপর রসাস্বাদনের জন্য।
জ্ঞানী যদি সমাধিস্থ হয়ে চুপ করে থাকে, তাহলে লোকশিক্ষা হয় না। তাই শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।
১৮৮৬, ১৬ই এপ্রিল। গিরিশ, লাটু, মাস্টার উপরে গিয়ে দেখেন, ঠাকুর শয্যায় বসে আছেন। শশী ও আরও দু-একটি ভক্ত সেবার্থ ওই ঘরে ছিলেন, ক্রমে বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাখাল আসলেন।
গিরিশ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন — আচ্ছা মহাশয়, মনটা এত উঁচু আছে, আবার নিচু হয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন— সংসারে থাকতে গেলেই ও-রকম হয়। কখনও উঁচু, কখনও নিচু। কখনও বেশ ভক্তি হচ্ছে, আবার কমে যায়। কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকতে হয় কিনা, তাই হয়। সংসারে ভক্ত কখন ঈশ্বরচিন্তা, হরিনাম করে; কখন বা কামিনী-কাঞ্চনে মন দিয়ে ফেলে। এবার মাছির উপমা দিয়ে বোঝালেন, যেমন সাধারণ মাছি — কখন সন্দেশে বসছে, কখন বা পচা ঘা বা বিষ্ঠাতেও বসে।
ত্যাগীদের আলাদা কথা। তারা কামিনী-কাঞ্চন থেকে মন সরিয়ে এনে কেবল ঈশ্বরকে দিতে পারে; কেবল হরিরস পান করতে পারে। ঠিক ঠিক ত্যাগী হলে ঈশ্বর বই তাদের আর কিছু ভাল লাগে না। বিষয়কথা হলে উঠে যায়; ঈশ্বরীয় কথা হলে শুনে। ঠিক ঠিক ত্যাগী হলে নিজেরা ঈশ্বরকথা বই আর অন্যবাক্য মুখে আনে না।
মৌমাছির উপমা দিয়ে বললেন মৌমাছি কেবল ফুলে বসে — মধু খাবে বলে। অন্য কোন জিনিস মৌমাছির ভাল লাগে না।
ঠাকুরের শরীর একেবারে ভেঙ্গে পড়ছে। ইহলোকে তিনি আর মাস চার থাকবেন। ঠাকুরের আর বিবরণ কথামৃতে উল্লেখ নেই। কথামৃতের শেষ বর্ণনা রয়েছে ২৪শে এপ্রিল ১৮৮৬ অবধি।
এছাড়া পরিশিষ্ট থেকে বেশ কিছু উপমার উল্লেখ লক্ষ্য করি। ঠাকুর একই উপমা একাধিকবার দিয়েছেন ভক্তদের ঈশ্বরীয় কথা হৃদয়ে গেঁথে দিতে। তাঁর উপদেশ উপমা ছাড়া যেন স্বাদহীন। শুকনো কচকচে উপদেশ যে ভক্তদের কাছে নিরস লাগবে তা তিনি জানতেন। তাই তাঁর কথামৃত জুড়ে দেখি উপমা আর উপমা।
পরিশিষ্ট থেকে কিছু উপমার উল্লেখ করে এই উপমামৃতের ইতি টানব। ঠাকুর বার বার বলেছেন ভগবানকে সব পথ দিয়ে লাভ করা যায়। উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন-
সব পথ দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়। যেমন তোমরা কেউ গাড়ি, কেউ নৌকা, কেউ জাহাজে করে, কেউ পদব্রজে এসেছ, যার যাতে সুবিধা, আর যার যা প্রকৃতি সেই অনুসারে এসেছ। উদ্দেশ্য এক — কেউ আগে এসেছে, কেউ পরে এসেছে।
এটিও তিনি বারবার বলেছেন, ঈশ্বরদর্শনের উপায় অহংকার ত্যাগ। কেশবদের অনেকবার বলেছেন, উপাধি যতই যাবে, ততই তিনি কাছে হবেন। উঁচু ঢিপিতে বৃষ্টির জল জমে না। খাল জমিতে জমে; তেমনি তাঁর কৃপাবারি, যেখানে অহংকার, সেখানে জমে না। তাঁর কাছে দীনহীন ভাবই ভাল।
উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন, খুব সাবধানে থাকতে হয়, এমন কি কাপড়চোপড়েও অহংকার হয়। পিলে রোগী দেখেছি কালাপেড়ে কাপড় পরেছে, অমনি নিধুবাবুর টপ্পা গাইছে! কেউ বুট পরেছে অমনি মুখে ইংরাজী কথা বেরুচ্ছে!সামান্য আধার হলে গেরুয়া পরলে অহংকার হয়; একটু ত্রুটি হলে ক্রোধ, অভিমান হয়। ব্যাকুল না হলে তাঁকে দেখা যায় না। এই ব্যাকুলতা ভোগান্ত না হলে হয় না। যারা কামিনী-কাঞ্চনের মধ্যে আছে ভোগান্ত হয় নাই, তাদের ব্যাকুলতা আসে না।
উপমা দিয়ে ব্যাকুলতা কি তা বোঝালেন তিনি। বললেন, ও-দেশে হৃদয়ের ছেলে সমস্ত দিন আমার কাছে থাকত, চার-পাঁচ বছরের ছেলে। আমার সামনে এটা ওটা খেলা করত, একরকম ভুলে থাকত। যাই সন্ধ্যা হয় হয় অমনি বলে — মা যাব। অমি কত বলতুম — পায়রা দিব, এই সব কথা, সে ভুলত না; কেঁদে কেঁদে বলত — মা যাব। খেলা-টেলা কিছুই ভাল লাগছে না। আমি তার অবস্থা দেখে কাঁদতুম।
এই বালকের মতো ঈশ্বরের জন্য কান্না। এই ব্যাকুলতা। আর খেলা, খাওয়া কিছুই ভাল লাগে না। ভোগান্তে এই ব্যাকুলতা ও তাঁর জন্য কান্না! আর ঈশ্বরলাভের পর সংসারে বেশ থাকা যায়। বুড়ী ছুঁয়ে তারপর খেলা কর না। লাভের পর ভক্ত নির্লিপ্ত হয়, যেমন পাঁকাল মাছ। পাঁকের ভিতর থেকেও গায়ে পাঁক লেগে থাকে।
ঠাকুর ভক্তদের সাথে ভগবানের যে কথা বলতেন তার পরতে পরতে জুড়ে থাকত উপমা।ঠাকুর বলতেন জীবনের উদ্দেশ্য হল ঈশ্বর লাভ। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁকে লাভ করা যায়।সেই ইশ্বরের দোরগড়ায় পৌছে দিতে তিনি ভক্তদের সাথে ঈশ্বরীয় কথা বলতেন। আর তা সহজে যাতে বোধগম্য হয়, ভক্তদের হৃদয়ে যাতে গেঁথে যায় সেজন্য কথার ফাঁকে ফাঁকে দিতেন উপমা, শোনাতেন লৌকিক কাহিনী। এই যে মুক্তোর মতো এতো উপমা ঠাকুর ছড়িয়েছেন ভক্তদের ঈশ্বরমুখী করতে এরকম উদাহরণ অবতারের ইতিহাসে আর নেই। আর তাই শুধু কালিদাস নয়, ঠাকুরের শ্রীমুখ নিঃসৃত উপমার রেশ টেনে বলা চলে উপমা শ্রীরামকৃষ্ণস্য।
(সমাপ্ত)
0 Comments