জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায়-৩/ দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায়  
পর্ব - ৩                                

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      

সেই সময়ের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে কলকাতা ধীরে ধীরে সংগীত, নৃত্য এবং শিল্পকলার বিভিন্ন ধারা চর্চার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। কলকাতা তখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের রাজধানী। বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য ছাড়াও কলকাতা শহরের সকলকে দুহাত বাড়িয়ে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা খুব স্বাভাবিকভাবেই শিল্প ও শিল্পীদের আকর্ষণ করেছিল। ১৮৫৬ সালের ৬ই নভেম্বর কলকাতাতে এসেছিলেন অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। তিনি সঙ্গীত ও নৃত্যের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কলকাতার আসার পরে তিনি যেখানে থাকতেন সেই মেটিয়াবুরুজ অঞ্চল এবং তার আশেপাশের এলাকা ধীরে ধীরে লক্ষ্মৌয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ হিসেবে গড়ে উঠলো। এই সময়ে সংগীত ও নৃত্যের কলাকুশলীরা, চিত্রকর, সাহিত্যিক ও কবিদের একাংশ লক্ষ্মৌ থেকে এখানে আসতে শুরু করলেন। লক্ষ্মৌ ও অযোধ্যার মত একই রকম উচ্ছ্বাস, দরবারী ভাষা, কথোপকথন, সন্ধ্যের পরে সংগীতের আসর, পায়রা ওড়ানো ইত্যাদি লক্ষ্ণৌ কায়দা-কানুন এখানেও চালু হয়ে গেল।                   

দিনে দিনে কলকাতার এই ব্যাপ্তি ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মানুষদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল। নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় মলকার স্বামী খুরশিদ মলকা ও দশ বৎসরের গওহরকে নিয়ে চার বছরের বেনারসের জীবন ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন। কলকাতায় এসে তারা উত্তর কলকাতায় চিৎপুর অঞ্চলে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করলেন। মলকা সেখানেই তার নৃত্য-গীতের আসর শুরু করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে তার খ্যাতি কলকাতার অভিজাত মহলে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি অযোধ্যার নির্বাসিত নবাবের দরবার থেকে আমন্ত্রণ পেলেন তাঁর সভায় গান গাইবার জন্য। এই আসরে মলকা নিজে গান গাইলেন এবং গওহরকেও গান গাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। মলকার গান শুনে নবাব তাকে সভা গায়িকা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। কিশোরী গওহরের গান শুনে এবং তার সঙ্গীত প্রতিভা দেখে সেই সভায় উপস্থিত লক্ষ্ণৌ ঘরানার বিখ্যাত বৃন্দাদিন মহারাজ মলকাজানের কাছে গওহরকে তার কাছে ঠুমরী ও ধ্রুপদী নৃত্য কত্থক নাচের তালিম নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন। তাঁর কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে মলকাজান কাল বিলম্ব না করে তাঁর কাছে গওহরকে ঠুমরী গান ও কথক নৃত্যের তালিম নেওয়ার জন্য পাঠালেন। তিনি যখন কলকাতায় থাকতেন সেখানে এবং যখন লক্ষ্ণৌ যেতেন তার সাথে গওহরকে লক্ষ্ণৌ পাঠাতেন যাতে প্রশিক্ষণে কোনরকম ছেদ না পড়ে। বিনদাদিনের আর এক সুযোগ্য ছাত্রী আগ্রার জোহরা বাঈও একই সময়ে বিনদাদিনের কাছে প্রশিক্ষণ নিতেন। দিনে দশ থেকে বারো ঘন্টা ধরে তিনি অনুশীলন করাতেন। এছাড়াও মলকাজান গওহরকে বাংলা গান শেখানোর জন্য কলকাতার বিখ্যাত শিল্পী বামাচরণ ভট্টাচার্যের কাছে, বাংলা কীর্তন গান শেখার জন্য রমেশচন্দ্র দাসের কাছে এবং সৃজন বাঈয়ের কাছে ধ্রুপদ গান শেখার জন্য পাঠাতেন। মলকাজান নিজে যেহেতু উর্দু ও ফার্সী ভাষায় কবিতা লিখতেন সেজন্য তিনি নিজেই গওহরকে উর্দু ও ফার্সী ভাষা শেখানোর পাশাপাশি কাব্যরচনাতেও উৎসাহিত করতেন। ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজী গান শেখানোর জন্য মিসেস ডি, সিলভাকে নিয়োগ করেছিলেন। এইভাবে মলকাজান তার মেয়ের জন্য সঙ্গীত ও সাহিত্য শিক্ষার একটি সম্পূর্ণ নিটোল বৃত্ত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। 

গওরের জন্মগত প্রতিভা, সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রতি ভালোবাসা, নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও তীক্ষ্ণ প্রতিভার ফলে তার কাছে এই সমস্ত বহুমুখী শিক্ষা কোন বোঝা বলে মনে হতো না। সংগীত ও নৃত্যের সাথে সাথে মলকাজান উর্দুতে তার কাব্য রচনাও চালিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর রচিত বিভিন্ন উর্দু গানের কবিতার সংকলন গ্রন্থ 'মাখজান-এ-উলফত-এ-মলকা' বা 'ভালোবাসার সম্পদ' নামে গ্রন্থটি ১৮৮৬ সালে কলকাতায় প্রকাশিত হওয়ার পরে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মলকাজানের নাম ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের সভা গায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরে মলকাজান চিৎপুরে যে বাড়িতে থাকতেন সেই তিনতলা বাড়ীটি তৎকালীন চল্লিশ হাজার টাকায় কিনে নেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আজমগড়ে  রবার্ট ও ভিক্টোরিয়ার কাছে যে পরিচারিকা ছিল সেই স্বামী পরিত্যাক্তা আশিয়া ও তার ছেলে ভগলু বেনারসে মলকার প্রতিষ্ঠিত হবার খবর পেয়ে তার কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। পুরনো দিনের পরিচারিকা ও সঙ্গীকে কাছে পেয়ে মলকা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং তার ছেলে ভগলুকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। মলকা জান বেনারস ছেড়ে আসার সময় আশিয়া ও ভগলু তার সাথে কলকাতায় এসেছিল এবং সেখানেই ছিল। মলকাজান যখন চিৎপুর অঞ্চলে বাড়ীটি কিনলেন তখন বাড়িটির একাংশ আশিয়া ও ভগলুকে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ দান করেছিলেন এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আশিয়া ও ভগলু ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। 

বাড়িটি কেনার ঠিক এক বৎসর পূর্বে মলকার অন্নদাতা এবং ভালোবাসার সঙ্গী ও বন্ধু খুরশিদ, তার সাথে মলকা বেনারসে ছিলেন এবং পরবর্তীকালে কলকাতায় এসেছিলেন, তিনি দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছিলেন। খুরশিদের মৃত্যুতে মলকা ও গওহর খুব ভেঙে পড়েছিল। গওহর জানত যে খুরশিদই তার বাবা। যখন গওহরকে কোনোভাবেই সান্তনা দেওয়া যাচ্ছিল না তখন মলকা একদিন গওহরের জন্ম বৃত্তান্ত প্রকাশ করে জানালো যে তার আসল পিতা রবার্ট উইলিয়াম ইয়েওয়ার্ড, যে মলকাকে সন্দেহ করে তার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছিল এবং যখন মলকা ও গওহরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল সেই সময়ে গওহরের বয়স ছিল মাত্র ছয় বৎসর। জন্মের সমস্ত বৃত্তান্ত জানার পরে গওহর তার মাকে বলেছিল যে সে সেই আর্মেনীয় পিতার কাছে যেয়ে জানতে চাইবে যে কেন সে তাদেরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয় নি। কিন্তু মলকা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল এবং কোন প্রকার উৎসাহ দেখায় নি। ফলে দীর্ঘদিন যাবত গওহর এক নিদারুন মানসিক যন্ত্রণাতে বিদ্ধ হচ্ছিল। 
                                                              ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments